পার্বত্য চট্টগ্রাম: ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির আগে ভূমি জরিপ নয়

‘পার্বত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে পাহাড়ের ভূমি বিরোধকে আরেক নতুন সংকটের মুখে ফেলবে।’

৩ আগস্ট ভূমি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক বৈঠকে কমিটির সভাপতি মকবুল হোসেন বলেছেন, পার্বত্য অঞ্চলে এরিয়া সার্ভে করার বিষয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করছে এবং সার্ভের প্রয়োজনে সেখানে স্যাটেলাইট ও ড্রোনের সাহায্যে জরিপের কথাও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির অষ্টম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২০ আগস্ট। ওই বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

কিন্তু এখন কথা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনে ২২ হাজারের অধিক বিরোধপূর্ণ জমির যে আবেদন পড়েছে, সেসব আবেদনের নিষ্পত্তি না করে সরকার যদি দেশের প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থাপনার নিয়ম পার্বত্য এলাকায় প্রয়োগ করতে চায়, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধের মাত্রা আরও বাড়বে বৈ কমবে না।

চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সরকার ১৯৯৯ সালে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করে। ২০০১ সালে এ-সংক্রান্ত একটি আইন করা হয়, যা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১’ নামে পরিচিত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, দুই যুগ পরও এ কমিশনের বিধিমালা আজ অবধি চূড়ান্ত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এ কমিশন পরিচালনার জন্য বিধিমালার একটি খসড়াও তৈরি করে দিয়েছে। এরপরও এ বিষয়ে সরকার বা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। ফলে ভূমি কমিশনের দৃশ্যমান কোনো কাজের অগ্রগতিও নেই।

আমাদের উদ্বেগের আরেকটি বিষয় হলো, ৩ আগস্ট অনুষ্ঠিত বৈঠকে ভূমিমন্ত্রী পার্বত্য অঞ্চলকে অত্যন্ত ‘সেনসিটিভ’ এলাকা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা না করার কথা বলেছেন (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন)। একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী যখন এ কথা বলেন, তখন আমাদের মনে এ সংশয় জাগে যে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন তাহলে কার হাতে ন্যস্ত আছে! চুক্তি স্বাক্ষরকারী দল হিসেবে ক্ষমতার মসনদে বসেও যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা না যায়, তাহলে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কথা বলার মঞ্চটি কোথায়?

পার্বত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে পাহাড়ের ভূমি বিরোধকে আরেক নতুন সংকটের মুখে ফেলবে। বান্দরবানে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বহু আগেই শুরু হয়েছে। এ পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটি যে বিশেষ উদ্দেশ্যে এবং কারোর বিশেষ উদ্যোগে হচ্ছে, সেটা আরও স্পষ্ট হয়েছে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা থেকে।

আমরা বরাবরই লক্ষ করেছি, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা পার্বত্য অঞ্চলকে সব সময় ‘বিশেষ’ অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে বিচ্ছিন্ন রাখার কৌশল অবলম্বন করেন। অনেক ক্ষেত্রে সমতলের দুর্নীতিবাজ, নীতিভ্রষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে পার্বত্য এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে যত দিন এ ভ্রান্ত ধারণা পাল্টাবে না, তত দিন দেশের সাধারণ জনগণের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘স্পর্শকাতর’ অঞ্চল হিসেবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে। এ কথা মনে রাখা দরকার, দেশের একটি অংশকে পিছিয়ে রেখে দেশের যত উন্নয়নই করা হোক না কেন, সেই উন্নয়ন কখনো টেকসই হবে না।

সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি জরিপের যে চিন্তাভাবনা করছে, তার বিরোধিতা আমরা করছি না। তবে জরিপের আগে অবশ্যই পাহাড়ে প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভূমি কমিশনে আবেদন করা বিরোধগুলো নিষ্পত্তি করতে হবে। একই সঙ্গে ভারত প্রত্যাগত পাহাড়ি শরণার্থীদের অনেকে যাঁরা দুই যুগ ধরে নিজ বাস্তুভিটায় ফিরে যেতে পারেননি, তাঁদের নিজ নিজ ভিটেমাটি ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এ ছাড়া তিন পার্বত্য জেলায় অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে প্রায় ৮২ হাজার পাহাড়ি পরিবার রয়েছে, তাদের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। না হলে কেবল স্যাটেলাইট ও ড্রোন দিয়ে জরিপ চালিয়ে পাহাড়ি জমির ওপর দাগ নম্বর বসিয়ে দিলে পার্বত্য এলাকার ভূমি সমস্যার সমাধান হবে না, বরং সমস্যাটি আরও জটিল হবে।

আরও পড়ুন

তা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে পাহাড়ের ভূমি বিরোধকে আরেক নতুন সংকটের মুখে ফেলবে। বান্দরবানে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বহু আগেই শুরু হয়েছে। এ পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটি যে বিশেষ উদ্দেশ্যে এবং কারোর বিশেষ উদ্যোগে হচ্ছে, সেটা আরও স্পষ্ট হয়েছে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা থেকে।

সম্প্রতি খাগড়াছড়ি জেলার ১ নম্বর খাগড়াছড়ি ইউনিয়নের বিজিতলা ও গামারিঢালা এলাকায় কমপক্ষে ৩৩ রোহিঙ্গা পরিবারকে পুনর্বাসন করার অভিযোগ উঠেছে (সূত্র: প্রথম আলো, ৩০ আগস্ট)। পুনর্বাসিত এই রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্যদের জন্মসনদ প্রদানের জন্য স্থানীয় খাগড়াছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা এবং সনদ প্রদানে অসম্মতি জানালে ইউনিয়ন পরিষদের সচিবকে বদলি করে নতুন সচিব নিয়োগেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে এটা পরিষ্কার হয় যে পার্বত্য অঞ্চলে ভূমি সমস্যাকে জিইয়ে রাখার জন্য বিশেষ মহলের উদ্যোগে পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের প্রচেষ্টাও জোরেশোরে চলছে।

অন্যদিকে, তিন পার্বত্য জেলায় হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত সড়ক নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের পথে। এ সড়ক নির্মাণের ফলে বহু পাহাড়ি গ্রাম ও গ্রামবাসী ক্ষতির মুখে পড়েছে। তাদের বাড়িঘর, বাগান-বাগিচা, ধানি জমি এ সড়ক নির্মাণের আওতায় পড়েছে। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর বিকল্প পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে সরকারের এ উন্নয়ন পাহাড়িদের আরও ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে।

এ ছাড়া পর্যটনের নামে পাহাড়িদের আদি ভোগদখল করা জমি বেদখল করে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ, রবার কোম্পানির কাছে জমি ইজারা প্রদান, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার জন্য শত শত একর জমি অধিগ্রহণ, সরকারের বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাদের নামে–বেনামে জমি ইজারা দিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন রিসোর্ট, বাগানবাড়ি গড়ে তোলার যে প্রবণতা পাহাড়ে বেড়েছে, তা পার্বত্য এলাকার পুরো ভূমি ব্যবস্থাপনার মধ্যে একটা জট তৈরি করেছে। এ জটিলতার মধ্যে যদি আবার জরিপ চালানো হয়, তাহলে পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।

কাজেই কেবল জরিপের ঘোষণা দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ বা ভূমি ব্যবস্থাপনার সংস্কারের ঘোষণা দিলে হবে না, সবার আগে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে কার্যকর ও অর্থবহ করে কমিশনের কাছে জমা পড়া আবেদনগুলোর নিষ্পত্তি করতে হবে। একই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদগুলো ও পার্বত্য ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রথাগত প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ভূমি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

  • ইলিরা দেওয়ান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক