পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ভেতরে টালমাটাল অবস্থা

বহু বছর ধরেই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। যদিও নিয়মিত বিরতিতে তারা নির্বাচিত সরকারের গদি উল্টে দিয়েছে, তারপরও বহু পাকিস্তানি এখনো মনে করেন যে রাজনীতিকেরা যে তালগোল পাকান, তা থেকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র সেনাবাহিনীই। দেশের অখণ্ডতা অটুট রাখতে সেনাবাহিনীর কোনো বিকল্প নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, জেনারেলরা এখন নিজেদের মধ্যে বন্ধন অটুট রাখতে পারবেন কি না।

জনতুষ্টিবাদী নেতা ইমরান খান রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ নিয়ে সেনাবাহিনীকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করায়, তারা বেশ বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে পড়েছে। উত্তরে সেনাবাহিনীও ইমরান খানকে শুধু ক্ষমতা থেকেই সরিয়ে দেয়নি, তাঁকে জেলেও পুরেছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে খানের দল বেশির ভাগ আসনে জিতলেও বেসামরিক সরকার গঠনে তাদের বাধা দেওয়া হয়েছে। তার বদলে সেনাবাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট একটি সরকার ক্ষমতায় বসেছে। গোটা দেশ এখন গভীরভাবে বিভক্ত।

কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল সাঈদ আসিম মুনির আরও বেশি উদ্বিগ্ন। কারণ, এই দ্বিধাবিভক্তি এখন সেনাবাহিনীতেও ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছে। পাকিস্তানের জনমনে এমনকি রাজনৈতিক মহলেও এমন আলোচনা আছে যে সেনা নেতৃত্বের একাংশ প্রভাবশালী সেনা পরিবার ও সাধারণ কর্মকর্তারা খানের দক্ষিণপন্থী আমেরিকাবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি এবং চীন ও রাশিয়ার দিকে যে ঝোঁক, তার প্রতি সহানুভূতিশীল। অভ্যন্তরীণ এই বিরোধ প্রশমনের ওপর নির্ভর করছে পারমাণবিক অস্ত্রধারী ও বিশ্বের পঞ্চম ঘনবসতিপূর্ণ দেশটির স্থিতিশীলতা।

আগামী বছরের নভেম্বরে জেনারেল মুনিরের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। অনেক কর্মকর্তার আশা, তাঁর উত্তরসূরি ইমরান খানের প্রতি তিনি বেশি সহানুভূতিশীল হবেন। অনেকেই মনে করেন যে ইমরান খানের সঙ্গে জেনারেল মুনিরের যে বিরোধ, তা ব্যক্তিগত। মুনিরের মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচন হবে এবং খান আবার রাজনৈতিক মঞ্চে ফিরবেন। এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়।

এই বিভক্তিও এমন একটা সময়ে হলো, যখন পাকিস্তানের অবস্থা শোচনীয়, অর্থনীতি ডুবতে বসেছে এবং জেনারেল মুনির ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পাকিস্তান এখন সব দিক থেকে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।

একদিকে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা নরেন্দ্র মোদি ও অন্যদিকে আফগানিস্তানিস্তানের তালেবান শাসন ও ইরান। ইরান গত জানুয়ারিতে পাকিস্তানকে নিশানা করে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তানও ওই হামলার জবাব দেয়। এই মাসে, পাকিস্তানি সেনাচৌকিতে পৃথক জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে দেশটির দক্ষিণ দিকের আফগানিস্তানিস্তান সীমান্তে।

দেশের এই শোচনীয় অবস্থার দায় অনেকটাই বর্তায় সেনাবাহিনীর ওপর। ২০০৮ সালে দশকব্যাপী চলা জেনারেল পারভেজ মোশাররফের শাসনামল শেষে, পাকিস্তান একটা ভঙ্গুর গণতন্ত্রে ফিরে যায়। কিন্তু সেনা নেতৃত্বের ভয় ছিল যে দুটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ—নেওয়াজ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি সামরিক বাহিনীর প্রভাবে রাশ টেনে ধরতে চাইছে।

আরও পড়ুন

জেনারেলরা অন্য এক ধরনের চাপের মুখেও পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ২০০৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অর্থসহায়তা করায় কিছু শর্ত বেঁধে দেয়। দুই বছর পর ওসামা বিন লাদেন নিহত হন। ওই বছরের শেষ দিকে, ন্যাটো ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে আফগানিস্তান সীমান্তে দুর্ঘটনাক্রমে যুদ্ধ শুরু হয় এবং এতে ২৮ জন পাকিস্তানি নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বকে হুমকিতে ফেলতে ষড়যন্ত্র করছে, এমন একটা কথাও সে সময় চাউর হয়।

এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে সেনা নেতৃত্ব রাজনৈতিক অংশীদার খুঁজছিল। তাই তারা সাবেক ক্রিকেট তারকা থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরান খানের সঙ্গে জুটি বাঁধে। ইমরান খান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সরকারের সমর্থক এবং বংশীয় রাজনৈতিক দলের চরম বিরোধী ছিলেন। এসব দল দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, এমন ধারণাই পোষণ করে তিনি। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে উল্টো।

২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েই পাকিস্তানিদের তাতিয়ে তুললেন খান। তিনি প্রচলিত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ও আমেরিকার প্রভাবকে প্রত্যাখ্যান করে বসলেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছানোর পর দেশের মানুষ বলতে শুরু করেন যে খান অর্থনীতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারছেন না।

এদিকে খান দাবি করেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেনাবাহিনী তাঁকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। অর্থনৈতিক সমস্যার সঙ্গে রাজনৈতিক সংকট মিলেমিশে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। পেছন থেকে সেনাবাহিনী কলকাঠি নাড়ে এবং সংসদে অনাস্থা ভোটে ২০২২ সালের এপ্রিলে ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হন।

আরও পড়ুন

গত বছরের মে মাসে যখন দেশটির উচ্চ আদালত খানকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়, তখন তাঁর সমর্থকেরা প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, রাস্তায় নেমে আন্দোলন শুরু করেন এমনকি সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও সেনা স্থাপনায় হামলাও চালান।

গত মাসে নির্বাচনের আগে আগে খানের দল যেন জিততে না পারে, সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় সেনাবাহিনী। দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় গোপনীয় তথ্য প্রকাশের অভিযোগে নির্বাচনের আগে তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হন। তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ফলে তাঁর দলের প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে ব্যর্থ হন।

কিন্তু খানের বার্তা ও জেনারেলদের অদূরদর্শিতাকে ঘিরে সৃষ্ট ক্ষোভ জারি থাকে। পিটিআই–সমর্থিত প্রার্থীরা সংসদের বেশির ভাগ আসন জিতে নিয়ে সেনাবাহিনীকে চমকে দেন। সেনাবাহিনী নানা কৌশলে জোট সরকারের বাইরে রাখে খানের দলকে। অথচ ক্ষমতাসীন জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফসহ এই জোটের অন্য অংশীদার হিসেবে যাঁরা আছেন, তাঁদের কোণঠাসা করতেই একসময় সেনাবাহিনী আসলে ইমরান খানের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল।

ভঙ্গুর অর্থনীতি ও নিরাপত্তার এই দেশে সরকারের কাছে নতুন চ্যালেঞ্জ হলো, দেশটির বেশির ভাগ মানুষ তাদের ভোট চোর মনে করছেন। যদিও এই সরকারকে সামরিক বাহিনী এতটাই সমর্থন দিচ্ছে, যা তাদের সুনাম রক্ষার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু নিজেদের অন্দরমহল টিকিয়ে রাখাই এখন সেনাবাহিনীর জন্য জরুরি।

সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা জেনারেল মুনিরকে অনুরোধ করছেন ইমরান খানের ব্যাপারে সদয় হতে। খানের পক্ষে আয়োজিত আন্দোলনে কয়েকটি সেনা পরিবার সরাসরি অংশও নিয়েছে।

জেনারেল মুনির এই আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলার চেষ্টা করছেন যে মে মাসের সহিংস হামলা সরাসরি সামরিক বাহিনীকে নিশানা করে সংঘটিত। জেনারেল মুনির সেনাবাহিনীর ভেতরও ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমনের চেষ্টা করেছেন, যেন এই ক্ষোভ খুব বেশি প্রসার না পায়।

হয়তো আপাতত জেনারেল মুনির তাঁর উদ্দেশ্যে সফল হবেন, কিন্তু এই গল্পের এখানেই শেষ নয়।

আগামী বছরের নভেম্বরে জেনারেল মুনিরের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। অনেক কর্মকর্তার আশা, তাঁর উত্তরসূরি ইমরান খানের প্রতি তিনি বেশি সহানুভূতিশীল হবেন। অনেকেই মনে করেন যে ইমরান খানের সঙ্গে জেনারেল মুনিরের যে বিরোধ, তা ব্যক্তিগত। মুনিরের মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচন হবে এবং খান আবার রাজনৈতিক মঞ্চে ফিরবেন। এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম নয়।

পর্দার পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে বহিষ্কৃত নেতাদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে আগেও। প্রধানমন্ত্রী শরিফের ভাই নেওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে উৎখাত করা হয়েছে তিনবার। তিনি দু-দুবার নির্বাসনে গেছেন। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ঠিক আগে তিনি ফেরেন এবং তাঁর ভাইয়ের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছে, তাতে প্রভাব বিস্তার করবেন বলে ধারণা করা হয়।

পাকিস্তানের বিপদের আশঙ্কাটা ঠিক এই জায়গায়ই। খান সেনাবাহিনীতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ কিংবা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপস করতে রাজি নন।

অনেকেরই আশঙ্কা, এত প্রতিহিংসা নিয়ে খান কী করে পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেবেন! আবার ওদিকে মুনির যদি তাঁর মেয়াদ বাড়িয়ে নেন, তাহলে এই অচলাবস্থা জারি থাকবে।

কিছুদিনের জন্য সেনাবাহিনীর মধ্যে ঐক্য হয়তো থাকবে। কিন্তু সেনাবাহিনীর ভ্রাতৃত্ববোধে চিড় ধরেছে। পাকিস্তানের জেনারেলরা যদি খানের সঙ্গে বিরোধ মেটাতে না পারেন, তাহলে দেশের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

আয়েশা সিদ্দিকা কিংস কলেজ লন্ডনের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও লেখক।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস–এ প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনূদিত।