বুড়িয়ে যাওয়া চীনের পক্ষে কি ধনী হওয়া সম্ভব

চীনের শ্রমশক্তিতে বয়স্ক মানুষের অংশীদারি বেড়ে যাচ্ছেছবি: রয়টার্স

চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং গত মার্চ মাসে ২০২৪ সালে ৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করেছিলেন। এরপর বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাস্টিন ইফু লিন সরকারের এই লক্ষ্যকে সমর্থন করে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, চীনের অর্থনীতি আগামী দশকজুড়ে গড়ে বার্ষিক ৫ থেকে ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে এবং ২০৩৬ থেকে ২০৫০ সাল নাগাদ তার প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হয়ে ৩ থেকে ৪ শতাংশে নেমে আসবে।

লিন আরও মত দিয়েছেন, ২০২৫ সালের মধ্যে সম্ভব না হলেও ২০২৬ সালে চীন উচ্চ আয়ের অবস্থা অর্জন করতে পারবে। তবে চীনের জনসংখ্যাগত অবস্থা বিবেচনায় নিলে এই অর্জন প্রায় অসম্ভব বলে মনে হবে।

কোনো অর্থনীতিতে ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের অংশীদারি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলে সেটিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অর্থনীতির বার্ধক্য পর্যায়ের সূচনাবিন্দু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। আর চীন এই অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল সেই ১৯৯৮ সালে। ২০২৩ সালে দেশটির অর্থনীতিতে ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের অংশীদারি বেড়ে ১৫ দশমিক ৪ শতাংশে উঠেছে।

আরও পড়ুন

ঐতিহাসিকভাবে দেখা গেছে, জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ বুড়িয়ে যাওয়ার পরবর্তী ১২ বছরে কোনো দেশের পক্ষে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয় না। এই সময়ের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশগুলোর গড় প্রবৃদ্ধির হার হয়েছে মাত্র ১.৮ শতাংশ।

আমরা জানি, একটি বার্ধক্যবহুল জনসংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন, ভোগ, শিল্পোদ্যোগ ও উদ্ভাবনকে প্রভাবিত করে এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতাকে নষ্ট করে দেয়। আর অর্থনীতিতে মধ্যবয়সী ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের অংশীদারি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিডিপি বৃদ্ধির গতিও কমে যায়।

ফলে ২০২৪ এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে চীন ৫ থেকে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে থাকবে বলে লিন যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, তা ৮০ বছরের বৃদ্ধের ম্যারাথন জয়ের মতোই অসম্ভব। লিন অর্থনৈতিক দৌড়ে চীনের দেরিতে আসার সুবিধার ওপর জোর দিয়েছেন, কিন্তু চীনের পাওয়া সেই সুবিধা তার দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া জনসংখ্যার ভারে মিইয়ে যাচ্ছে।

ঐতিহাসিক প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, চীনের প্রবৃদ্ধির হার ২০২৮ সালের মধ্যে ধীর হতে হতে ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে এবং ২০৩১ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম হতে থাকবে। ফলে চীনের শ্রমশক্তিতে বয়স্ক মানুষের অংশীদারি বেড়ে যাওয়া দেশটির ধনী হওয়ার পথে বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

জনসংখ্যাগত সমস্যা এবং সংকুচিত শ্রমশক্তির কারণে ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্তরের তুলনায় স্পেনের মাথাপিছু জিডিপি ৭৩ শতাংশ থেকে ৩৯ শতাংশে, গ্রিসের মাথাপিছু জিডিপি ৬৬ শতাংশ থেকে ২৭ শতাংশে এবং পর্তুগালের মাথাপিছু জিডিপি ৫১ শতাংশ থেকে ৩২ শতাংশে নেমে এসেছে। চীনের বার্ধক্যজনিত বর্তমান সংকট জাপান এবং জার্মানিতে যা ঘটেছিল, তার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ১৯৯০–এর দশকের মাঝামাঝি থেকে এসব দেশের শ্রমশক্তি সংকুচিত হতে শুরু করেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের স্তর অনুযায়ী ১৯৯৫ সালে জাপানের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ১৫৪ শতাংশ এবং জার্মানির মাথাপিছু জিডিপি ছিল ১১০ শতাংশ। ২০২৩ সালে তা যথাক্রমে ৪১ শতাংশ ও ৬৪ শতাংশে নেমে এসেছে।

একইভাবে ১৯৯৫ সালে জাপানের যে গড় বয়স ছিল, চীনের গড় বয়স ২০২৩ সালে ছিল একই রকম। এ ছাড়া ২০০০ সালে জার্মানির যে গড় বয়স ছিল, ২০২৩ সালে ঠিক একই গড় বয়স ছিল চীনের। ১৯৯৬ সালে জাপানে শ্রমশক্তিতে ৬৫ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সীদের যতটা অংশগ্রহণ ছিল, ২০২৩ সালে চীনের তেমন অংশগ্রহণ ছিল। একই চিত্রে ১৯৯৫ সালের জার্মানির সঙ্গে ২০২৩ সালের চীনের মিল রয়েছে।

এই জনসংখ্যার মাইলফলকগুলো অনুসরণ করে ১২ বছর ধরে জাপানের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ০.৪ শতাংশ এবং জার্মানির ছিল ১.৪ থেকে ১.৫ শতাংশ।

এই ঐতিহাসিক প্রবণতার ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, চীনের প্রবৃদ্ধির হার ২০২৮ সালের মধ্যে ধীর হতে হতে ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে এবং ২০৩১ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে চীনের প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম হতে থাকবে।

ফলে চীনের শ্রমশক্তিতে বয়স্ক মানুষের অংশীদারি বেড়ে যাওয়া দেশটির ধনী হওয়ার পথে বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

● উই ফুসিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগবিদ্যার একজন সিনিয়র বিজ্ঞানী ও বিগ কান্ট্রি উইথ এম্পটি নেস্ট (চায়না ডেভেলপমেন্ট প্রেস, ২০১৩) বইয়ের লেখক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত