আবারও মৃত্যুর মিছিল: আমরা ভুলে যাই, মায়াকান্নায় প্রতিকারও হারিয়ে যায়

দুর্ঘটনার পর সন্তানের খোঁজে হাসপাতালে ছুটে যান অভিভাবকেরাছবি: সাজিদ হোসেন

২১ জুলাই আমাদের জন্য এমন এক অবর্ণনীয় শোক নিয়ে এল, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উত্তরা শাখার দোতলা স্কুল ভবনে আছড়ে পড়া বিমান এখন পর্যন্ত কেড়ে নিল পাইলটসহ অনেকগুলো প্রাণ, যার প্রায় সবাই শিশু। আরও বহু শিশু হাসপাতালের বিছানায় পোড়া শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছে।

অনেক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা আমরা দেখেছি। বিগত সরকারগুলোর নানা দমন-পীড়ন আমরা দেখেছি। আমাদের চোখের সামনে কত সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীকে হারিয়ে যেতে দেখেছি। কিন্তু এমন করে ছোট ছোট শিশুকে আকুতি নিয়ে চলে যেতে দেখিনি।

যতবার আমি এই শিশুদের কথা ভাবি, তাদের মা–বাবার কথা ভাবি, কেবলই আমার সন্তানদের ছবি চোখের সামনে ভাসতে থাকে। আমার অসহায়ত্বের কথা ভাবতে থাকি।
দিন দিন নিজেকে এতটা অসহায় লাগে এই ভেবে যে দেশটাকে একটি নিরাপদ স্থান হিসেবে আমরা এখনো গড়ে তুলতে পারলাম না।

আমাদের সন্তানদের কোথায় রেখে যাচ্ছি। বিগত দিনের সীমাহীন দুর্নীতি, অর্থ পাচার, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামোকে একদম ভঙ্গুর করে ফেলেছে, যা আমাদের একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।

স্বাধীনতার এত বছর পার হলেও এখানে যে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা, তা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। এমনকি আপৎকালীন সময়ের যথাযথ মোকাবিলা করতেও আমাদের হিমশিম খেতে হয়।

আমরা সব সময় বিপদ এলে তখনই তা নিয়ে কথা বলি, তার প্রতিকার নিয়ে কথা বলি; কিন্তু সেই আপৎকালীন সময় চলে গেলে সবাই যেন সবকিছু ভুলে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। টেকসই ব্যবস্থার কথা আমাদের মনোযোগ থেকে হারিয়ে যায়।

দুর্যোগ মোকাবিলা কিংবা আপৎকালীন সময়ের ব্যবস্থাপনার জন্য রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের যে প্রস্তুতি, সেটি কি আমরা আগে থেকে ভাবি? যখনই কোনো আপৎকালীন সময়ের মধ্য দিয়ে যাই, তখনই আমরা নানা রকম প্রতিশ্রুতি পেতে থাকি; যেমন এখন পাচ্ছি—‘আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য বিদেশ থেকে চিকিৎসক আনা হবে।’

দিনের পর দিন এত এত মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে আমাদের অনুভূতিগুলো হয়তো ভোঁতা হয়ে গেছে। তাই হয়তো আমরা কোনো টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি না। মায়াকান্নার বেড়াজালেই আমাদের প্রতিকার হারিয়ে যায়। এমনই যখন ব্যবস্থা, তখন এ ধরনের বিপদ ও দুর্ঘটনাকে কি আমরা স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স বলতে পারি না? যেখানে রাষ্ট্রের দায় সরাসরি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে? আর কতকাল এভাবে চলতে থাকবে, সে প্রশ্ন আমরা কোথায় করব, কার কাছে করব?

এমন অনেক প্রতিশ্রুতি আমরা পেয়েছিলাম জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়েও। কিন্তু আমরা জানি কত কত জুলাই যোদ্ধা সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ার জন্য এখনো ভুগছেন। আপৎকালীন সময়ে পাওয়া এমন অনেক প্রতিশ্রুতিই আমরা ধীরে ধীরে ভুলে যাই।

একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা রাষ্ট্রকাঠামোয় না থাকার জন্য এর দায় আমরা কাউকে নিতে ও দিতে দেখি না। কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবার, মা–বাবা কি এসব স্মৃতি কখনো ভুলতে পারবে? আমরা কখনো কি সেই মা–বাবার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভাবি? হয়তো ভাবি না।

দিনের পর দিন এত এত মৃত্যুর মিছিল দেখতে দেখতে আমাদের অনুভূতিগুলো হয়তো ভোঁতা হয়ে গেছে। আর শিগগিরই আমরা সব ভুলে যাই, হয়তো এবারও যাব। তাই হয়তো আমরা কোনো টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারি না। মায়াকান্নার বেড়াজালেই আমাদের প্রতিকার হারিয়ে যায়।

এমনই যখন ব্যবস্থা, তখন এ ধরনের বিপদ ও দুর্ঘটনাকে কি আমরা স্ট্রাকচারাল ভায়োলেন্স বলতে পারি না? যেখানে রাষ্ট্রের দায় সরাসরি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে? আর কতকাল এভাবে চলতে থাকবে, সে প্রশ্ন আমরা কোথায় করব, কার কাছে করব?

আরও পড়ুন

আমরা সব সময় দেখি, দুর্ঘটনার পরপরই তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কত তদন্ত কমিশন আমাদের জীবদ্দশায় দেখেছি, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু কোনো রিপোর্ট আর আমরা দেখতে পাই না। এর দায় যাদের, তাদেরও আর জবাবদিহির আওতায় আসতে হয় না।

কেউ যদি দোষী হয়ে থাকেন, সেটাও আলোচনা থেকে হারিয়ে যায়। এবারও বোধ করি কোনো একটি তদন্ত কমিশন হবে, কিন্তু এবার কি আমরা সেই দুষ্টচক্র ভাঙতে পারব? জুলাই গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী সরকারের কাছে আমাদের সেই প্রত্যাশা থাকবে, অন্তত তারা যেন এর যথাযথ তদন্ত শুরু করে এবং এমন ঘটনা যেন আর না ঘটতে পারে, তার একটি টেকসই ব্যবস্থা যেন নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। প্রতিকারের চেয়ে যেমন প্রতিরোধ উত্তম—আমরা যেন সেদিকে নজর রাখি। আমরা আর কত মৃত্যুর মিছিল দেখব?

স্কুলভবনে বিধ্বস্ত হয় প্রশিক্ষণ বিমান। উদ্ধার কার্যক্রমে বিভিন্ন বাহিনীর তৎপরতা। মঙ্গলবার, উত্তরা।
ছবি: সাজিদ হোসেন

দুর্যোগ ও দুর্ঘটনার ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা আমরা করি; কিন্তু টেকসই ব্যবস্থার জন্য যে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি সেটি অনেকাংশেই অনুপস্থিত থাকে। স্কুলের বাচ্চাদের মৃত্যু আমাদের আবারও সেই দুর্বলতার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা আশা করব, এই অসহনীয় ঘটনার পরে বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক আলাপ শুরু করব।

এ ধরনের দুর্ঘটনা মোকাবিলার কিছু সমস্যা আমরা সব সময় দেখে থাকি, সেটি হলো ঘটনাস্থলে উৎসাহী জনতার ঢেউ, যা সব সময় উদ্ধারকাজে নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। সমাজের মানুষ হিসেবেও আমাদের আরও যৌক্তিক আচরণ করতে হবে। জনগণের অনেকে যেমন নিজ উদ্যোগে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন, আবার অনেকের জড়ো হয়ে থাকার জন্য উদ্ধারকাজ নানাভাবে ব্যাহত হয়।

এ ধরনের গণসচেতনতাও আমাদের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।

উদ্ধারের পরে আসে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যও কাজ করে যেতে হবে। কিছু হলেই বিদেশে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া বা বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতির যে ঐতিহাসিক প্রবণতা, সেটি থেকে পরিত্রাণের জন্য আমাদের নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ যদি এখনো না নেওয়া হয়, তাহলে আর কবে সে বিষয়ে আমরা ভাবব।

শিগগিরই আমরা একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছি, অথচ আমরা যদি আমাদের জনগণের যথাযথ চিকিৎসাসেবা, বিশেষ করে আপৎকালীন চিকিৎসাসেবার নিশ্চয়তা দিতে না পারি, তাহলে সেটা হবে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য একটি চূড়ান্ত ব্যর্থতা। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি।

আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই লিখেছিলাম আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে, সেটি কতটা হয়েছে আমরা জানি না। কিন্তু এই কোমলমতি শিশুদের যারা সারাটি জীবন এ ট্রমা বা মানসিক আঘাত বয়ে বেড়াবে, তার যথাযথ সেবার নিশ্চয়তা আমাদের করতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা একটি উপেক্ষিত বিষয় হলেও আমাদের এ প্রেক্ষাপটে শিশু ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের শিক্ষকদেরও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা, এমন একটি দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া একজন মানুষকে সেই মানসিক আঘাত সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হতে পারে। তাই এর যথাযথ ব্যবস্থাপনা জরুরি।

রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে স্কুলকে এ বিষয়ে যথাযথ সাহায্য নিশ্চিত করতে হবে।
এই দুর্ঘটনার পরপরই অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, এ ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ঢাকার মতো এমন একটি জনাকীর্ণ স্থানে হওয়া কতটা ‍যুক্তিসংগত। এই দুর্ঘটনার পর নিশ্চয় কর্তৃপক্ষ রাজধানী শহরের প্রাণকেন্দ্রে তরুণ বৈমানিকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিয়ে ভাববে।

এর সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন ও আধুনিক প্রশিক্ষণ বিমানের মাধ্যমে তরুণ বৈমানিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে, সেটাও আমাদের প্রত্যাশা থাকবে। তাঁদের নিরাপত্তার কথাও যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

সবশেষে বলব, রাষ্ট্রকে তার জনগণের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা দিতে যা করণীয়, তা করতে হবে। তা বাস্তবায়ন করার জন্য আর বসে থাকার মতো কোনো সময় আমাদের হাতে নেই।

  • বুলবুল সিদ্দিকী নৃবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়