আঞ্চলিক সংযোগ, জ্বালানি নিরাপত্তা ও জরুরি প্রশ্ন

ব্রিটিশ পাউন্ডের অবস্থা এখন শোচনীয়। গত শুক্রবার তা সর্বকালের রেকর্ড গড়ে। জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যাওয়ায় জনজীবনে স্বস্তি দিতে ও ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করতে সরকার একটি ছোট বাজেট ঘোষণা করে, যাতে সবার আয়কর কমানো হয়।

তবে সবচেয়ে বেশি হারে কমানো হয় ধনীদের জন্য। যে যত ধনী, তার তত বেশি আয় বাঁচানোর সুযোগ হয়েছে এই জরুরি বাজেটে। অর্থবাজারে এতে বিরূপ প্রভাব তৈরি হয় এবং পাউন্ড যেমন মূল্য হারায়, তেমনই সরকার বাজার থেকে ধার করতে চাইলে তার জন্য প্রদেয় সুদের হার দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যায়।

বিশ্বের ষষ্ঠ (চলতি বছরে ভারত ব্রিটেনকে স্থানচ্যুত করে পঞ্চম স্থান দখল করে) বৃহৎ অর্থনীতির অপেক্ষাকৃত নির্ভরযোগ্য মুদ্রার এ হাল কেন হলো? বিবিসির সংবাদদাতা টম এডিংটন বলেছেন, এর আংশিক কারণ হচ্ছে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, যার পেছনে আছে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন।

রাশিয়া বা ইউক্রেনের জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বাকি ইউরোপের তুলনায় ব্রিটেনের নগণ্য। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধে ইউরোপের জ্বালানি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছু অস্বস্তিকর সত্য প্রকাশ করে দিয়েছে বলে ফরেন অ্যাফেয়ার্স সাময়িকীতে লিখেছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক হেলেন থম্পসন।

রাশিয়া জীবাশ্ম জ্বালানি সরবরাহের বিশ্বস্ত উৎস হতে পারে—জার্মানিতে এ বিশ্বাসের ইতি ঘটেছে। শুধু জার্মানি নয়, পুরো ইউরোপই এ বিশ্বাস হারিয়েছে। কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনসের উপব্যবস্থাপনা সম্পাদক জেমস ম্যাকব্রাইড এক নিবন্ধে লিখেছেন, ইউরোপের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশই আসে রাশিয়া থেকে। আর জ্বালানি তেলের ২৫ শতাংশ আসে সেখান থেকে। পুরো ইউরোপের শীত মৌসুমে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।

জ্বালানির এ সংকট বোধগম্য কারণেই ইউরোপে সীমাবদ্ধ নেই। জ্বালানি তেল উৎপাদনে রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এবং গ্যাস উৎপাদনে দ্বিতীয়। ইউরোপে বহু দশক ধরেই রুশ জ্বালানি আসছে ইউক্রেন ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো অর্থাৎ সাবেক সোভিয়েত বলয়ের দেশগুলোর মধ্য দিয়ে আসা পাইপলাইনের মাধ্যমে। পরে নির্মিত হয়েছে সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহের পাইপলাইন নর্ডস্ট্রিম। অর্থাৎ ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার জ্বালানি-সংযোগ খুবই ব্যাপক ও অবকাঠামোগত যুক্ততার (কানেকটিভিটি) ওপর প্রতিষ্ঠিত।

ইউরোপের চলমান জ্বালানি-সংকট ও দক্ষিণ এশিয়ার নিকট অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে তাই যে প্রশ্ন সবারই গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা প্রয়োজন, তা হলো সংযোগ বা কানেকটিভিটি যেন শুধু ক্ষমতাধরের ক্ষমতাকেই সমৃদ্ধ না করে। সেখানে ন্যায্যতা ও সমানুপাতিক সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি।

এখন দেখা যাচ্ছে কানেকটিভিটি বাড়িয়েও রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদী রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার কারণে ইউরোপ রীতিমতো নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে। সরাসরি সামরিক সংঘাত না হলেও জ্বালানি-সংকটের কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার হুমকি থেকে ইউরোপের শিগগির মুক্তি মিলছে না।

দক্ষিণ এশিয়ায় কানেকটিভিটি এখন খুব আলোচিত এবং অনেকাংশেই সমাদৃত শব্দ। ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং দেশি-বিদেশি পরামর্শকেরা এক দশকের বেশি সময় ধরে কানেকটিভিটিতেই সবার সমৃদ্ধির তত্ত্ব জপ করে চলেছেন। সড়ক, রেল ও নৌপথে সংযোগ বাড়ানো, অন্য কথায় ঐতিহাসিক সংযোগ পুনরুজ্জীবনে আগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি জ্বালানি খাতেও এ সংযোগ বাড়ানোর কথা বলছেন। অবশ্য লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এ বিষয়ে আগ্রহ, উৎসাহ এবং এক অর্থে পীড়াপীড়ি কার্যত ভারতের দিক থেকেই বেশি।

ভারতের এ সংযোগ বাড়ানোর আগ্রহ শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে নয়, নেপালের সঙ্গেও। প্রশ্ন হচ্ছে, জ্বালানি খাতে এ সংযোগে সব দেশ কি সমভাবে লাভবান হচ্ছে? নাকি বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে ক্রমবর্ধমান অসম বাণিজ্যের মতো জ্বালানি লেনদেনেও ছোট প্রতিবেশীরা বড় ঘাটতির মুখে পড়বে?

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যে শীর্ষ বৈঠক হয়েছে, তাতেও জ্বালানি খাতে সংযোগ বাড়ানোর বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বৈঠকের এক দিন পর ৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার চেতনায় উভয় দেশের বিদ্যুৎ গ্রিডের সামঞ্জস্যকরণের বিষয়ে উভয় নেতা সম্মত হয়েছেন।

বিহারের কাটিহার থেকে পার্বতীপুর হয়ে আসামের বরানগর পর্যন্ত ৭৬৫ কেভির উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সঞ্চালন লাইন নির্মাণের প্রকল্পে গতি সঞ্চারের কথা এতে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে। নেপাল ও ভুটান থেকে ভারতের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ আমদানির প্রশ্নে বাংলাদেশের অনুরোধের কথাও এতে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে উল্লেখ মানে যে সম্মতি নয়, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা মোকাবিলায় ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন নির্মাণের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে উভয় নেতা আশাবাদ প্রকাশ করেছেন যে এটি দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন হবে। আসাম থেকে ত্রিপুরায় জ্বালানি তেল ও লুব্রিকেন্ট পরিবহনের সুবিধা দেওয়ায় ভারত বাংলাদেশের তারিফ করেছে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ আমদানি ও জ্বালানি তেলের পাইপলাইন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা আদৌ ছিল কি না, তা নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞেরই প্রশ্ন আছে। প্রকৌশলী ও লেখক কল্লোল মোস্তফা সমকাল পত্রিকায় (২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২) ‘জ্বালানিতে ভারতনির্ভরতার লাভ-ক্ষতি’ শিরোনামের নিবন্ধে হিসাব দিয়ে এর বিশদ তুলে ধরেছেন। তাঁর উদ্ধৃত হিসাবে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সামর্থ্য ইতিমধ্যে অর্জিত হয়েছে, তার অনেকটাই (প্রায় ৪০ শতাংশ) এখন কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।

আরও পড়ুন

ফলে কথিত ক্যাপাসিটি চার্জের কারণে বিপুল পরিমাণে টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। গত এক দশকে এ বাবদ খরচ হয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকা। ভারত থেকে আমদানিতে তাই অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের বোঝা বাড়বে। একইভাবে তিনি দেখিয়েছেন যে পরিবহন খরচ কমানোর যুক্তিতে ভারত থেকে পাইপলাইনে যে দামে তেল আনা হবে, তার মোট খরচ অন্য দেশ থেকে আমদানি করা তেলের চেয়ে বেশি হবে। নিজেদের তেল পরিশোধনের ক্ষমতা না বাড়িয়ে এ ধরনের সংযোগে অর্থনৈতিক লাভ ভারতের বেশি।

ভারতের আরেক প্রতিবেশী নেপালের প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা গত মার্চ মাসে দিল্লি ঘুরে এসেছেন। তাঁর ওই সফরেও আঞ্চলিক সংযোগের ধারায় বড় ধরনের সমঝোতা হয়েছে। তবে সেটা নেপালের পানিসম্পদকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ভারতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও খরা মৌসুমে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গৃহীত প্রকল্প। ওই সফরের পর গত জুন মাসে নেপালের মন্ত্রিসভা ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ন্যাশনাল হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশনকে পশ্চিম নেপালে ওয়েস্ট সেতি পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে। ওই প্রকল্পে ১৯৪ মিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

প্রকল্পটি আগে চীনের থ্রি গর্জেস ইন্টারন্যাশনাল কর্পের (সিটিজি) করার কথা ছিল। কিন্তু কাঠমান্ডুতে প্রচণ্ড কুমার দাহালের মাওবাদী সরকার বদলের পর সে চুক্তি বাতিল হয়। গত মে মাসে এক নির্বাচনী সভায় প্রধানমন্ত্রী দেউবা জানান, ওয়েস্ট সেতি প্রকল্প ভারতকে না দিয়ে উপায় ছিল না। কেননা, ভারত চীনা বিনিয়োগের নেপালি প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ কিনবে না। নেপালের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ ভারত না কেনায় তাদের উৎপাদনক্ষমতার ৫০০ মেগাওয়াট অব্যবহৃত থেকে গেছে। নেপাল টাইমস-এ রমেশ কুমার লিখেছেন, ভূরাজনীতিই নেপালের পানি ও বিদ্যুতের গতিধারাকে পরিচালনা করছে।

নেপালে এখন বিদ্যুতের চাহিদা হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট, কিন্তু উৎপাদনক্ষমতা ২ হাজার ১০০ মেগাওয়াট। আগামী দুই বছরে তাতে যোগ হবে আরও ২ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। বৃহৎ প্রতিবেশীর ওপর জ্বালানিনির্ভরতা কতটা ঝুঁকির, তার তিক্ত অভিজ্ঞতা নেপালের আছে। ২০১৫ সালে ছয় মাস জ্বালানি অবরোধের কারণে দেশটিকে কতটা ভুগতে হয়েছে, তা এ অঞ্চলের কোনো দেশেরই ভুলে যাওয়ার কথা নয়। 

আরও পড়ুন

আঞ্চলিক সহযোগিতার নীতিতে বা চেতনায় বিচার করলে নেপালের উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য খুবই কাজের হতো। কিন্তু ভূরাজনৈতিক কারণে এখনই যে তা হচ্ছে না, সেটা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। জ্বালানি খাতে ভারতীয় বিনিয়োগের আরেকটি অংশ হচ্ছে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিজেপি-ঘনিষ্ঠ আদানির ভূমিকা। অবকাঠামো খাতে বন্দর থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ—সবকিছুতে তাঁর যে একচেটিয়া আধিপত্য তৈরি হয়েছে, এর রাজনৈতিক প্রভাব অনস্বীকার্য।

শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের সময় সিলোন বিদ্যুৎ বোর্ডের একটি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি নিয়ে পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে তথ্য প্রকাশের পরিণতি কী হয়েছিল, তা অন্যদের জন্য শিক্ষণীয়। হারেৎজ পত্রিকা খবর দিয়েছে, ইসরায়েলের একটি বন্দর পরিচালনার কাজের জন্য ভারতের সরকার আদানির হয়ে কীভাবে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশকে আদানি প্রকল্পের বিদ্যুতের জন্য কতটা বাড়তি টাকা গুনতে হবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।

ইউরোপের চলমান জ্বালানি-সংকট ও দক্ষিণ এশিয়ার নিকট অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে তাই যে প্রশ্ন সবারই গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা প্রয়োজন, তা হলো সংযোগ বা কানেকটিভিটি যেন শুধু ক্ষমতাধরের ক্ষমতাকেই সমৃদ্ধ না করে। সেখানে ন্যায্যতা ও সমানুপাতিক সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি।

  •  কামাল আহমেদ সাংবাদিক