কাজী নজরুল—সাম্য যাঁর জীবনের মূল সুর

কাজী নজরুল ইসলাম (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬—১২ ভাদ্র ১৩৮৩)প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জীবন পাল্টে দেওয়ার এক গভীর প্রেষণা নজরুলকে তাড়িয়ে ফিরেছে সারাটা জীবন। যার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কবিতায় ও জীবনাচরণে। প্রথম জীবনে লেখা সাম্যবাদী কবিতাগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘কুলি মজুর’ কবিতায় তিনি লেখেন:

‘দেখিনু সেদিন রেলে,

কুলি বলে এক বাবু সাব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!

চোখ ফেটে এল জল,

এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’

এ কবিতা আমাদের মর্মে আঘাত করে। কবির মতো আমাদের চোখও সিক্ত হয়। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ‘আসিতেছে শুভদিন’ উচ্চারণ করে আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেন। একজন বিপ্লবীর মতো যুবক নজরুলও আমাদের স্বপ্নের কথা বলেন। বলেন, ‘মহা-মানবের মহা-বেদনার মহা-উত্থানে’ নিশ্চয়ই একদিন ‘মিলনের বাঁশী’ বাজবে। 

‘বিদ্রোহী’ কবিতায় নজরুল খোদ ভগবানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। বিরাজমান অসাম্য, অবিচার, অন্যায় ও দারিদ্র্যের জন্য তিনি ভগবানের খেয়ালিপনাকে দায়ী করেন এবং তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করতে উদ্যত হন। দরিদ্র মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং এই অসাম্যজনিত দারিদ্র্যের অবসান ঘটানোর প্রেষণা কতটা গভীর হলে একজন কবির কবিতায় বিদ্রোহের এমন দামামা বাজে, বহুপ্রজন্ম পরে আজ এই একবিংশে সে কথা ভাবি আর শিহরিত হই।

মুজাফফর আহমদের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়, সখ্য ও বসবাস একটি বিশেষ ঘটনা, বাঙালির ইতিহাসেরই একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সাধারণ মানুষের প্রতি নজরুলের ভালোবাসা, দেশপ্রেম ইত্যাদি সাম্যবাদী চেতনায়, বিপ্লবী ধারায়, সর্বহারার রাজনীতিতে প্রবাহিত হয় মুজাফফর আহমদের সান্নিধ্যে এসেই। বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজাফফর আহমদ কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন নজরুলের কবি হয়ে ওঠা, সাম্যবাদী হিসেবে বেড়ে ওঠা।  কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা শিরোনামে যে বই তিনি লিখেছেন, তার মধ্যে তাঁর অদেখা অতীত জীবনের অনেক ঘটনা উল্লেখ করেন।

ক্লাসে ছাত্রদের মধ্যে সব সময় প্রথম হওয়া সত্ত্বেও দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়ই তাঁর যুদ্ধে যাওয়ার ঘটনাকে, ‘ম্যাট্রিকুলেশন পাসের চেয়ে দেশপ্রেমকেই উচ্চাসন দিয়েছেন নজরুল’ বলে মন্তব্য করছেন মুজাফফর আহমদ। ‘একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে যে কজন বাঙালি সারা জীবন নিরলস কাজ করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে একেবারে শীর্ষস্থানীয় কাজী নজরুল ইসলাম’—ঐতিহাসিক শুভ বসুর এ কথার সমর্থন মেলে কমরেড মুজাফফর আহমদ যখন বলেন, ‘হিন্দু জমিদার কর্তৃক চালিত স্কুলে বেতন দিতে হতো না নজরুলকে। শুধু তা–ই নয়, তাঁর হোস্টেলের খরচ ও মাসে ৭ টাকা জোগান দেওয়ার ব্যবস্থাও করেন ওই হিন্দু জমিদারেরাই। সম্ভবত এভাবেই নজরুল সমাজে অসাম্প্রদায়িকতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এভাবেই অসাম্প্রদায়িকতার বীজও প্রোথিত হয় তাঁর মনের গভীরে।’

প্রথমত, সেনাবাহিনীর ‘বেঙ্গলি ডবল কোম্পানিতে যোগদান করার যে ডাক নজরুলের কানে পৌঁছেছিল, সেটা তাঁর নিকটে ছিল দেশপ্রেমের আহ্বান।’ আবার ‘তিনি ফিরেও এসেছিলেন দেশপ্রেমে ভরপুর হয়ে।’ এর আগে সিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলের শিক্ষক, সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের পশ্চিম বঙ্গীয় দলে অর্থাৎ যুগান্তর দলের সঙ্গে যুক্ত নিবারণচন্দ্রের মতবাদের দিকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন নজরুল, সম্ভবত ১৯১৭ সালের দিকে। এদিক থেকে বলা যায়, নজরুলের সাম্যবাদের দীক্ষাগুরু, তাঁর শিক্ষক নিবারণচন্দ্রই।

দেশপ্রেমে ভরপুর হয়ে ফিরে আসার প্রমাণ পাই আমরা যখন তাঁর সাহিত্য ও কর্মতৎপরতার দিকে তাকাই। নজরুল এতটা জনপ্রিয় কীভাবে হলেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুজাফফর আহমদ লিখেছেন, ‘তাঁর গান ও কবিতার আবৃত্তি শোনার জন্য চটকলের বাঙালি মজুরেরা তাঁকে ডেকেছে। পরে কৃষকদের ভেতরেও বক্তৃতা দিয়েছে। এভাবে তিনি পৌঁছেছেন জনগণের মধ্যে। এই জন্যই বাংলা দেশের কবিদের মধ্যে নজরুল সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কবি হতে পেরেছিলেন। আজও কারখানার মজুরেরা তাঁর জন্মদিন পালন করেন।’

১৯২০ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে নবযুগ–এ ‘ধর্মঘট’ শিরোনামে যে লেখাটি তিনি লেখেন, তা থেকে বোঝা যায় মেহনতি মানুষের প্রতি তাঁর কতটা আকর্ষণ ছিল। তিনি লিখেছেন: ‘চাষী সমস্ত বছর ধরিয়া হাড়ভাঙা মেহনত করিয়া মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়াও দু-বেলা পেট ভরিয়া মাড়-ভাত খাইতে পায় না,…অথচ তাহারই ধান-চাল লইয়া মহাজনেরা পায়ের ওপর পা দিয়া বারো মাসে তেত্রিশ পার্বণ করিয়া নওয়াবি চালে দিন কাটাইয়া দেন। কয়লার খনির কুলিদিগকে আমরা স্বচক্ষে দেখিয়াছি, তাহাদের কেহ ত্রিশ–চল্লিশ বৎসরের বেশি বাঁচে না…কোম্পানি তাদের দৌলতে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করিতেছে…’

নজরুলের জীবন থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো ব্যক্তিজীবনের আঘাত থেকে সমষ্টির জীবনে ফিরে আসা, খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্য ফেরানোর কাজে যোগ দেওয়া।

মুজাফফর আহমদের ভাষ্যমতে, ‘আলী আকবর খান ও তাঁর ভাগনি সৈয়দা খাতুনের (নজরুল যাঁর দিয়েছিলেন নার্গিস) দ্বারা আহত, প্রতারিত ও অপমানিত হয়ে কুমিল্লায় ফিরে এসে ছয় মাস প্রায় না লেখার পরে তাঁর কলম হতে আবার কবিতা বইতে লাগল ঠিক যেন পাগলা ঘোড়ার স্রোতের মতো। কিন্তু হতাশ প্রেমিকের কবিতা নয়,—নতুন জীবনের গান, শিরদাঁড়া সোজা করে উঠে দাঁড়ানোর গান।’ এই শিক্ষা আমরা রবীন্দ্রনাথ থেকেও পাই—এমনকি প্রেমের উপন্যাসেও। শেষের কবিতার নায়ক বলছেন, ‘আমার রয়েছে কর্ম, রয়েছে বিশ্বলোক, ফিরিবার পথ নাই।’

রবীন্দ্রনাথ নিজে বিপ্লবী হতে পারেননি বা হতে চাননি। তবে তিনি একজন বিপ্লবীর আবির্ভাব কামনা করেছিলেন একান্তভাবে। তিনি এমন একজন বিপ্লবীর আবির্ভাব চেয়েছিলেন, যিনি ভারতের খোলনলচে পাল্টে দেবেন। একজন বিপ্লবীর জীবন কেমন হবে, কী রকম ত্যাগ স্বীকার করতে হবে তাঁকে, তা তিনি জানতেন। সে জন্যই সেই কাঙ্ক্ষিত বিপ্লবীকে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন কবিতায়, এভাবে:

ঘরের মঙ্গলশঙ্খ নহে তোর তরে,

নহে রে সন্ধ্যার দীপালোক,

নহে প্রেয়সীর অশ্রু-চোখ।

…………

পথে পথে কণ্টকের অভ্যর্থনা,

পথে পথে গুপ্তসর্প গূঢ়ফণা।

নিন্দা দিবে জয়শঙ্খনাদ

এই তোর রুদ্রের প্রসাদ।

তবে কি রবীন্দ্রনাথ নজরুলের অপেক্ষায়ই ছিলেন? নজরুল তাঁর শেষ বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে যখন বলেন, ‘দ্যাখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীটসের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডী আছে, তুই প্রস্তুত হ’, তখন তা-ই মনে হয়।

১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তী উৎসব অনুষ্ঠানে, জীবনের শেষ বক্তৃতায়,  যে মর্মস্পর্শী কথাগুলো উচ্চারণ করেন, তার মধ্যে আছে অভিমান, আছে জীবনদর্শন, ‘পৃথিবীতে আগমনের’ কারণ ও বিদ্রোহের কারণের ব্যাখ্যা। তিনি বলছেন, ‘কেউ বলেন আমার বাণী যবন, কেউ বলেন কাফের। আমি বলি, ও দুটোর কোনোটাই নয়। আমি কেবলমাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি; গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’

বিদ্রোহের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নজরুল বলছেন, ‘আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা-কলুষিত-পুরাতন-পচা, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে। ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।’

এরপর সীমাহীন অভিমান নিয়ে নিচের কথাগুলো নজরুল যখন উচ্চারণ করেন, তখন আমরা অশ্রুসিক্ত হই:

‘যদি আর বাঁশী না বাজে,…বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি। আমি নেতা হতে আসিনি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী হতে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’

বক্তৃতা শেষের কবিতাটাই যে কবির শেষজীবনের গান হয়ে উঠবে, তা কে জানত!

‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,

কোলাহল করে সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না।

নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।’

  • ড. এন এন তরুণ ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। ই–মেইল: [email protected]