১৯৮৮ সালে দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় ‘ফুটপাত ইজ নট হেডপাত’ নামে একটি লেখায় প্রয়াত শিক্ষক ও সাহিত্যিক অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার শাসনকালে ফুটপাতবাসীদের ওপর পুলিশের নির্মম আক্রমণের কথা স্মরণ করে লিখেছিলেন, ‘এ দেশে শোষণের কবলে পড়ে জমি ভিটেবাড়ি হারানো বেআইনি নয়। এটা আইনসম্মত। এতে আইনি কোনো বাধা নেই; কিন্তু সর্বস্ব হারিয়ে কাজ ও আশ্রয়ের সন্ধানে শহরে এসে কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে না পেরে ফুটপাতে পিঠ পাতা বেআইনি, যার শাস্তি হলো এলোপাতাড়ি পিটুনি। কারণ, ফুটপাত তো পা পাতার জন্য, মাথা বা পিঠ পাতার জন্য নয়। ফুটপাত ইজ নট হেডপাত।’
পাকিস্তান আমল পেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্ব চলছে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় হয়ে গেল। কত সামরিক-বেসামরিক, তত্ত্বাবধায়ক-অন্তর্বর্তী সরকার এল। এখনো উপায়হীন মানুষের ফুটপাতে মাথা ও পিঠ পাততে হয়, হকারি করে দিন গুজরান করতে হয়; আর বিনিময়ে মাঝেমধো৵ অবৈধ দখলদার হিসেবে উচ্ছেদ হতে হয়।
একবার উচ্ছেদ হওয়ার পর কিছুদিন হকাররা বিরত থাকেন, সামান্য কিছু জমানো টাকা-পয়সা খরচ করে দিন গুজরান করার চেষ্টা করেন, তারপর সুযোগ বুঝে আবারও লাঠির বাড়ি, বুটের লাথি কিংবা অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি নিয়ে আবারও ফুটপাতে পসরা জমাতে শুরু করেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। ফুটপাতে হকার ব্যবস্থাপনার টেকসই সমাধানের দিকে না গিয়ে আগের সরকারগুলোর মতোই অন্তর্বর্তী সরকার কিছুদিন পরপর উচ্ছেদ অভিযানভিত্তিক সমাধানের পথে হেঁটেছে।
ফলে ২০২৪ সালের নভেম্বরে ফার্মগেটে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর ঠিক এক বছর পর সম্প্রতি আবারও উচ্ছেদ অভিযান চালানোর ঘটনা ঘটেছে। এমনকি নির্বাচিত ডাকসু নেতাদেরও দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মারধর করে হকার উচ্ছেদ করতে।
দুই.
ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদে যে যুক্তি দেওয়া হয়, তা হলো ফুটপাত হাঁটার জায়গা, ব্যবসার জায়গা নয়। যেসব দেশ ঘনবসতিপূর্ণ নয়, জায়গার কোনো অভাব নেই এবং বেকারত্ব প্রকট নয়, সেসব দেশে মাইলের পর মাইল রাস্তার পাশে প্রশস্ত ফুটপাত শুধু হাঁটার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ ও কর্মসংস্থানের সংকট যেসব দেশের রয়েছে, সেসব দেশের জন্য এই যুক্তি বাস্তব নয়। এ রকম ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক দেশেই ফুটপাতে হকারদের লাইসেন্সের মাধ্যমে ব্যবসা করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। ফুটপাতে হকারের বসার পরিধি ও সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে দেওয়ার ফলে ব্যবসা ও হাঁটা দুটিই ঠিকঠাক চলে।
বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এবং বেকারত্বে জর্জরিত একটি দেশের বেকার তরুণেরা যে অন্য কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না হলে খুচরা পণ্য নিয়ে ফুটপাতে বসে যাবেন, সেটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। বৈষম্যমূলক অর্থনীতির থাবায় ক্ষতবিক্ষত গ্রামীণ কৃষি থেকে উচ্ছেদ হয়ে আসা বিপুলসংখ্যক মানুষও শহরে এসে আর কোনো কর্মসংস্থান করতে না পেরে হকারি করেন। এসব মানুষকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার আগে ভেবে দেখা প্রয়োজন, অল্প একটু জায়গায় ব্যবসা করে জায়গা জমির কতটা দক্ষ ব্যবহার তারা করছেন। এই লাখো বেকারের জন্য আলাদা দোকান বা শপিং মল দেওয়ার মতো বিপুল জায়গার জোগান দেওয়ার বাস্তবতা আমাদের আছে কি না। তা ছাড়া তারা তো ফুটপাতে বিনা পয়সায় ব্যবসা করছেন না, ফুটপাতে বসার জন্য তাদের প্রতিদিন নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয়, নানাভাবে পুলিশের হয়রানিরও শিকার হতে হয়।
সরকার লাইসেন্সের মাধ্যমে নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়মকানুন মেনে বৈধভাবে ব্যবসা করার ব্যবস্থা করে দিলে বেকার তরুণেরা হয়রানি ও নিপীড়ন থেকে যেমন মুক্ত হতে পারতেন, সেই সঙ্গে সরকারেরও আয় হতো।
হকার সমস্যা সমাধানে নগর–পরিকল্পনাবিদদের নির্দেশনা না মেনে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে হকার উচ্ছেদ করাটা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে! সরকারি প্রতিষ্ঠানই যদি সরকারের মহাপরিকল্পনা মেনে না চলে, তাহলে অন্যদের কীভাবে নিয়মকানুন মেনে চলতে বাধ্য করা যাবে!
তিন.
প্রতিবেশী দেশ ভারত সরকার ঠিক এই কাজই করেছে ‘দ্য স্ট্রিট ভেন্ডরস (প্রোটেকশন অব লাইভলিহুড অ্যান্ড রেগুলেশন অব স্ট্রিট ভেন্ডিং) অ্যাক্ট-২০১৪’–এর মাধ্যমে। এই আইনের মাধ্যমে হকারদের নগরের গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদানকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ‘টাউন ভেন্ডিং কমিটি’ নামের একটি অংশগ্রহণমূলক কমিটির বিধান রাখা হয়। এই কমিটির সদস্যদের অন্তত ৪০ শতাংশ হকার থাকতে হয়।
এই কমিটির মাধ্যমে ফুটপাতের কোথায় কতক্ষণ হকার বসতে পারবে বা পারবে না, তা নির্ধারণ করা হয়। হকারদের লাইসেন্স দেওয়া এবং নিয়মকানুন মেনে চলতে বাধ্য করার কাজটিও এই কমিটির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। পাইকারিভাবে হকার উচ্ছেদ না করে অন্তর্বর্তী সরকার হকারদের নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এ রকম একটি উদ্যোগ নিতে পারত।
চার
নগর–পরিকল্পনাবিদসহ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে প্রণীত রাজউকের ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০২২-৩৫ (ড্যাপ) দলিলেও এভাবে হকার ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ড্যাপের প্রথম খণ্ডের চতুর্থ অধ্যায়ের ‘হকার ব্যবস্থাপনা নির্দেশনা’ অংশে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা কর্তৃক হকার নিবন্ধন ও তাদের অধিকার নির্ধারণ করা হয়েছে।
এই নির্দেশনা অনুযায়ী ‘হকার কমিটি’ গঠন করে পরিচয়পত্রসহ হকারদের নিবন্ধন দিতে হবে। নিবন্ধনে হকারদের শ্রেণি, নির্ধারিত স্থান, আয়তন, সময় ও মাসিক ফি উল্লেখ থাকবে।
পরিচয়পত্রে ছবি, ঠিকানা, বসার স্থান ও আয়তন (প্রয়োজনে স্টল নম্বর) এবং সময় উল্লেখ করতে হবে। হকাররা বরাদ্দ করা স্থানের বিপরীতে মাসিক ফি দেবেন।
পরিচয়পত্র অনুযায়ী নিবন্ধিত হকার ব্যতীত অন্য কেউ ওই স্থানে বসতে পারবেন না এবং পরিচয়পত্র বা জায়গা অন্য কাউকে ভাড়া দেওয়া যাবে না। কেনাবেচার স্থান রাস্তার জংশন বা ‘প্রবেশ-বাহির’ পথ থেকে নির্ধারিত দূরত্বে স্থাপন করতে হবে।
ফুটপাতে জায়গার সংকট থাকলে ভ্যানগাড়িতে বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। লাইসেন্স ছাড়া কোনো হকার যদি ব্যবসা করেন, তাহলে তাদের উচ্ছেদের ক্ষেত্রেও কিছু বিধি মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। যেমন উচ্ছেদের সময় জব্দ করা পচনশীল দ্রব্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এবং অপচনশীল দ্রব্য ৭ দিনের মধ্য মালামালের মালিককে ফেরত দিতে হবে। (বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-২০৩৫)-প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৯-১৮০)
ড্যাপের এই সুপারিশ মেনে নিবন্ধনের মাধ্যমে ফুটপাতে হকারের বসার স্থান ও সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হলে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থানের কোনো ক্ষতি না করেই ফুটপাতে চলাচলের সমস্যা সমাধান করা যেত। বাস্তবে আমরা দেখছি, সরকারের সিটি করপোরেশন এ ধরনের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে যখন-তখন হকারদের উচ্ছেদ করছে এবং তাদের মালামাল ফেরত না দিয়ে ধ্বংস করছে।
হকার সমস্যা সমাধানে নগর–পরিকল্পনাবিদদের নির্দেশনা না মেনে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে হকার উচ্ছেদ করাটা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে! সরকারি প্রতিষ্ঠানই যদি সরকারের মহাপরিকল্পনা মেনে না চলে, তাহলে অন্যদের কীভাবে নিয়মকানুন মেনে চলতে বাধ্য করা যাবে!
পরিচয়পত্র অনুযায়ী নিবন্ধিত হকার ছাড়া অন্য কেউ ওই স্থানে বসতে পারবেন না এবং পরিচয়পত্র বা জায়গা অন্য কাউকে ভাড়া দেওয়া যাবে না। কেনাবেচার স্থান রাস্তার জংশন বা ‘প্রবেশ-বাহির’ পথ থেকে নির্ধারিত দূরত্বে স্থাপন করতে হবে।
ফুটপাতে জায়গার সংকট থাকলে ভ্যানগাড়িতে বিক্রির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। লাইসেন্স ছাড়া কোনো হকার যদি ব্যবসা করেন, তাহলে তাঁদের উচ্ছেদের ক্ষেত্রেও কিছু বিধি মেনে চলার কথা বলা হয়েছে। যেমন উচ্ছেদের সময় জব্দ করা পচনশীল দ্রব্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এবং অপচনশীল দ্রব্য ৭ দিনের মধ্য মালামালের মালিককে ফেরত দিতে হবে। (বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-২০৩৫)-প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৯-১৮০)
ড্যাপের এই সুপারিশ মেনে নিবন্ধনের মাধ্যমে ফুটপাতে হকারের বসার স্থান ও সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা হলে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থানের কোনো ক্ষতি না করেই ফুটপাতে চলাচলের সমস্যা সমাধান করা যেত। বাস্তবে আমরা দেখছি সরকারের সিটি করপোরেশন এ ধরনের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে যখন-তখন হকারদের উচ্ছেদ করছে এবং তাদের মালামাল ফেরত না দিয়ে ধ্বংস করছে।
হকার সমস্যা সমাধানে নগর–পরিকল্পনাবিদদের নির্দেশনা না মেনে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে হকার উচ্ছেদ করাটা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে! সরকারি প্রতিষ্ঠানই যদি সরকারের মহাপরিকল্পনা মেনে না চলে, তাহলে অন্যদের কীভাবে নিয়মকানুন মেনে চলতে বাধ্য করা যাবে!
গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাপক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির গল্প প্রচার করা হলেও বাস্তবে দেশে আনুষ্ঠানিক খাতে মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় এই পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। ফলে দেশের শ্রমজীবীদের ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ হলো ফুটপাতের হকার।
দেশের তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে এমনিতেই ফুটপাতে হকার কমে যাবে। ফুটপাতে ব্যবসা করা খুব আরামদায়ক ও আকর্ষণীয় কিছু নয়; কিন্তু তার আগে দেশে বেকারত্বের সমস্যার সমাধান না করে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করা ভীষণ অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
