ঘূর্ণিঝড় রিমাল: ঝড় ছোট, ক্ষতি তো কম নয়

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ছবি : সাইয়ান

ঝড়ের প্রকোপ এখন উপকূল ছাড়িয়ে মূল স্থলভাগে। ১০ নম্বর উঠিয়ে নিয়ে এখন (২৭ মে বিকেল) ৩ নম্বর সংকেতে আছে দেশ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী রিমালের তাণ্ডবে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ১১ জন।

ট্রলারডুবি দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের দিন শুরু হয়েছিল এবার। বাতাসে বা ঝড়ে উল্টায়নি মোংলা ট্রলারটি। উল্টেছে অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে। তবে ঝড়ের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক ছিল। ৭ নম্বর মহাবিপৎসংকেতের সঙ্গে সঙ্গে নিয়ম অনুযায়ী নদীতে চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ইপিজেড বন্ধ হয়নি। তাদের কলকারখানা চালু ছিল। শ্রমিকেরা আসেন নদী পার হয়ে। সে কথা জানতেন কর্তারা। তাই ফোন করে বলে দিয়েছিলেন, ৭-৮ বুঝি না কারখানা খোলা আছে। আসতে হবে সবাইকে।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক শ্রমিকের অভিযোগ, ‘ঝড়ের মধ্যে কারখানায় যাওয়ার বিষয়ে ভিআইপি কোম্পানির মিজান স্যার (মানবসম্পদ বিভাগের কর্তা) ফোন দিয়ে জোর করে তাঁদের নিয়েছেন।’ এ যেন রানা প্লাজার ঘটনার পুনরাবৃত্তি। যানবাহনের ঘাটতি থাকায় শ্রমিকেরা বাধ্য হয়ে চাপাচাপি করে এক নৌকা বা ট্রলারে পার হতে গিয়ে ট্রলারডুবি হয়। দুর্ঘটনার কথা রাষ্ট্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাউকে আর বলতে হয়নি। ইপিজেডের সব কারখানা নিমেষে বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ ছুটে যায় নৌশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। তাঁরা নেমে পড়েন ৭ নম্বর বিপৎসংকেতের সরকারি বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়নের জন্য। শ্রমিকেরা আবার বিপদে পড়েন, ট্রলার না চললে নদী পার হয়ে ঘরে ফিরবেন কীভাবে?

আমাদের কোনো ব্যবস্থাপনাতেই সাধারণ মানুষের কথা ভাবা হয় না। আমাদের ফুটফুটে সুন্দর একটা নির্দেশনা বই আছে, যাকে আমরা এসওডি বলে ডাকি। সেই নির্দেশনায় বলে দেওয়া আছে দুর্যোগের আগে-পরে আর দুর্যোগের সময় কে-কী কাজ করবে। কত নম্বর বিপৎসংকেত জারি হলে কার কী ভূমিকা হবে। ৭ নম্বরে কারখানা চালু রাখা বা নদী পার হয়ে কাজ আসতে বাধ্য করা যায় না। কিন্তু কেউ বাধ্য করলে তার কী বিধান হবে। ট্রলারের সবাই ডুবে মারা গেলে আমরা ভাগ্য আর বিধির বিধানকে দায়ী করে ঘরে ফিরতাম।

এসওডি মেনে চললে আজ এই সামান্য ঝড়ে এতগুলো বেড়িবাঁধ ধসে পড়ত না। বাঁধ ভেঙেছে আমতলী, পরশুনিয়ার বাঁধ। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বাঁধ টোপকে পানি ঢুকেছে লোকালয়ে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রার ৩৬ স্থানে বাঁধে ভাঙন ধরেছে। লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়েছে বহু এলাকা। ভেঙে গেছে ঘরবাড়ি। ভেসে গেছে মাছের ঘের।

দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ইউনিয়নের কালাবগি ফকিরকোনা, ঝুলন্তপাড়া এবং পণ্ডিতচন্দ্র স্কুলসংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়া বাজার, কামিনীবাসিয়ায় বাঁধ ভাঙছে। পাইকগাছা উপজেলার লস্কর গ্রাম, বাইনতলা ওয়াপদা বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে পাইকগাছা উপজেলার বিভিন্ন পোল্ডারে পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রামে লবণাক্ত পানি ঢুকছে। চিংড়িঘের প্লাবিত হয়ে মাছ ভেসে গেছে।

ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসের পর কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া ও টেকনাফ উপজেলার কয়েকটি জায়গায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ আজও মেরামত করা হয়নি। কোথাও কোথাও বেড়িবাঁধ নেই। পাশাপাশি কিছু কিছু জায়গায় মাত্র কয়েক কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে মাটি ও বালুর বস্তা ফেলে ‘নামকা ওয়াস্তে’ সংস্কার করা হয়।

গড়ইখালীর কুমখালীর ক্ষুদখালী, লস্করের বাইনতলা, লতা, দেলুটি, হরিঢালী, লস্কর রাড়ুলী, কপিলমুনি, সোলাদানার কয়েকটি পয়েন্টে বাঁধ উপচে লোকালয়ে লবণাক্ত পানি ঢুকছে। সোমবার সকালে এলাকার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ রক্ষার কাজ করছেন। ঢাকি ও শিবসা নদীর মোহনায় কামিনীবাসিয়া পুরোনো পুলিশ ক্যাম্প-সংলগ্ন এলাকায় বেড়িবাঁধের অংশ ছিল দুর্বল। প্রথমে জোয়ারের পানি বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে ভেতরে ঢোকে। এরপর বেড়িবাঁধের পাঁচটি পয়েন্ট ভেঙে যায়। ভেঙে যাওয়ার আগে এলাকার মানুষ রাতভর মেরামতকাজ চালিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারেনি।

এবারের ঘূর্ণিঝড়ের আওয়াজ ওঠার পর পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক এক প্রস্তুতি সভার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে উপস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা বেড়িবাঁধের হালহকিকত সম্পর্কে সভাকে জানান, ‘জেলায় ১ হাজার ৩০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১০ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। দুর্যোগের সময় কোথাও ভাঙন দেখা দিলে তা মেরামতের জন্য ১৬ হাজার জিও ব্যাগ প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’

একই বয়ান পাওয়া যাবে প্রায় সব কটি উপকূলীয় জেলায়। কেউ প্রশ্ন করেনি কেন ১০ কিলোমিটার বাঁধ অরক্ষিত থাকল? লম্বা সময় বৃষ্টি ছিল না। মেরামতের অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করার পরও কাজ কেন হলো না, সেটা মানুষের জানার অধিকার আছে। টাকা ছাড়াও স্থানীয় মানুষকে নিয়ে বাঁধ মেরামতের প্রচুর উদাহরণ এ দেশেই আছে। আর টাকা যদি না থাকে, তবে মহাবিপদ জারি হওয়ার পর কোদাল, ঝুড়ি আর জিও ব্যাগ জোগাড় হলো কথা থেকে। সময়ের এক ফোঁড় দিয়ে যে ফল পাওয়া যায়, অসময়ের দশ ফোঁড়েও সে ফল মেলে না।

এখন কী করতে হবে

সবার আগে দরকার ঢুকে যাওয়া লবণপানি বের করে দেওয়া। মে মাসে সাগরের পানির লবণাক্ততার হার থাকে সবচেয়ে বেশি। এই পানি আপনাআপনি বেরোনোর পথ প্রায় রুদ্ধ। বেশির ভাগ জায়গায় জলকপাটগুলো কাজ করে না। আসন্ন আমন ধানের জন্য শুধু নয়, মানুষের ব্যবহারের জন্যও মিঠা পানির প্রয়োজন। এই পানি বের করতে না পারলে ভবিষ্যতে যে বৃষ্টির পানি আসবে, তা দিয়ে লবণাক্ততা কমানো যাবে না।
এরপর শুরু করতে হবে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। সেপ্টেম্বরের বড় জোয়ার থেকে উপকূলবাসীকে বাঁচাতে হলে আমাদের দেরি করা যাবে না।

ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও ইয়াসের পর কক্সবাজার জেলার মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া, পেকুয়া ও টেকনাফ উপজেলার কয়েকটি জায়গায় ভেঙে যাওয়া বাঁধ আজও মেরামত করা হয়নি। কোথাও কোথাও বেড়িবাঁধ নেই। পাশাপাশি কিছু কিছু জায়গায় মাত্র কয়েক কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে মাটি ও বালুর বস্তা ফেলে ‘নামকা ওয়াস্তে’ সংস্কার করা হয়।

এ ছাড়া ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ৩২ বছর পরও চকরিয়া-পেকুয়া অংশের উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ অরক্ষিত থেকে গেছে। এই দুই উপজেলার অনেক অংশে এখন বড় জোয়ার এলেও পানি ঢুকে যাচ্ছে লোকালয়ে। ফলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের খবর শুনলেই আতঙ্কে দিন কাটছে লাখো মানুষের।

আতঙ্কিত মানুষ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়বে কীভাবে। সময় আসছে মানুষের বাঁধ মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার। জনগণকে নিয়ে জনগণের মালিকানায় বাঁধ নির্মাণ ও বাঁধের পুনর্বাসন।


গওহার নঈম ওয়ারা : গবেষক

Nayeem 5508 @gmail.com