যাদের মাতৃভাষায় ‘শোষণ’ শব্দের কোনো প্রতিশব্দ নেই, সেই মুন্ডাদের জীবনে শোষণ আর বঞ্চনা যে কত গভীর, তা দেখতে হলে যেতে হবে সুন্দরবনের ধারে ওদের গ্রামে। ইউনিয়নের নাম ঈশ্বরীপুর। থানার নাম শ্যামনগর। এখানে মুন্ডাপাড়া আছে সাতটি। একটি গ্রামের নাম অন্তাখালী। জেলা সাতক্ষীরা। একটু দূরে সুন্দরবন। বয়ে চলা নদীটির নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি নীলিমা মুন্ডা, কল্যাণ ব্যানার্জী, শম্পা গোস্বামী বা কৃষ্ণপদ মুন্ডাকে। যদি বেঁচে থাকি, আবার কোনো দিন যদি ওখানে যাই, জেনে নেব ওই নদীর নাম। দুঃখ আর মায়া—দুই অনুভূতি হয়েছে এখানে এসে।
নদীটি চলে গেছে সুন্দরবনের অনেক ভেতরে। জোয়ার-ভাটার খেলা চলে এখানে প্রতিদিন। যখন ব্রিটিশ ছিল না, পাকিস্তানের জন্ম হয়নি, তারও বহু বহু বছর আগে থেকে এই সুন্দরবন অঞ্চলে বসতি গড়ে তুলেছিলেন এই মুন্ডা জাতি। সুন্দরবনের ভেতর মাছ ধরা, কাঁকড়া ধরা ছিল তাদের জীবিকার অবলম্বন। তারপর ধীরে ধীরে এখানে বাইরের মানুষ চলে আসে। ওদের ‘মুন্ডারী’ ভাষায় ‘শোষণ’ শব্দের কোনো প্রতিশব্দ নেই। অথচ কি পরাধীন, কি স্বাধীন—সব আমলে তারা হয়েছে শোষণে, অবিচারে, অপমানে জর্জরিত। ওদের সব জমি তারা হারিয়ে ফেলেছে। অনেকে চলে গেছেন দেশান্তরে। আজ এতকাল পর, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে তারা পরিণত হয়েছে বিলুপ্তপ্রায় একটি জাতিতে। অথচ ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে এই মুন্ডা আর সাঁওতালদের ছিল বিশাল ভূমিকা।
২.
আপনি যদি একটু সংবেদনশীল হৃদয়বান মানুষ হন, তবে এই গ্রামে এলে আপনার মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হবে। কোমল মনের মানুষ হলে অজান্তে আপনার চোখে জল ঝরবে। ২৯ আগস্ট ২০২২ বিকেলে সুলতা মুন্ডা, রিনা মুন্ডা আর বিলাসী মুন্ডাদের সঙ্গে কথা বলার পর রাতে হোটেলে ফিরে আমি আর ঘুমাতে পারিনি। আপনি যদি অসংবেদনশীল ও হৃদয়হীন মানুষও হন, তারপরও আপনি ব্যথিত হবেন এই মুন্ডাদের অসহায়ত্ব দেখে। আকাশপানে তাকিয়ে আপনি হয়তো অশ্রু লুকানোর চেষ্টা করবেন। এতটাই করুণ এই মানুষদের অবস্থা। এই ধুমঘাট এলাকায় ওদের জনসংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৭৬৪ জন। নারী-পুরুষ মিলে। আর শিশু আছে ২৩২ জন। এত বড় বাঙালি জাতি আর ১৬ কোটি মানুষের দেশে এই অল্পসংখ্যক মানুষের মুখে আমরা হাসি ফোটাতে পারি না, এ কথা কী করে মানব আমরা?
৩.
এখানে এসে জেনেছিলাম, মুন্ডাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। তাহলে কেন আজ এমন হলো? তখনো গোধূলির সময় হয়নি। আমাদের জন্য অন্তাখালীর মুন্ডাপাড়ার মানুষ অপেক্ষা করছিলেন। মূল রাস্তায় গাড়ি রেখে কিছুদূর হেঁটে রওনা দিয়েছি। ছোট রাস্তা। বৃষ্টি হলে কাদায় সয়লাব হয়ে যায়। আইলাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে এ অঞ্চলের মানুষ সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। পাড়ার একটু দূরে চারদিকে খেতের মধ্যে অথই পানি আর মাঝখানে একটি সমাধি, কবর। দূর থেকে মনে হবে চারপাশে পানিতে যেন ভাসছে এক টুকরো মাটি। এই ভূমির জন্য লড়তে গিয়ে জীবন দিয়েছেন ২০ আগস্ট নরেন্দ্রনাথ মুন্ডা। গ্রামে পৌঁছে দেখলাম নরেন্দ্রনাথের পাঁচ সন্তান মুন্ডাদের সামাজিক-ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সাদা থান ধুতি পরে, খালি গায়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন ‘দশাকামা’ আয়োজনের জন্য। দেখলাম চুল কামানো মাথায় বিমর্ষ ভগ্ন, বিধ্বস্ত সনাতন মুন্ডা, মনোরঞ্জন মুন্ডা, লক্ষ্মীনন্দন মুন্ডা, কৃষ্ণপদ মুন্ডা ও হরিপদ মুন্ডাকে। বহুকালের অবিচার ও বঞ্চনা, বহু অপমান আর দুঃখে যেন ধীরস্থির ওরা। সব যেন নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়ে ‘দশাকামা’ অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হয়েছেন। ওদের পিতা নরেন্দ্রনাথকে ১০ দিন আগে হত্যা করা হয়েছে। ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মূল আসামিরা কেউই এত দিনে গ্রেপ্তার হননি। ২২ জন আসামির মধ্যে মাত্র চারজন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
যাঁরা জিডিপির হিসাব করেন, মাথাপিছু আয়ের গল্প বলে আমোদিত হন, তাঁরা কি রিনা মুন্ডাদের কথা একটুও ভাবেন? কেউ কি কখনো প্রশ্ন করে—রিনা মুন্ডার পাঁচ সদস্যের সংসারে সরকারি হিসাবে মাথাপিছু আয় ১৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা কীভাবে হয়? কী নিষ্ঠুর পরিহাস দেশের নাগরিকদের সঙ্গে।
৪.
অনেক আশা নিয়ে ঢাকায় ফিরে আমরা সংবাদ সম্মেলন করেছি, যেখানে মানবাধিকারনেত্রী সুলতানা কামাল বলেছেন, রাষ্ট্র বারবার মানবাধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে। তিনি অবিলম্বে নরেন্দ্রনাথের হত্যায় জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তারের আহ্বান জানান। আমরাও আশা করব, পুলিশ প্রশাসন আরও সক্রিয় হবে এবং নিজেদের ব্যর্থতার দায় ঘোচাতে বাকি আসামিদের গ্রেপ্তার করবে।
রিনা মুন্ডা জীবনে প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন। ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে শ্বশুর হত্যার বিচারের দাবিতে। দুপুরে রওনা দিয়ে অনেক রাতে ঢাকায় পৌঁছান তিনি। সংবাদ সম্মেলন শেষেই ফিরে যাবেন শ্যামনগরের অনিশ্চয়তায় ভরা জীবনে। দুঃখ ভোলানোর জন্য তাঁর প্রথম দেখা পদ্মা সেতুর কথা তুললাম। এত সুন্দর সেতু তিনি পার হয়েছেন রাতের আলোয়। বেলা থাকতে পদ্মা সেতু পার হয়েই ফিরে যাবেন। রিনা মুন্ডার মধ্যে কোনো ভাবাবেগ, আনন্দের লেশমাত্র দেখলাম না। বললেন, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যেতে হবে। সেখানে প্রতিবন্ধী এক ছেলে আছে। শ্বশুর ছেলেটিকে যত্ন করতেন। তিনি আর নেই। কীভাবে যে জীবন যাবে, সেই ভাবনায় এই শহর ছাড়তে পারলে তিনি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। যাঁরা জিডিপির হিসাব করেন, মাথাপিছু আয়ের গল্প বলে আমোদিত হন, তাঁরা কি রিনা মুন্ডাদের কথা একটুও ভাবেন? কেউ কি কখনো প্রশ্ন করে—রিনা মুন্ডার পাঁচ সদস্যের সংসারে সরকারি হিসাবে মাথাপিছু আয় ১৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা কীভাবে হয়? কী নিষ্ঠুর পরিহাস দেশের নাগরিকদের সঙ্গে।
৫.
আমরা এমন এক রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা চেয়েছিলাম, যেখানে নাগরিকদের মান-মর্যাদার চেয়ে ক্ষমতার দম্ভ, উন্নয়নের অহংকার, অর্থ সম্পদের সীমাহীন লোভ ও লালসা কখনো বড় হয়ে দেখা দেবে না। ওই গানওয়ালার কথামতো ‘ফাটকাবাজির দেশে’ মানুষের সব মানবিকতা ভূলুণ্ঠিত হবে না। এই অপরিণামদর্শী বৈষম্যপূর্ণ উন্নয়ন চিন্তা থেকে সরে আসবে মানুষ। সুন্দরবনসহ সব নদী, বন, পাহাড়, জল, বাতাস, জীববৈচিত্র্য সব ধ্বংস করে এগিয়ে চলার চিন্তা বিসর্জন দিয়ে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের কথা বলবে সবাই।
আজ আমার আর কোনো রাগ নেই। আগের মতো আর লেখাও যায় না। কেন যায় না, সেই উত্তরও কারও অজানা নয় আশা করি। তবু মুন্ডাদের যেভাবে দেখে এসেছি, আমি বিনীতভাবে চাই, ওদের প্রতি রাষ্ট্রের যেন একটু দয়ামায়া হয়। অনেকে হয়তো বলবে, এটি তো দয়ার বিষয় না, এটি মৌলিক মানবাধিকারের প্রশ্ন। তারপরও বলব, মুন্ডাদের জন্য আমি আজ শুধু দয়াই চাইছি। তবু ওরা ভূমির অধিকার ফিরে পাক অন্তত যেটুকু জমি এখনো ওদের হাতে আছে। ওরা যেন আর দেশান্তরের চিন্তা না করেন। ওদের পূজা-পার্বণে ওরা যেন একটু প্রাণ খুলে আনন্দ করতে পারেন। ওদের এই ২৩২ জন শিশু যেন বড় হয়ে একটু মর্যাদা পায়। যখন ফিরে আসি বাগেরহাট-গোপালগঞ্জ হয়ে, পথের দুধারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের সারি সারি ঘর দেখি। নিশ্চয় আমাদের ফেলে আসা মুন্ডাপল্লির মানুষেরাও একদিন শিগগিরই কয়েকটি ঘর পাবেন। ওদের চেয়ে অসহায় মানুষ কে আছে?
সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী। ই-মেইল: [email protected]