সংস্কার কমিশনগুলো এই মাসের শেষেই ইউনূস সরকারের হাতে তাদের সংস্কারের সুপারিশমালার প্রতিবেদন জমা দেবে। সরকার সেটা বাস্তবায়ন কীভাবে করবে সেই প্রশ্ন এখন সবার মাথায়।
সাংবিধানিক ইতিহাস বলে যে সংস্কার বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলির সমর্থন। সমস্যা হচ্ছে মাঠে আওয়ামী লীগ না থাকায় পেশাদার রাজনৈতিক দলগুলো চাইবেই যে যত তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিয়ে তাদের যেন ‘খোলা মাঠে’ গোল দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়। সে জন্যে সংস্কারের আলাপ আসলেই তারা অনির্বাচিতদের হাতে সংস্কার করার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
যে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি কার্যকর সেখানে এই সংবিধান সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয় তার সংসদের ওপর বা নির্বাচিত গণ পরিষদের ওপর। অন্যদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বিপ্লবীরাই নতুন সংবিধান তৈরি করে নেয়। অন্য কারও তোয়াক্কা করার বাসনা তাদের থাকে না।
আমাদের দেশের অবস্থা এই দুই এর মধ্যে। ছাত্র–জনতা অভ্যুত্থান করে স্বৈরাচার বিদায় করেছে কিন্তু অভ্যুত্থান ঘটানো শক্তি নিজে রাষ্ট্রের দায়িত্বে নাই বলে তারা নিজেরাই একটা নতুন সংবিধান লিখে ফেলতে পারছে না। অন্যদিকে গণপরিষদ নির্বাচন করলে যে সম্ভাব্য রাজনৈতিক শক্তিগুলো সংবিধান তৈরির দায়িত্ব পাবে তারা সবাই স্বৈরাচারী ক্ষমতা চর্চার দোষে দুষ্ট বলে, কোনোভাবেই যে তারা অভ্যুত্থানকারীদের সংস্কার আকাঙ্ক্ষাকে পূরণ করতে পারবে না, সেটাও পরিষ্কার।
এই দুই পক্ষের সংঘাত এড়াতে সে জন্যে আমাদের বিকল্প খুঁজতে হচ্ছে। একটা সমাধান হতে পারত যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেই আমাদের একটা সংবিধান উপহার দিত। তাদের বায়োডাটা বলে যে তারা একটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংবিধান আমাদের উপহার দিতে পারে। সমস্যা হলো সংবিধান একটা জন আকাঙ্ক্ষার দলিল। এই দলিলের ন্যায্যতার বিচারের চাইতে এর পেছনে জাতীয় ঐক্য হওয়াটা অনেক বেশি জরুরি। জাতীয় ঐক্য না আনতে পারলে সংবিধানকে কেন্দ্র করেই দেশ বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে।
অতএব সংস্কার প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে তার সমাধান বের করা প্রয়োজন।
বৈধতার তিনটা স্তর: ১. খসড়া তৈরির বৈধতা ২. চূড়ান্ত সংস্করণ তৈরির বৈধতা ৩. সংবিধান অনুমোদন দেওয়ার বৈধতা
ইউনূস সরকার অভ্যুত্থানের শক্তির সম্মতিতে ক্ষমতায় এসেছে বিধায় এই সরকার বৈধ। বৈধ সরকারের গড়া সংবিধান কমিশন যে খসড়া আমাদের দেবে সেটাও একই যুক্তিতে বৈধ। সংবিধান নিয়ে সমঝোতায় আসতে এই খসড়া অনেক কাজে দেবে।
দ্বিতীয় ধাপে চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করার আলাপে দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ অংশের প্রতিনিধি থাকা অত্যাবশ্যক। রাজনৈতিক দল, শ্রমজীবী, চিন্তাবিদ, ব্যবসায়ী, সমাজকর্মী, ধর্মানুরাগী, অবাঙালি, সংখ্যালঘু, পেশাজীবী সবাইকে নিয়েই সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবে সমঝোতায় আসতে পারলেই আমরা পাব জাতীয় ঐক্য। এই সমঝোতা কমিশনে সকল গুরুত্বপূর্ণ পক্ষের উপস্থিতি থাকায় এর গণসমর্থন হবে নিরঙ্কুশ এবং তার বৈধতা হবে প্রশ্নাতীত।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সমঝোতা কমিশন তৈরি করে আলাপের সহায়ক ভূমিকায় থাকবে।
সমঝোতা কমিশন, সংবিধান কমিশনের খসড়াকে সামনে নিয়ে আলাপ শুরু করবে। সকলে মিলে সকল পক্ষের আকাঙ্ক্ষা এবং আপত্তি নিয়ে যুক্তি তর্কের মাধ্যমে সম্মিলিত ভাবে তারা জাতির সামনে একটা চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরবে।
চূড়ান্ত প্রস্তাব যেহেতু সংবিধানের একটা নতুন পাঠ নাগরিকদের অনুমোদন ছাড়া আর বাস্তবায়ন অগণতান্ত্রিক। নাগরিকেরা রাষ্ট্রের মালিক বিধায় তারাই সংবিধান অনুমোদন দেওয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতাসীন পক্ষ। তৃতীয় স্তরে সে জন্যে গণভোটের মাধ্যমে এই দেশের নাগরিকরাই সমঝোতা কমিশনের চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাবে অনুমোদন দেবে। গণভোটের মাধ্যমে পাওয়া এই অনুমোদনের বৈধতা হবে নিরঙ্কুশ।
বৈধ প্রক্রিয়ায় তৈরি আমাদের সংবিধানের নতুন পাঠে নির্দেশিত পথে সরকার গঠনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন যুগের সমাপ্তি টানবেন।
সৈয়দ হাসিবউদ্দীন হোসেন রাজনৈতিক কর্মী, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন