দুই কাদেরের ‘বাগ্‌যুদ্ধ’

আওয়ামী লীগের এক বন্ধু টেলিফোন করে খানিকটা খেদের সঙ্গে বললেন, ‘নির্বাচনের আগে তোমরা নির্বাচন ঠেকানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেও পারোনি। গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনটি হয়ে গেছে। এখন এ নিয়ে বেশি লেখালেখি করে বা কথা বলে লাভ কী। বরং দেশে আরও অনেক সমস্যা আছে, সেসব নিয়ে লেখো।’

বন্ধুটি পুরো সত্য বলেননি। অর্ধ সত্য বলেছেন। আমরা কেউ নির্বাচন ঠেকানোর কথা বলিনি। বলেছি, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনটি হোক, যেখানে ভোটাররা তাঁদের পছন্দসই প্রার্থী বেছে নিতে পারবেন। পছন্দসই প্রার্থী মানে এক দলের একাধিক প্রার্থীর মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেওয়া নয়, একাধিক দলের প্রার্থীদের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেওয়া। 

ভোটাররা বাছাই করার সুযোগ পাননি বলে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ঢাকা শহরে ১০ থেকে ১৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি। আওয়ামী লীগের সমর্থক ভোটার কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। ভোটের দিন তাঁরা কোথায় ছিলেন? সরকারি দলের সমর্থকেরাও কি তাহলে নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারিয়েছেন?

এর আগে একাদশ সংসদে ঢাকা-১৭ ও চট্টগ্রাম-১০-এর উপনির্বাচনে ভোট কম পড়ায় বেশ সমালোচনা হয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছিলেন, উপনির্বাচনে ভোটাররা আগ্রহ দেখান না। তাহলে কি দলের কর্মী-সমর্থকেরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেও ‘উপনির্বাচন’ হিসেবে নিয়েছেন? 

আওয়ামী লীগের বন্ধুটি নির্বাচন নিয়ে কম কথা বলতে বললেও এ নিয়ে কথা ঠিকই চলতে থাকবে। যেমন ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচন নিয়ে এখনো মানুষ কথা বলছে। মজার বিষয় হলো, নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের নেতারা যেমন বিদেশিদের দোহাই দিতেন, নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের নেতারা একই কাজ করছেন। কতটি দেশ নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানাল, কতজন কূটনীতিক সংসদের প্রথম অধিবেশনে যোগ দিলেন, তাঁরা তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে প্রচণ্ড রেষারেষি চলে আসছে তিন দশক ধরে, জাতীয় পার্টি সেই সুযোগটি হাতছাড়া করেনি এবং এখনো করছে না। বিএনপি নির্বাচনে না আসায় কেবল আওয়ামী লীগেরই সুবিধা হয়নি, জাতীয় পার্টিও বিরোধী দলের মুকুটটি পরেছে। বিএনপি নির্বাচনে এলে প্রধান দুই দলের মধ্যে সরকারি ও বিরোধী দল নির্ধারিত হতো। তখন যত আসনই পাক না কেন, জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হতো না। 

নির্বাচনের পর সংসদে বিরোধী দলের নেতা কে হবেন, তা নিয়ে বিতর্ক ছিল। জাতীয় পার্টি সাকল্যে ১১টি আসন পেয়েছে। স্বতন্ত্র সদস্যরা পেয়েছেন ৬২টি। সে ক্ষেত্রে তাঁদের পাল্লাই ভারী। কিন্তু সমস্যা হলো, তাঁরা নির্বাচন করেছেন ব্যক্তি হিসেবে, দলের পরিচয়ে নয়। জাতীয় পার্টি নির্বাচন করেছে দলীয় প্রতীকে। তা ছাড়া স্বতন্ত্রদের দু-একজন ছাড়া সবাই নিজেদের আওয়ামী লীগ পরিচয়েই থাকতে চান। এমনকি তাঁদের প্রাপ্য সংরক্ষিত ১০টি আসন নির্ধারণের ভারও তাঁরা সংসদ নেতার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। 

শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির প্রধান জি এম কাদের সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন। আগের সংসদে ছিলেন উপনেতা। ৩০ জানুয়ারি অধিবেশনের প্রথম দিন তিনি কামান দাগতে না পারলেও সরকারি দলকে খোঁচাটা ঠিকই দিয়েছেন। তিনি বলেন, বর্তমান সংসদে ভারসাম্য রক্ষা হয়নি। এখানে প্রায় ২১ শতাংশ স্বতন্ত্র, ৭৫ শতাংশ সরকারদলীয় আর মাত্র ৪ শতাংশ বিরোধীরা; এই সংসদ কতটুকু ফাংশনাল হবে?

বিরোধী দলের নেতার ভাষ্য, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ কখনো নিখুঁতভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে না।...এই সংসদ জাতিকে কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে।...যদি সরকারি দলকে লাল বলি, তাহলে এ সংসদ সম্পূর্ণ লালময়। সবুজটা শুধু ছিটেফোঁটা। এ সংসদে সম্পূর্ণ জাতিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।’

পরদিন এ বিষয়ে সাংবাদিকেরা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘ফাংশনাল না হলে উনি কেন এলেন? কথা তো যা বলার উনি একাই বললেন। গতকাল (৩০ জানুয়ারি) কিন্তু আর কেউ; দেশের প্রধানমন্ত্রীও কথা বলেননি। শুধু আনুষ্ঠানিকতা, আমি শুধু প্রস্তাব (স্পিকার হিসেবে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর নাম প্রস্তাব) করেছি।’ তিনি যোগ করেন, ‘উনি স্পিকারকে ধন্যবাদ জানানোর নামে ফ্লোর নিয়ে শুরুটাই করলেন এমনভাবে যে একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবেন এবং লম্বা একটা বক্তৃতা দিলেন।’

সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে জি এম কাদের এসব কথা বলার উদ্দেশ্য কি নিজেকে ‘প্রকৃত’ বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দেখানো, না অন্য কিছু? জাতীয় পার্টি এখন বিভক্ত। নির্বাচনের সময় রওশনপন্থীরা চুপচাপ বসে থাকলেও নির্বাচনের পর তাঁরা সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেছেন। দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ নিজেকে চেয়ারপারসন ও কাজী মামুনুর রশীদকে মহাসচিব ঘোষণা করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি দিয়েছেন। শুক্রবার জাতীয় পার্টির কাকরাইল কার্যালয়ে ‘আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম’ শুরু করেছেন রওশন অনুসারীরা। এর আগে জি এম কাদের ও মুজিবুল হকের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ঢাকা মহানগরীর ৬৬৮ জন নেতা-কর্মী পদ্যাগ করেন। 

গত বুধবার জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির ১১ জন সংসদ সদস্য রংপুরে এরশাদের কবর জিয়ারত করেন। সেখানেও তিনি সরকারের মৃদু সমালোচনা করে বলেছেন, ‘দেশের ভেতরে অদৃশ্য রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। সাধারণ মানুষের আয় যেমন কমছে, জিনিসপত্রের দাম কমছে না।...নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় করতে না পারলে সরকারের সামনের দিনগুলো সুখকর হবে না।’

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ বললেও ফলাফলে হতাশ নন। তিনি বলেন, ‘২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টি ১৪টি আসনে জয়লাভ করে। ৩৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পরও এবার জাপা পেয়েছে ১১টি আসন। আমার মনে হয় না খুব বেশি ক্ষতি হয়েছে। যদিও এই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ।’

জাতীয় পার্টির লাভ-ক্ষতির হিসাবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো জি এম কাদেরের ভাষায় প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় সংসদ কতটা কার্যকর বা ফাংশনাল হবে? বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাসের চেয়েও করুণ হলো জাতীয় সংসদের ইতিহাস। পঞ্চম সংসদের আগে কোনো সংসদ মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে চারটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে, সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদও কার্যকর হতে পারেনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের একগুঁয়েমি, পরশ্রীকাতরতা ও হঠকারিতার কারণে। যত কম বা বেশি আসন নিয়ে সরকার গঠন করুন না কেন, ক্ষমতাসীনেরা প্রথম দিন থেকে সবকিছু দখল করতে চান। আর যাঁরা বিরোধী দলে থাকেন, তাঁরা রাজপথকেই দাবি আদায়ের একমাত্র উপায় হিসেবে বেছে নেন। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে এবং বিএনপি আওয়ামী লীগকে আক্ষরিক অর্থেই অনুসরণ করে চলেছে। 

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে প্রচণ্ড রেষারেষি চলে আসছে তিন দশক ধরে, জাতীয় পার্টি সেই সুযোগটি হাতছাড়া করেনি এবং এখনো করছে না। বিএনপি নির্বাচনে না আসায় কেবল আওয়ামী লীগেরই সুবিধা হয়নি, জাতীয় পার্টিও বিরোধী দলের মুকুটটি পরেছে। বিএনপি নির্বাচনে এলে প্রধান দুই দলের মধ্যে সরকারি ও বিরোধী দল নির্ধারিত হতো। তখন যত আসনই পাক না কেন, জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হতো না। 

গেল দুই সংসদে জাতীয় পার্টি ২৬ জন ও ২২ জন সদস্য নিয়েও ‘অনুগত’ ও ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। এবার ১১ জন নিয়ে কী করবে, সেটাই দেখার বিষয়।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]