কম শক্তিশালী দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন

গত ২৬ মার্চ ২০২৪ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ৫৩ বছর পার হলো। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের মানুষের ওপর গণহত্যা চাপিয়ে দিলে রুখে দাঁড়ায় বাংলাদেশের মানুষ। পাশে দাঁড়ায় ভারত। এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের শেষে ১৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় বাংলাদেশ, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিশ্বদরবারে।

আমার মতে, নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব উপভোগ করে পৃথিবীর খুবই স্বল্পসংখ্যক দেশ। বাকিদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নানাভাবে সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু সীমাবদ্ধতা আসে সব দেশেরই। কারণ, যখনই কোনো দেশ কোনো বহুপক্ষীয় বা দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে আবদ্ধ হয়, তখনই এক অর্থে সে তার সার্বভৌমত্বের খানিকটা ত্যাগ করতে সম্মত হয়। কোনো দেশ যদি তার নিজ নাগরিকের বিরুদ্ধেও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, তবে অন্য রাষ্ট্র সেখানে তার সমালোচনা বা নিন্দা করার অধিকার লাভ করে।

তবে স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্বের ওপর সীমাবদ্ধতা অনেক বেশি আসে অনানুষ্ঠানিক পথে। শক্তিমান দেশ বা আঞ্চলিক মহাশক্তি তুলনামূলক দুর্বলদের ওপর তাদের ইচ্ছা বা প্রয়োজন চাপিয়ে দিতে পারে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল দেশের জন্য নিজ স্বার্থের চেয়ে শক্তিমানের স্বার্থ রক্ষিত হয়, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অনেক দেশের ক্ষেত্রেই এটা ঘটে, আর বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল ছিল এবং চীনের সঙ্গে এ নিয়ে একটি চুক্তি প্রায় স্বাক্ষরের পর্যায়ে ছিল বলে জানা যায়। ভারতের আপত্তিতে বাংলাদেশ এই চুক্তি থেকে পিছিয়ে আসে। কারণ, চীনের এই সম্পৃক্ততা ভারতের কৌশলগত স্বার্থের প্রতিকূল হতে পারত।

একই কারণে চীনের সহায়তায় বাংলাদেশের প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি চুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে গেছে। যেটুকু পানি পাওয়া গেছে, তার যথাযথ ব্যবহারের জন্য পদ্মায় বাঁধ দিয়ে গড়াই ও মধুমতীতে তা প্রবাহিত করা প্রয়োজন ছিল। অনেক দেরিতে এরূপ একটি প্রকল্প নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল; কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এতে আপত্তি তোলামাত্র তা থেকে পিছু হটে বাংলাদেশ।

একটি কম শক্তিশালী দেশ তার স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব কতটা উপভোগ করতে পারবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করবে তার লিভারেজ বা সক্ষমতার ওপর। এই সক্ষমতা হতে পারে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামরিক। আবার এর উল্টো দিকে আছে নির্ভরশীলতা। কোন দেশ বা সরকার অন্য দেশের ওপর যতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব উপভোগ করা ততটাই কঠিন হয়ে যায় তার জন্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ছিল না, ছিল মুক্তির লড়াইও। এ লড়াই ছিল শোষণের বিরুদ্ধে, বঞ্চনার বিরুদ্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে, অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তির জন্য। স্বাধীন বাংলাদেশে কতটা মিলেছে এই মুক্তি?

১৯৭২ থেকে ২০২৪—এই ৫২ বছরে অনেক অর্জন বাংলাদেশের। একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, অনেক সমস্যা, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চরম দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে, হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি অভিধা মিথ্যা প্রমাণিত করে এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ বাংলাদেশ। সরকারি পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ, কিন্তু দারিদ্র৵ এবং অতি দারিদ্র্য যে কমেছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই কোনো। গত ৫২ বছরে জনসাধারণের বিপুল অংশ দারিদ্র৵ থেকে বের হয়ে এসেছে।

রংপুর অঞ্চলে প্রতিবছর যে মঙ্গা হতো কার্তিক মাসে, সে দুঃস্বপ্নও অনেকটা অন্তর্হিত। চরম দারিদ্র্য যদিও এখনো রয়ে গেছে দুঃখজনকভাবে, ১৯৭৪ সালের পর প্রকৃত অর্থে কোনো দুর্ভিক্ষ হয়নি দেশে। বিগত শতকের ’৮০-এর দশকের চরম সাহায্যনির্ভরতা এখন অনেক দূরের বিষয়। প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারসের সমীক্ষা অনুযায়ী ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৩১তম বৃহৎ অর্থনীতি, ২০৫০ সালে এই অবস্থান হবে ২৩তম। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল মাত্রই ১৯৮৬-৮৭ সালে, ২০২২ সালে তা প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে—আসছে দশকে নিম্নমধ্যম থেকে উচ্চ মধ্যম পর্যায়ে উত্তরণের, আর তার পরের দশকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার। সামাজিক ক্ষেত্রেও অনেক সাফল্য বাংলাদেশের। এমডিজি বাস্তবায়নে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তুরস্কের বাইরে, বাংলাদেশ একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে লিঙ্গসমতা অর্জন করেছে। লিঙ্গবৈষম্য র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের ৭২তম অবস্থান ভারত বা শ্রীলঙ্কার ওপরে।

এতসব সাফল্যের বিপরীতে ব্যর্থতার তালিকাও দীর্ঘ। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের মানুষের প্রথম চাওয়াই ছিল ১৯৭০-এর মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। তা না করে যখন পাকিস্তানি শাসকেরা গণহত্যার মাধ্যমে সে আকাঙ্ক্ষাকে দমন করার চেষ্টা করে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত সেই দেশে ৫৩ বছরেও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি স্বীকৃত পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। একতরফা ও সাজানো নির্বাচনে ক্ষমতাসীনেরাই ‘জয়ী’ হবে, এটাই হয়ে উঠেছে ভবিতব্য। ‘হাইব্রিড রেজিমের’ তকমা থেকে দেশ কখন মুক্ত হবে, তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আইনের শাসন এবং দুর্নীতির ধারণা-সংক্রান্ত বৈশ্বিক সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান প্রায় তলানিতে।

যুক্ত পাকিস্তানের ২৩ বছরে যে বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে তীব্র অসন্তোষ ছিল, তা হচ্ছে বৈষম্য। এ বৈষম্য একদিকে ছিল দেশের দুই অংশের মধ্যে, অন্যদিকে তা ছিল সমাজে। চারদিকে ছিল চরম দারিদ্র্যের ছড়াছড়ি, আর তার বিপরীতে অল্প কিছু পরিবারের হাতে পুঞ্জীভূত হচ্ছিল সম্পদের পাহাড়। এই পর্বতপ্রমাণ বৈষম্যের অবসান ছিল মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম লক্ষ৵। ৫৩ বছরের বাংলাদেশে মুক্তি আসেনি সে বৈষম্য থেকে।

সামগ্রিক হিসাবে অনেক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে বাংলাদেশ, কিন্তু একই সঙ্গে বেড়েছে বৈষম্য। স্বজনতোষী পুঁজিবাদ (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) এবং বাজারব্যবস্থার সিন্ডিকেট এই বৈষম্যকে প্রকট করে তুলেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে একদিকে যখন সাধারণের নাভিশ্বাস, অন্যদিকে তখন স্বাধীনতাপূর্ব সময়ের মতোই মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড় জমে উঠছে। সরকারের বড় বড় সিদ্ধান্ত হয় এমনভাবে, যাতে হাজার হাজার কোটি টাকা পুঞ্জীভূত হয় অল্প কিছু মানুষের হাতে।

বৈষম্যের পরিমাপক গিনি সহগ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০১০ সালে ছিল ০.৪৫৮, যা ২০১৬-তে বেড়ে দাঁড়ায় ০.৪৮২ এবং ২০২২ সালে ০.৪৯৯। পরিপূর্ণ সাম্য পৃথিবীর কোথাও নেই, থাকার কথাও নয়। তবে .৪ এর ওপর সহগ ব্যাপক বৈষম্যের নির্দেশক। যদি তা .৫ পার হয়ে যায়, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রায় অবধারিত, তবে সে দেশে প্রচণ্ড বৈষম্য আছে বলে ধরে নেওয়া হবে। বাংলাদেশের সমাজে বিদ্যমান প্রবল বৈষম্য অবশ্য চর্মচক্ষুতেই দৃশ্যমান, এটা বুঝতে এসব নির্দেশক দেখার প্রয়োজন হয় না। সমাজ আশা করে, এই দুর্মূল্যের বাজারে একজন পোশাককর্মী ১২ হাজার ৫০০ টাকায় তাঁর সংসার চালাতে পারবেন। পত্রিকায় খবর আসে, পেটে ক্ষুধা নিয়ে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে কিছু শিশু।

স্বাধীনতা অর্থবহ করতে, প্রকৃত মুক্তি অর্জনে, প্রয়োজন ভোটের অধিকার, ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সেই সঙ্গে বৈষম্যকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা। আর এর সবই আসলে এক সূত্রে গাঁথা।

● মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব