ঢাকার ঈদ বনাম ফেলে আসা মফস্‌সলের ঈদ

ঈদের আনন্দে মেতে উঠতে খেলনা কিনছে শিশুরা
ছবি : প্রথম আলো

পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনটি কেটে গেল। এ লেখা যখন লিখতে বসেছি, তখন রাত ৯টা ১৫ মিনিট। আরও ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট বাকি আছে। তবে ঈদের দিনটিকে কেবল ২৪ ঘণ্টার একটি দিন হিসেবে মনে না করা ভালো। তাতে বরং আক্ষেপ বাড়ে। ‘আনন্দক্ষণ’ যত দীর্ঘায়িত করা যায়, ততই মঙ্গল।

ঈদে দেশের মানুষ আনন্দে আছে কি নেই, সে প্রশ্ন তোলা এ রচনার উদ্দেশ্য নয়। আজ বরং ঈদ ঘিরে একটু স্মৃতিকাতর হওয়া যাক। কেননা, স্মৃতি বেদনার হলেও তার মধ্যে একধরনের প্রাপ্তি আছে। যে প্রাপ্তি কখনো কখনো অনির্বচনীয় আনন্দেরও উৎস।
চার শ বছরের এই শহর ঢাকায় এই লেখকের বসবাস সিকি শতাব্দীর কিছু বেশি।

যেখানে জন্ম, সেই বাগেরহাট জেলায় কেটেছে স্কুল ও কলেজের দিনগুলো। এরপর এই শহরে লেখাপড়া করতে আসা। লেখাপড়া করতে করতেই কর্মজীবন, সংসারজীবন। একেকটা দিন গত হচ্ছে কেবল। এমন জীবনযাপন নিয়ে নিজের লেখা কবিতার ভাষায় বলতে হয়, ‘প্রবেশের পথ আছে, ম্রিয়মাণ রোদ পড়া/ বেরোনোর পথের দেখা নেই,/ প্রজ্বালন নেই, শিহরণ নেই/ এ এক জীবনযাপন, অদ্ভুত লেপটে যাওয়া।’

২.

ঈদে গ্রামে যেতেই ভালো লাগে। ঈদের আরেকটা মানে হয়তো বাড়ি যাওয়া। তবু গত ২৫ বছরের মধ্যে অন্তত ১০ থেকে ১২টি ঈদুল ফিতর কেটেছে এই শহরে। বাগেরহাট থেকে পাঁচটি নদী পার হয়ে এই শহরে আসা আমি কখনো কখনো যাত্রাপথের বিরাট কষ্টের কথা চিন্তা করে রয়ে গেছি এই শহরে। এমনকি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে হাজী মুহসীন হলের ৪৬০ নম্বর কক্ষের বাসিন্দা ছিলাম, তখনো দুই থেকে তিনবার ঈদ করেছি সেই শূন্য ভিটায়। কেন করেছি, সে প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। ঢাকায় ঈদ যে খারাপ কেটেছে, কখনো তা বলতে চাই না। ঢাকায় ঈদ যেন বৃহত্তর মানুষের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া, মহামিলনের মাঝে নিজেকে সমর্পণ।

তবু মন কেন পড়ে থাকে জোড়া কদমগাছের তলায় বানানো বেদিতে! ঈদের নামাজ পড়ে ওই বেদিতে গিয়ে বসে আছি। সামনের দোকান থেকে এল লাল চা। আশপাশে কত মানুষ, ভাই-বেরাদার।

অনেকেই গত হয়েছেন। যাঁরা তরুণ ছিলেন, আজ তাঁরা সাদা চুল–দাড়ির মুরব্বি। যে নারকেলগাছটি ডাগর ছিল, আজ তাঁর মরমর দশা। যেখানে ছিল মাটির ঢিবি, ডুঙ্কর ফলের ঝোপঝাড়, যে দেবদারুগাছে ভূতেরা বসবাস করত, আজ সেখানে সব সাফ-সুতরো করে জামিলা-রেজাউলদের জমাট সংসার। যতই খারাপ হোক, সেখানে ফিরে যেতে মন চায় বারবার।

কেমন ছিল সেই সময়ের ঈদ? নব্বই দশকের গোড়ার কথা যদি মনে করার চেষ্টা করি, তবে বলতে হবে, ঈদের নামাজ পড়ার পরে দিনটির আর কোনো অবয়ব চোখে ভাসত না। সালামি বা ঈদি, এমন কোনো শব্দের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত ছিলাম বলে মনে পড়ে না। ঈদমেলা নামে কিছু শুনিনি।

৩.

বাগেরহাটের জনপদে কেমন ছিল নব্বই দশকের ঈদ। তখন আমরা নিতান্তই স্কুলবালক, সব কথা আজ মনে নেই।

তার আগে যে কথাগুলো মনে আসছে, তা বলে নেওয়া যাক। শত শত বিল-বাঁওড়ে পরিপূর্ণ একটি জেলা ছিল বাগেরহাট। এসব বিল ছিল দেশি মাছের আঁধার। শামুক-ঝিনুকে ভরা এসব বিলে শীতকালে প্রচুর পাখি আসত। বর্ষা-শরতে এসব বিল লাস্যময়ী হয়ে উঠত পদ্ম-শাপলার হাসিতে। হাজারো প্রজাপতি উড়ে বেড়াত, ঘুরে বেড়াত।

৯০-এর পর জেলাটিতে বাণিজ্যিকভিত্তিক চিংড়ি চাষ শুরু হলো। সাফ হতে থাকল একের পর এক বিল। বসত হারাল দেশি মাছ। এলাকার মাঠ থেকে ফুটবল খেলা হারাতে লাগল। কারণ, তত দিনে যুবক শ্রেণির বড় অংশটি চিংড়ির ব্যবসায় নেমে পড়েছে। সবার হাতে কাঁচা টাকা। যিনি বেশি টাকা আয় করছেন, ভাগনেদের কাছে তাঁর নতুন নাম হলো ‘ডলার মামা’। মানুষের অভাব দূর হতে লাগল। কাঠ-টালির ঘরের বদলে পাকা বাড়ি। বাইসাইকেলের বদলে মোটরসাইকেল।

এভাবে চলে এল শূন্য দশক। তারপর আরও কত বছর গেল। সবই আছে, তবু কি যেন নেই গ্রামীণ জনপদে। এটাই যেন দস্তুর!

আরও পড়ুন

৪.

কেমন ছিল সেই সময়ের ঈদ? নব্বই দশকের গোড়ার কথা যদি মনে করার চেষ্টা করি, তবে বলতে হবে, ঈদের নামাজ পড়ার পরে দিনটির আর কোনো অবয়ব চোখে ভাসত না। সালামি বা ঈদি, এমন কোনো শব্দের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত ছিলাম বলে মনে পড়ে না। ঈদমেলা নামে কিছু শুনিনি।

তবে ঈদের আগে স্থানীয় বাজারগুলোতে একটা আবহ ফুটে উঠত। নতুন শার্ট, প্যান্ট বাজারে উঠত। যেসব পরিবারের কর্তা সরকারি চাকরি করতেন কিংবা ব্যবসা, তাদের পরিবারের সন্তানেরা ‘খুলনায় মার্কেটিং’য়ে যেত।

তবে এখনো সমান আগ্রহ, আগেও ছিল, তা হলো ঈদের নামাজ পড়তে বাগেরহাট সদরে ষাটগম্বুজ মসজিদে যাওয়া। এই একটা ব্যাপার এখনো ভালো লাগে।

এই ক্ষুদ্র লেখক এবারও ঈদ করেছেন ঢাকা শহরে। সব মিলিয়ে ঈদ উদ্‌যাপন ভালোই হয়েছে। তবু মন পড়ে ছিল সেই কদমগাছের তলায় বানানো বেদিতে।

  • কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
    [email protected]

আরও পড়ুন