ভালোবাসার আহ্বান

১৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়ছবি : প্রথম আলো

আমার আর আপনার পছন্দ-অপছন্দ দুটোই থাকতে পারে। সেটা প্রকাশ করাই তো বাক্‌স্বাধীনতা। ভাঙচুর, আগুন, গুলি কিংবা মানুষ পুড়িয়ে মারার ‘স্বাধীনতা’ পৃথিবীর কোনো সংবিধানেই নেই। এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন সন্ত্রাসীরাও প্রকাশ্যে করে না। ধরুন, আমার ইচ্ছা হলো কোনো সন্ত্রাসীকে ধরে পেটাতে, সে–ও তখন বলবে, ‘আইন থাকতে আমাকে মারলে হবে?’

ভারত-পাকিস্তানপন্থী আবেগের রসায়ন নিয়ে খেলতে গেলে বড়জোর ক্রিকেট বা হকি পর্যন্ত জমে। এর বেশি টানাটানি মানে আসলে নিজের পেটেই লাথি মারা। ইতিহাসকে যদি চাপিয়ে দেওয়া গপ্পে সীমাবদ্ধ না রাখি, তাহলে ভিন্ন এক চিত্র দেখি। ১৯৪৭-এর আগেই ব্রিটিশ শাসনের পাশাপাশি আঞ্চলিক পুঁজিপতিদের নিষ্পেষণ থেকেও মুক্তি ছিল পুরো উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের দাবি। আমাদের মা-নানি, বাপ-দাদারা ব্রিটিশকে খেদিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পূজে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ মনোভাব। ঠিক যেমন আমরা ফ্যাসিস্টকে খেদালাম অথচ ফ্যাসিজমেরই পূজা করে যাচ্ছি।

সংগীতশিল্পী কৃষ্ণকলি ইসলাম

এবার একটা আলাদা কথা তুলি। শিশুদের শরীরে প্রতিদিন নতুন কোষ তৈরি হয়, তাই তারা শারীরিকভাবে এত চঞ্চল। কাঁথার মধ্যে শুয়েও হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে; কারণ, তাদের ভেতরে শক্তির আধিক্য। বিজ্ঞান বলে, ২৫ বছর পর শরীর আর বাড়ে না, কিন্তু মগজ কাজ করে যায় মৃত্যুর আগপর্যন্ত। আমার মগজ যেমন শুধু ভালোবাসতে চায়, ভালোবাসা খোঁজে। শুধু আমার ২৫ বছরের মেয়ের কাছ থেকেই নয়। যেদিন আমি মা হয়েছি, সেদিন খুব সহজে বুঝেছি, আমার মা কেন এত শিক্ষার্থীকে ভালোবাসতেন। তিনি শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিলেন মা। একদিন মা বলেছিলেন, ‘মা হওয়া খুব সহজ। দেখিস, বাচ্চা প্রসব না করেও অনেক মা আছেন, আবার এক ডজন বাচ্চা জন্ম দিয়েও কেউ কেউ মা নন।’

এ ছাড়া মায়ের বাৎসরিক প্রজেক্ট থাকত—ভ্যানচালক (যাঁর নাম এখন মনে নেই), মোশাররফ ভাই, করিমন আপু—এমন শত শত মানুষ। তখন খুব রাগ হতো। আজ আর কারও ওপর রাগ হয় না, নিজের পেট ছাড়া। কারণ, মা-বাপ হওয়াও একধরনের ইনভেস্টমেন্ট। যেন কাউকে জিজ্ঞেস করেছি—আমার পছন্দ অনুযায়ী তোকে বড় হতে হবে। তাহলে আমিই জন্মাতাম না।

আমি রিকশা, বাইক, উবারে চড়ি। আমার এলাকার মাছওয়ালা, সবজিওয়ালা, মুচি, বাদাম-মুড়ি মাখানোওয়ালা, মুদির দোকানদার, গৃহসহকারী—সবার সঙ্গেই ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক। তাঁদের সবার মতো আমরাও খেটে খাওয়া মানুষ। আমরা কোনো দিন শান্তি-সম্মান পাইনি। আজ পোড়ালে কাল খাব কী? নতুন খবরের কাগজ বিক্রি শেষে বাকি কাগজ কাপড়ের বাজারে বিক্রি হয়। নিজেদের গোছাতে কত কাজ আমাদের! প্রিয় বাচ্চারা, দুষ্টুমি ঠিক আছে, কিন্তু বড় ভয়ে ভয়ে লিখছি, মা হিসেবে এটা ঠিক কি না, কথা কই না।

জনাব,

মব ও মবারুরা, সালাম নেবেন। মানে শান্তি বর্ষণের প্রার্থনা করি, বিনিময় করবেন যদি পারেন। লক্ষ করছি, নিজের কাছেই আপনারা বড় ছোট হয়ে যাচ্ছেন। নিজের চোখে চোখ রাখতে আপনাদেরও স্বস্তি হচ্ছে না। দিন শেষে আপনিও মানুষ। আমি জানি, ভুল করেও আপনি গান গুনগুন করেন, পাখির শিসে মুগ্ধ হন। কিন্তু পাখির গলা তো টিপে মারা হচ্ছে না, তাই না? অথচ বুকের ভেতর যে ‘মা’ ডাকার সুর, সেটা থামাতে মাথার ভেতর স্বার্থের উত্তেজনা আর সেই ব্রিটিশ-ফ্যাসিস্ট মনোভাব ধরে রাখতে এজেন্টরা আপনার মগজ নিয়ে খেলছে। এবার আপনি নিজেই বুঝুন, আপনার মাথা আপনি কার কাছে বন্ধক রাখবেন।

আমরা চাইলে আনন্দ ও শান্তি উদ্‌যাপন করতে পারি, না চাইলে আতঙ্ক নিয়ে মরার মতো বাঁচতেও পারি। মান্দি জনগোষ্ঠীর একটি গান আছে—

‘চলো সবাই শিয়নপুরে (মরণের ওপারে) যাই,

এই দেশে আর থাকব নারে ভাই।

দেশের রাজা ভালো না,

দেশের প্রজা ভালো না।

যেমন রাজা তেমন প্রজা,

বিচার ভালো না।’

আমরা আমাদের আচার, বিচার ও জীবনের গুরুত্ব নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারি, যদি নিজের মনের আয়নাটা নিজের চোখের সামনে ধরে রাখতে পারি। শুভকামনা, ভালোবাসা আর আশীর্বাদ ছাড়া আর কীই–বা চাইতে পারি বা দিতে পারি? আমাদের দেশ তো হলো। তাকে আদর-যত্ন করার সময় হলে দেখি—পৃথিবীর সব দেশ নিয়েই আমার-আপনার মনোযোগ। হিটলার যেমন গালি, ইসরায়েলও। আসলে আমরা সবাই মানুষকে ভালোবাসি, কিন্তু বেখেয়ালে গাছ-নদী-প্রাণী-প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাই। যত মনোযোগ সেখানে দেব, মন তত আনন্দ পাবে।

‘আগেই ভালো ছিলাম’ বলার প্রজেক্টে কেউ অংশ নেবেন না।

এসো, কাছাকাছি থাকি। ভালোবাসি।

পছন্দ-অপছন্দ বলতে দিই, ঝগড়া না করি।

স্পষ্ট উচ্চারণই নিজের মত জানানোর জন্য যথেষ্ট, এটাই আমার বিশ্বাস।

কৃষ্ণকলি ইসলাম সংগীতশিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী

*মতামত লেখকের নিজস্ব