পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন মিয়ানমারের ফাঁদে পা দিল

প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাইয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে মিয়ানমারের ২২ সদস্যের প্রতিনিধিদল। ১৫ মার্চ সকালে
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি মিয়ানমারের সামরিক জান্তার একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছে। এক হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা প্রায় সাত শ জনকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করেছে। এর আগে মিয়ানমার সরকারের তরফে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে পর্যায়ক্রমে প্রত্যাবাসনের ইচ্ছা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।

সেখানে বলা হয়েছিল এ পদক্ষেপের পেছনে চীনের কূটনৈতিক মধ্যস্থতা কাজ করছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৎপর হয়ে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশীদার হয়েছে এবং সে কারণেই মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফর ও ক্যাম্পে বাছাই করার মতো ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য আন্তর্জাতিক পর্যায় ও রোহিঙ্গাদের জোর আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ এ প্রক্রিয়া থেকে সরে এসেছে।

এর আগে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামার তিন মাসের মাথায় মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্বাক্ষরের পর আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোয় আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মিয়ানমার গত পাঁচ বছরে শরণার্থীদের ফেরত নেওয়ার উদ্যোগ নেয়নি। সেই পুরোনো সমঝোতাকাঠামোর আওতাতেই এবারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। তবে এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলছেন অন্য কথা। তিনি বলেছেন, জাতিসংঘ বা আসিয়ানের মতো সংস্থা এ প্রক্রিয়ায় সমর্থন দেয়নি এবং যেহেতু তাদের মধ্যস্থতার প্রয়োজন, তাই এ পরিকল্পনা বাতিল করা হয়েছে। অন্যদিকে জাতিসংঘ বলেছে, এ ধরনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংস্থাটি যুক্ত নয়। কারণ, তাদের মতে রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি।

এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের এই নতুন দ্বিপক্ষীয় পদক্ষেপে সম্মতি দিল কেন? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন বা সমর্থন না থাকলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার প্রতিনিধিরা ঘটা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘোষণা দিয়ে শরণার্থীশিবির পরিদর্শন করেন কীভাবে? এ পদক্ষেপ যে মিয়ানমারের একধরনের ফাঁদ, তা আমাদের বুঝতে এত দেরি হলো কেন? মিয়ানমারের এ পদক্ষেপ যে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চোখে ধুলা দেওয়ার চেষ্টা, তা বুঝতে তো বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি বিষয়টি বুঝেও বুঝতে চায়নি, নাকি অন্য কোনো কারণে ‘ঢোঁক গিলতে’ হয়েছিল।

মিয়ানমারের বর্তমান সামরিক সরকারকে বিশ্বাস করার মতো কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, এমন বলা যাবে না। তাদের হাতেই ২০১৫-১৭ সালে রোহিঙ্গারা নির্যাতন ও নিধনযজ্ঞের শিকার হয়ে রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। এই জান্তাপ্রধানের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের বসতবাড়িগুলো জমিনের সঙ্গে মিশিয়ে ওই সব জায়গায় এখন পুলিশ আর সেনাছাউনি তৈরি করা হয়েছে। মিয়ানমার সরকার যদি রোহিঙ্গাদের অধিকার ফিরিয়ে পুনর্বাসন করতে সত্যিই আগ্রহী হতো, তাহলে দক্ষিণ রাখাইন অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করা প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গাকে তারা আগে পুনর্বাসনের পদক্ষেপ নিত। সেটা না করে তারা যখন হঠাৎ বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে উদ্যোগী হয়ে ওঠে, তখন বুঝতে হবে এর পেছনে নানা কিছু কাজ করছে।

রোহিঙ্গা সংকট আমাদের সৃষ্ট নয়, মিয়ানমারের সৃষ্টি। এর সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। বাংলাদেশ যতটুকু করার করছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আন্তর্জাতিক সহায়তায় পুনর্বাসনের জন্য অবশ্য চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। জাতিসংঘকে এ উদ্যোগে যুক্ত করার চেষ্টা থাকতে হবে। এ সমস্যা বর্তমানে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের সম্ভাবনা কম। রোহিঙ্গা সংকট যেহেতু এখন এ অঞ্চলের ভূরাজনীতির আবর্তের মধ্যে পড়েছে, তাই এ সংকট সহজে সমাধান হবে বলে মনে হয় না।

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখলের পর মিয়ানমারের সামরিক শাসকেরা সাধারণ মানুষের ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছেন। শুধু প্রান্তিক ও উপজাতীয় গোষ্ঠীরই নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী বার্মার জনগোষ্ঠীও বিরোধিতার মুখে পড়েছে।

অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত নির্বাচিত দল এনএলডি এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলো শুধু বিরোধিতাই নয়, বিকল্প প্রবাসী সরকার ও ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) গঠন করেছে। এনইউজি মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিত পেয়েছে। তাদের তত্ত্বাবধানেই গঠিত হয়েছে সশস্ত্র ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)’। যারা ইতিমধ্যে মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সহায়তায় সরকারি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে এবং বহু অঞ্চল এখন পিডিএফ ও সহযোগীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

শুধু পিডিএফ নয়, মিয়ানমারের বহু অঞ্চলে অনেক সশস্ত্র গোষ্ঠী স্বায়ত্তশাসন অথবা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। রাখাইন অঞ্চলে এমনই এক শক্তিশালী বাহিনীর নাম আরাকান আর্মি (এএ)। তাদের রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার সশস্ত্র সদস্য। রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ও অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এএ-এর রাজনৈতিক সংগঠনের নাম ‘ইউনাইটেড আরাকান লিগ (ইউএএল)’। এর আগেও বহুবার লিখেছি যে ভবিষ্যতে রাখাইনে পুরোনো বাসস্থানে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসিত হওয়ার পথে এএ এবং ইউএএল হবে অন্যতম শরিক। তাদের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছাড়া রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিতে পুনর্বাসন করা সম্ভব নয়। সময়ের বিবর্তনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার চেয়ে এএ আরাকানের নিয়ামক হয়ে উঠছে।

আরও পড়ুন

আরাকান আর্মিকে (এএ) চীনের সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী মনে করা হলেও ইদানীং এ সংগঠন পশ্চিমা–সমর্থিত এনইউজিকে সমর্থন করার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়েছে। মিয়ানমারজুড়ে সামরিক সরকারকে প্রায় ১৪টি বৃহৎ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আরাকান আর্মিকে বাদ দিয়ে সমষ্টিগতভাবে তাদের বলা হয় ‘কে-৩’। কে-৩ পিডিএফ এবং এনইউজির পালে নতুন ও শক্ত হাওয়া লেগেছে ২০২১ সালের ‘বার্মা অ্যাক্ট’ ২০২৩-এ যুক্তরাষ্ট্র সিনেট কর্তৃক পাস এবং প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জারি হওয়ার পর।

বার্মা অ্যাক্টের মূল বিষয় হচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকারসহ তাদের দ্বারা পরিচালিত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসহ সেনা অভ্যুত্থানকারীদের বিরুদ্ধে অবরোধ এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা। এ অ্যাক্টে মিয়ানমার সামরিক জান্তাকে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়েছে এবং ‘রোহিঙ্গা’ গণহত্যার বিশদ বিবরণ সেখানে রয়েছে। এ অ্যাক্টে স্পষ্টভাবে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দ ব্যবহার করে তাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে অন্যান্য গোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। এ ‘অ্যাক্ট’ আরাকান অঞ্চলেও বিশেষভাবে প্রযোজ্য হবে, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতে বদ্ধপরিকর।

তারা মিয়ানমারে পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র ও ফেডারেল কাঠামোর প্রবর্তন দেখতে চায়, যার মাধ্যমে চীনের প্রভাব কমবে। অন্যদিকে চীন মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠী থেকে অনেক বিষয়ে কিছুটা দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। চীন সরাসরি এনইউজিকে সমর্থন করবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার না হলেও জান্তাবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। বার্মা অ্যাক্ট অবশ্যই এ অঞ্চলে চীনের ভূরাজনীতির ওপর চাপ তৈরি করেছে। বার্মা অ্যাক্টে আরাকান ও সান স্টেট গুরুত্ব পাওয়ায় বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন

বর্তমান বাস্তবতায় রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু মিয়ানমার-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সমস্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ‘রোহিঙ্গা’ সংকটের ব্যাপ্তি বর্তমানে বহুমুখী। দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চেষ্টা সফল হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না। চীন তার নিজের তাগিদেই হয়তো এককভাবে মধ্যস্থতা করতে চাইবে। মিয়ানমারের জান্তার এ প্রয়াস ছিল তাদের ওপর চাপ প্রশমিত করার প্রচেষ্টা। আমরা হয়তো জেনেও এ ফাঁদে পা দিয়েছি।

রোহিঙ্গা সংকট আমাদের সৃষ্ট নয়, মিয়ানমারের সৃষ্টি। এর সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। বাংলাদেশ যতটুকু করার করছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে আন্তর্জাতিক সহায়তায় পুনর্বাসনের জন্য অবশ্য চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। জাতিসংঘকে এ উদ্যোগে যুক্ত করার চেষ্টা থাকতে হবে। এ সমস্যা বর্তমানে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের সম্ভাবনা কম। রোহিঙ্গা সংকট যেহেতু এখন এ অঞ্চলের ভূরাজনীতির আবর্তের মধ্যে পড়েছে, তাই এ সংকট সহজে সমাধান হবে বলে মনে হয় না।

  • ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

    [email protected]