ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বৈধতা দিতে বাধা কোথায়

৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সংসদে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও রিকশা চলাচল বন্ধ করাসংক্রান্ত বিষয়ে সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ঘোষণা করেন, ‘এই ৪০ লাখ থ্রি–হুইলারকে আমি বলি—বাংলার টেসলা।’ ৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় খবরটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে।

পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, টেসলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় বৈদ্যুতিক গাড়ি, যার ওপর ভিত্তি করে পশ্চিমা বিশ্ব অতি দ্রুত জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত যানবাহনের ব্যবহার থেকে মুক্তি পাওয়ার আন্দোলনে শরিক হয়েছে।

নসরুল হামিদ আরও জানান, কত দ্রুত ট্রান্সপোর্ট সিস্টেমকে ইলেকট্রিকে নিয়ে যাওয়া যায়, সে জন্য সারা বিশ্বে একটা বিপ্লব চলছে। তেলচালিত গাড়ির ইঞ্জিনের দক্ষতার মাত্রা ২০ শতাংশ। আর ইলেকট্রিক যন্ত্রের দক্ষতার মাত্রা ৮০ শতাংশ।

তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের কোনো বাধা দিচ্ছি না। যান্ত্রিকভাবে এতে ত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু বিদ্যুৎ যেটা ব্যবহার করছে, তার রিটার্ন অনেক বেশি।...এ ক্ষেত্রে লেড ব্যাটারি থেকে তারা যেন লিথিয়াম ব্যাটারিতে চলে আসে। এটা নিয়ে আমরা একটা প্রকল্প করছি। আমরা লেড ব্যাটারি নিয়ে তাদের লিথিয়াম ব্যাটারি প্রদান করব।’

সরকার যদি ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশাকে দেশে দ্রুত চালু উৎসাহিত করতে চায়, তাহলে আজও এগুলোর চলাচলকে ‘আইনগতভাবে অবৈধ’ করে রাখা হয়েছে কার স্বার্থে?

নসরুল হামিদ মত প্রকাশ করেন, দেশে যত গণপরিবহন আছে, সেগুলো দ্রুত বিদ্যুতে নিয়ে আসা উচিত। এতে খরচ কম ও এটি পরিবেশবান্ধব। ওপরে উদ্ধৃত নসরুল হামিদের বক্তব্য এবং মতামত থেকে বোঝা যাচ্ছে, বর্তমানে অবৈধ হলেও ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশাকে উৎসাহিত করার নীতি গ্রহণ করেছে সরকার।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার প্রশ্ন, সরকার যদি ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশাকে দেশে দ্রুত চালু উৎসাহিত করতে চায়, তাহলে আজও এগুলোর চলাচলকে ‘আইনগতভাবে অবৈধ’ করে রাখা হয়েছে কার স্বার্থে? ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ-দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক চাঁদাবাজদের স্বার্থে কি অবৈধ রাখার অযৌক্তিক আইন বহাল রাখা হচ্ছে?

ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা দেশে চালু হয়েছে প্রায় এক যুগ আগে। গ্রামগঞ্জে, মফস্‌সল শহরের সড়কগুলোয় ক্রমেই সাইকেল রিকশাকে হটিয়ে জায়গা দখল করে নিচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাও স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সিএনজি অটোরিকশার তুলনায় অনেক ব্যয়সাশ্রয়ী বিধায় এগুলোর ব্যবহারও অনেক বছর ধরে দ্রুতবর্ধনশীল। অনেক এলাকায় সাইকেল রিকশার দেখা মিলছেই না।

ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা এলাকার প্রধান যানবাহনে পরিণত হয়ে গেছে। এটাকে আমার কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য পরিবর্তন মনে হয়েছে। কারণ, রিকশাওয়ালাদের শারীরিক ধকল প্রশমিত করার এই বাহনগুলো একদিকে আধুনিকতার প্রতীক, অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব।

অনেকে এগুলোকে যান্ত্রিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ ও বিপজ্জনক আখ্যা দিলেও বড়সড় কোনো দুর্ঘটনা এর ফলে ওই সব এলাকায় বেড়ে যাওয়ার কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয়টি অবহেলা করা যায় না, কিন্তু ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ক্ষেত্রে এই অভিযোগ ধর্তব্য মনে হয়নি আমার কাছে।

ব্যাটারিচালিত রিকশা হঠাৎ ব্রেক করলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের দুর্ঘটনা খুব বেশি হলে রিকশা ব্যবহারকারীরাই ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবহারে অনীহা দেখাতেন। এই সমস্যা কোথাও গুরুতর আকার ধারণ করার কথা শোনা যায়নি। তবে সাইকেল রিকশার মতো এগুলোর চলাচলকেও মহাসড়কে বৈধতা দেওয়া যাবে না বোধগম্য কারণে।

সমাজের একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের এই শারীরিক ধকলমুক্ত ব্যবস্থাটাকে আমরা নিরুৎসাহিত করার কোনো যুক্তি দেখি না। সরকারকে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অবিলম্বে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা চলাচলকে গ্রামগঞ্জে, নগর-মহানগরের ছোটখাটো সড়কগুলোয় ‘আইনত বৈধতা’ প্রদান করা হোক। জাতীয় মহাসড়কগুলোয়, মহানগরের প্রধান সড়কগুলোয় এবং অন্যান্য নগরীর প্রধান সড়কগুলোয় ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখা হোক।

শামীম ওসমান ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশাগুলোর ব্যাটারি চার্জ করার জন্য অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করার যে অভিযোগ তুলেছেন, সেটাকে অস্বীকার করা সমীচীন হবে না। ৭০০ থেকে ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অবৈধ ব্যবহার ছোটখাটো ব্যাপার নয়। এর জবাবে জনাব নসরুল হামিদ বৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহারে রিকশা ও অটোরিকশাচালকদের উৎসাহিত করার কয়েকটি পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁকে আমার অনুরোধ, অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারের উল্লিখিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করুন। বিশেষত, লেড ব্যাটারির পরিবর্তে লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার উৎসাহিত করার ব্যবস্থা ত্বরান্বিত করাকে প্রথম অগ্রাধিকার প্রদান করুন।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে সৌরশক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণে বর্তমানে চীন উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সফলতা অর্জন করেছে। কিন্তু নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখনো উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সংসদে প্রদত্ত বক্তব্যের ভাষ্য মোতাবেক বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ৪৫৯ মেগাওয়াট (২ শতাংশ) জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়া সৌরবিদ্যুৎ।

আরও পড়ুন

আর ২০২৩ সালের নভেম্বরেও বাংলাদেশে মাত্র ১ হাজার ১৯৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে সব নবায়নযোগ্য উৎসগুলো থেকে। এহেন ব্যর্থতা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। দেশের আমদানি করা কয়লানির্ভর বিদ্যুতের মেগা প্রকল্প স্থাপনের পুরো ব্যাপারটিই বাংলাদেশের জন্য অসহনীয় বোঝা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে।

আমদানি করা এলএনজির ওপর নির্ভরশীলতা দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনকে ইতিমধ্যেই বড়সড় বিপদে ফেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের ‘সাসটেইনেবল অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’ তাদের ঘোষিত ন্যাশনাল সোলার এনার্জি রোডম্যাপে ৩০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুতের টার্গেট অর্জনের সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে ১২ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ ছাদভিত্তিক সোলার প্যানেল থেকে আহরণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

ছাদভিত্তিক ১২ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন মোটেও অসম্ভব নয়, প্রয়োজন হবে সোলার প্যানেল ও ব্যাটারির ভর্তুকি-দাম কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সৌরবিদ্যুতের যন্ত্রপাতির ওপর আরোপিত শুল্ক হ্রাস এবং যুগোপযোগী ‘নেট মিটারিং’ পদ্ধতি চালু করা।

● ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক