বিশ্লেষণ
আইন যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার
বছরের পর বছর ধরে দেশের শাসনব্যবস্থায় আইনকে যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটা নিয়ে লিখেছেন মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ার
এটা অনস্বীকার্য যে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য আইন তৈরি করা হয়, অন্যভাবে বললে মানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই আইনই মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের সহযোগী উপাদান বা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে, বিশেষত আইন যখন এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়, যাতে অতিবিস্তৃত, অস্পষ্ট এবং অসংগতিপূর্ণ ধারা থাকে কিংবা আইনের দুর্বল এবং ‘সিলেকটিভ’ প্রয়োগ হয়; আইনকে ইচ্ছাকৃতভাবে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যা নির্বিচার আটকের ন্যায্যতা দেয়, মৌলিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং বৈষম্যমূলক চর্চাকে উৎসাহিত করে।
আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে সেসব দেশে, যেখানে আইনের শাসন ভঙ্গুর, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সীমিত এবং গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকে। বাংলাদেশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
২.
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন অধ্যায়, যেখানে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটে। সরকারি চাকরিতে অন্যায্য কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও তৎকালীন সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন এবং সহিংস আক্রমণের ফলে পরবর্তীকালে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। গণ-অভ্যুত্থানে সমাজের সব স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এবং একটি স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন হয়।
জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বিগত সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যা, সহিংসতা, নির্বিচার আটক ও নির্যাতনের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে জড়িত ছিল।
আন্দোলন চলাকালীন হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে নির্বিচার আটক করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে স্বীকৃত ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার এবং আটকের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া (ডিউ প্রসেস) অনুসরণের যে বিধান, তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গণগ্রেপ্তার অভিযানের সময় আটক হওয়া প্রায় ৮৫ শতাংশ ছিল শিক্ষার্থী এবং সাধারণ নাগরিক আর ১৫ শতাংশ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিল। হত্যা, নির্বিচার আটক এবং নির্যাতনের পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে মানুষের যোগাযোগের অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।
এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, আত্মরক্ষায় বলপ্রয়োগ কিংবা জনস্বার্থের মতো ‘অস্পষ্ট’ বিষয়ের কথা বলা হয়েছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিপীড়ন, হয়রানি ও নির্যাতনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এসব ক্ষেত্রে আইন সহযোগী উপাদান বা অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যেমন, কারফিউ জারি, প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বা দেখামাত্রই গুলির নির্দেশকে ন্যায্যতা দিতে জননিরাপত্তা এবং জনস্বার্থের মতো বিষয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে মূলত আইন রাষ্ট্রের দমনমূলক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে সহায়তা করেছে, যা মানবাধিকারের মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
৩.
জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানেই নয়, বছরের পর বছর ধরে দেশের শাসনব্যবস্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হিসেবে আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন বিগত সময়ে কিছু কঠোর ও দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেছিল, যা স্পষ্টভাবে মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই আইনগুলো ভিন্নমত দমন, নির্যাতন এবং নিপীড়ন করে কর্তৃতবাদী শাসন টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ছিল। বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ছিল এমন একটি আইন (যা পূর্ববর্তী আইসিটি আইনের বিতর্কিত এবং দমনমূলক ৫৭ ধারার একটি পদচিহ্ন)। এ আইন বাংলাদেশে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার ভুক্তভোগী ছিলেন অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, এমনকি সাধারণ নাগরিকও।
এই দমনমূলক ডিএসএ আইনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে আইনের অপব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না, বরং আইনটি ব্যবহার করেই অর্থাৎ আইনের মধ্যে থেকেই মানুষকে হয়রানি এবং নির্যাতন করা সম্ভব ছিল। ডিজিটাল আইনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ভীতি এবং সেলফ-সেন্সরশিপের সংস্কৃতি তৈরি করে ভিন্নমতকে দমন করা, যা সংবিধান প্রদত্ত বাক্স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে। লক্ষণীয়, নিপীড়নমূলক ডিজিটাল আইন প্রণয়নে এবং প্রয়োগে বিগত সরকার ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যখন ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকারের ধারণা ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে, বাংলাদেশে দমনমূলক ডিজিটাল আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবং বিরোধী কণ্ঠ দমন করে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে পাকাপোক্ত করতে সহায়তা করেছে।
৪.
সাইবার বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছাড়াও বিগত সরকারের শাসনামলে মানহানিসংক্রান্ত আইনগুলোও আক্রমণাত্মকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাস করতে এবং যেকোনো ধরনের সমালোচনাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে সহায়ক ছিল। মানহানি আইনের অধীনে একটি সম্ভাব্য মানহানির ঘটনায় অসংখ্য মামলা দায়েরের রীতি ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, শুধু একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মানহানির মামলা করতে পারেন। তবে মানহানির মামলায় এই বিধান নিয়মিতভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা তাদের দলের নেতার সমালোচনা করলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হিসেবে একসঙ্গে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলো মানহানির মামলা করেন এবং ভুক্তভোগীদের হয়রানি করেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি মানহানিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা না করে এ–সংক্রান্ত আইন বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছিল। কারণ, এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং মানুষের বাক্স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অযৌক্তিকভাবে সংকুচিত এবং ক্ষুণ্ন করে।
মানহানির মতো আরেকটি বিতর্কিত আইন বিশেষ ক্ষমতা আইন, যেগুলা এখনো বহাল রয়েছে। এমনকি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলেও এই নিপীড়নমূলক আইনের প্রয়োগ হয়েছে, যা খুবই হতাশাজনক। এই আইন সরকারকে বিচার ছাড়াই নির্বিচার আটকের ক্ষমতা দেয় এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম হাতিয়ার। এ ধরনের আইন বাতিলের জন্য নাগরিক সমাজ এবং মানবাধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছেন।
৫.
আইনের ধারায় অস্পষ্টতা ও অসংগতি থাকলে যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ থাকে, তেমনি কিছু ক্ষেত্রে আইনের অনুপস্থিতিও মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। যেমন গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলেও বাংলাদেশে এ–সংক্রান্ত সরাসরি কোনো আইন নেই।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিগত সরকারের শাসনামলে ২০০৯ সাল থেকে ৭০৮টি গুমের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। তবে ২০২৩ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন নিয়মিত পর্যালোচনার (ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ—ইউপিআর) চতুর্থ চক্রে বাংলাদেশের দেওয়া প্রতিবেদনে গুমের অপরাধকে অপহরণ বা নিখোঁজের মামলা হিসেবে চিহ্নিত করে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। গুম বিষয়ে বিগত সরকারের অস্বীকৃতি রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর ব্যাপক দায়মুক্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সহায়তা করেছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে। তবে গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ বাস্তবায়নকারী দেশীয় কোনো আইন এখনো প্রণয়ন করা হয়নি।
৬.
মানবাধিকার লঙ্ঘনে আইনের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক অক্ষমতা ও দুর্বলতারও দায় রয়েছে। যেমন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন অনুসারে সেনাবাহিনী, পুলিশ বা রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কমিশন সরাসরি তদন্ত করতে পারে না। বিগত সরকারের শাসনামলে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে এসব বাহিনীর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ছিল। আইনি বাধা কমিশনকে রীতিমতো অকার্যকর করে রেখেছিল। এ ছাড়া কমিশনের অস্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া, শুধু সুপারিশের ক্ষমতা এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব কমিশনকে দুর্বল করেছে।
লক্ষণীয় হলো গত বছরের নভেম্বর মাসে কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সদস্যরা পদত্যাগ করার পর আট মাস পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত নতুন কমিশন গঠিত হয়নি। কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা এবং অস্তিত্ব নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সুযোগ ছিল মানবাধিকার কমিশনের আইনি প্রতিবন্ধকতা দূর করে, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী এবং কার্যকর কমিশন গঠন করার। কিন্তু সেট করা হয়নি। এর ফলে দেশে এখন মানবাধিকারের লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলেও কমিশন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
৭.
আইনের দুর্বল প্রয়োগ কিংবা আইন বাস্তবায়নে ব্যাপক ব্যর্থতাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী। আইনের দুর্বল প্রয়োগ অপরাধীর জন্য দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরিতে সহায়তা করে। ফলে অপরাধীরা আইন এবং জবাবদিহির ঊর্ধ্বে থেকে যান। এমন পরিবেশে আইন সুরক্ষার পরিবর্তে নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
উদাহরণস্বরূপ, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনটির কথাই ধরা যাক। এই আইনের অধীনে গত ১০ বছরে মাত্র ৫০টি মামলা করা হয়েছে এবং মাত্র একটি নির্যাতনের মামলায় অপরাধীরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে (ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন এগেইনস্ট টর্চার)। এমনকি দোষী সাব্যস্ত হওয়া মামলাটিতেও ভুক্তভোগীরা এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি। কারণ, সুপ্রিম কোর্টে মামলাটির আপিল শুনানি এখনো বাকি রয়েছে। এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৩-২৪ সালের মধ্যে জেল হেফাজতে ৯২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আইন থাকা সত্ত্বেও এত বিপুলসংখ্যক অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শাস্তি নিশ্চিতে আইনের কার্যকারিতা প্রায় শূন্য। নির্বিচার হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যুর ঘটনার বিপরীতে বিচার বা শাস্তিপ্রাপ্তির হার অত্যন্ত কম হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এটি শুধু আইন প্রয়োগের ব্যর্থতাই নয়, বরং একটি বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করে, যার ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। আইন বাস্তবায়নে ব্যাপক ব্যর্থতা বিচারব্যবস্থা নিয়েও আস্থার সংকট এবং সন্দেহ তৈরি করে।
৮.
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো নতুনভাবে গড়ে তোলার করার জন্য প্রয়োজনীয় রূপান্তরমূলক, কাঠামোগত এবং মানবাধিকারভিত্তিক আইনগত সংস্কারের সুযোগ এনে দিয়েছিল। রাষ্ট্র পরিচালনা, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির মূলনীতিগুলো নতুন করে চিন্তা করার এবং আইন ও রাজনীতির যে চিরাচরিত কাঠামো এত দিন ধরে চলে এসেছে, তা পুনর্গঠনের বিরল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এ রকম পটভূমিতেই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন কমিশন গঠন করে একটি সংস্কারমূলক কর্মসূচি হাতে নেয়।
এই সংস্কার পরিকল্পনা কাগজে-কলমে ‘আশাব্যঞ্জক’ মনে হলেও বাস্তবে তা কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রাষ্ট্রের পুরোনো ও পুঞ্জীভূত সমস্যাগুলো, প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য এবং অন্যায্য ক্ষমতাকাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার যে শক্তিশালী আকাঙ্ক্ষা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সাধারণ জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছিল, সংস্কার বাস্তবায়ন কর্মসূচিতে তা এখনো যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। সংস্কারপ্রক্রিয়াটি অনেকাংশেই এলিট–ভাবাপন্ন এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, যেখানে সাধারণ জনগণের, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাস্তব অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক চর্চাকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
মানবাধিকারের নীতি এবং মানদণ্ড অনুযায়ী, যে সংস্কার জনগণের জীবনকে প্রভাবিত করবে, সেই সংস্কারপ্রক্রিয়ায় জনগণের, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থবহ অংশগ্রহণ এবং সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। চলমান সংস্কার কার্যক্রমে তা অনুপস্থিত। সংস্কার কর্মসূচিতে বৈষম্যহীন এবং কাঠামোগত পরিবর্তনের সহায়ক তেমন কিছুর উল্লেখ নেই।
আইনি কাঠামোকে মানুষের অধিকার রক্ষায় কার্যকর করতে হলে জনবান্ধব, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবাধিকারভিত্তিক সংস্কারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে। মানবাধিকারভিত্তিক এবং রূপান্তরমূলক আইনি কাঠামো ছাড়া সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অসম্ভব, যদিও এই আকাঙ্ক্ষাগুলোই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতি।
মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক। বর্তমানে যুক্তরাজ্য সরকারের কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন ও বিকল্প উন্নয়ন বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন।
মতামত লেখকের নিজস্ব