সুস্থ সংস্কৃতি বনাম অপসংস্কৃতি এবং তরুণ প্রজন্মের গন্তব্য যখন বিদেশ

‘দোষ কি প্রিন্স মামুন ও লায়লার, না আমাদের কপালের’ লেখাটা পড়ে মনে হলো, আমাদের অনেকের কাছেই সুস্থ সংস্কৃতি ও অসুস্থ বা অপসংস্কৃতির ধারণা খুব পরিষ্কার নয়। শব্দবন্ধ কথার কথা হয়েই থেকে গেছে। মূলত সেই ভাবনা থেকেই এ লেখা।

আদি–অনন্তকাল ধরে প্রবহমান সামাজিক রীতিনীতি, আইনকানুন, অনুশাসন, বিনোদন অর্থাৎ সুস্থ মানসিকবৃত্তি, যা মানবিক গুণাবলি বিকাশে সহায়ক, তা-ই সংস্কৃতি।

সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে মানবকুল ও সমাজকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে চলার পাথেয় দান করে চলেছে। সুতরাং সংস্কৃতি সব সময়ই সুস্থ। আর তার ভুল ব্যবহার, ভুল চর্চা, অযৌক্তিক অন্তঃসারশূন্য জীবনাচরণকে সঠিক বলে প্রচার করার ফলে যা তৈরি হয়, সেটা সংস্কৃতি নয়।

যাকে আমরা অপসংস্কৃতি বা অসুস্থ সংস্কৃতি বলে বিফল চিৎকার করছি, এটি প্রচলিত পবিত্র সাংস্কৃতিক ধারাকে কলুষিত করার প্রয়াস; যা প্রতিনিয়ত আমাদের ধর্ম, সমাজ ও আপামর মানুষকে পঙ্কিল আবর্তে নিমজ্জিত করছে।

আরও পড়ুন

এখানে সংস্কৃতির অনুষঙ্গগুলোর ভেতরের কিছু বিষয়কে উল্লেখ করছি। এর মধ্যে রয়েছে ধর্ম, সমাজ, সংগীত, নাটক, শিক্ষা, খেলাধুলা ইত্যাদি।

প্রথমে ধর্মের ব্যাপারে আসা যাক। যার যার ধর্ম তার নিজের মতো করে সৎভাবে চর্চা করবে, যা কখনোই ভিন্নমতাবলম্বীদের আঘাত বা কষ্ট দেবে না। আমরা বিশ্বাস করি, কোনো ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থই মানুষ ও সমাজকে ভুল পথে চালিত করে না।

কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে পারি, ‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ।’ সুতরাং ধর্মের সুষ্ঠু ব্যবহার ও চর্চা সমাজকে সৎভাবে চলার নির্দেশনা দেয়। সুস্থ ও সৎ ধর্মাচরণ মানুষ ও সমাজকে সুন্দর, হানাহানিমুক্ত, মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন করে গড়ে তোলে। আর এটাই সংস্কৃতি।

সুস্থ, সুন্দর, সৎ ও শিক্ষিত মানুষ দ্বারা পরিচালিত সমাজ ও তাঁর অনুসারী আপামর মানুষ–অধ্যুষিত দেশ, যোগ্য মানুষের মূল্যায়নের নিশ্চয়তা, ন্যায়বিচার—এগুলো হচ্ছে সুস্থ সংস্কৃতির আরেক চাবিকাঠি।

আমরা জানি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করে চলে। এরা একে অন্যের পরিপূরক। প্রত্যেক মানুষের শিক্ষার অধিকার আছে। তাই সমাজের প্রতিটি স্তরে শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলেই তাদের হাত ধরে প্রকৃত সংস্কৃতিমান মানুষ সমাজে পাব। আর এটাই সুস্থ সংস্কৃতি।

এবার আসা যাক সংগীতের ব্যাপারে। সংগীতের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে দু-চার কথায় তা সম্ভব নয়। অনন্তকাল ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের চিত্তবিনোদনের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম সংগীত। সংগীত এক অমোঘ, অবিনাশী আন্তর্জাতিক মাধ্যম, যার ভাষা কোনো প্রতিবন্ধক নয়। সুর ও সংগীতের আবেদন ভাষা–জাতিনির্বিশেষে সবার কাছে সমান। আর এটাই সংস্কৃতি।

ওদিকে নাটকের দিকে যদি আমরা তাকাই—এটা জীবনের কথা বলে। সমাজের অন্যায়-অবিচার ও অনিয়মকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সুন্দর, সুস্থ ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণে সরাসরি ভূমিকা রাখে। আর সুন্দর মানুষ ও সমাজ গড়ে তুলতে সবল ও নীরোগ শরীর অনেক প্রয়োজন। কাজেই আমাদের খেলাধুলার গুরুত্ব বোঝা অনেক জরুরি।

আমরা যদি স্বাধীনতা-পূর্ববর্তীকাল থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল পর্যন্ত মোটামুটি ৩০ বছরের নাটক-সিনেমার কথা বলি, তাহলে বলতেই হয় আমরা অনেক কম সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থেকেও অসাধারণ সব প্রযোজনা-পরিচালনা দেখেছি। কিন্তু এখন কী দেখি? সস্তা, স্থূল, মেধাহীন, ভাঁড়ামি, যৌন সুড়সুড়িমূলক কিছু নির্মাণ, যা আমাদের সমাজকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। এটাই অপসংস্কৃতির চূড়ান্ত নিদর্শন।

এবার আসব এসব বিষয়কে কীভাবে কলুষিত করে আমাদের প্রচলিত সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা হচ্ছে, যাকে আমরা অসুস্থ সংস্কৃতি বা অপসংস্কৃতি আখ্যা দিয়ে নীরবে সহ্য করছি।

ধর্মকে কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নোংরা স্বার্থে ব্যবহার করে মানুষে-মানুষে, দেশে-দেশে হিংসা ও স্বার্থপরতার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের মধ্যকার ব্যবধান বাড়িয়েই চলেছি। এ কারণে মানবিক গুণাবলিবিবর্জিত এক অসহায় মানবসমাজ সৃষ্টি হচ্ছে, যা শুধু ধ্বংসকেই আহ্বান জানাচ্ছে। এটাই অপসংস্কৃতি।

শিক্ষিত, যোগ্য, গুণী ও সৎ মানুষের সঠিক মূল্যায়ন কি আমরা সমাজে করতে পারছি? তাঁদের যোগ্য মর্যাদা দিয়ে যোগ্য স্থানে আসীন করাতে পারছি? তাঁদের কর্মকাণ্ড ও দিকনির্দেশনা মাথায় রেখে সমাজ পরিচালনা করতে পারছি? প্রশ্নগুলোর উত্তর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘না’। আর এটাই অপসংস্কৃতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক। সমাজ অন্ধকারে ডুবে যায় এ কারণেই।

আরও পড়ুন

আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের প্রথম কথাই হলো ‘পড়ো’। সুতরাং বলা যেতেই পারে, শিক্ষা ছাড়া মানুষ তৈরি হয় না, তৈরি হয় না সুস্থ সমাজ। কিন্তু আমরা তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত সুশিক্ষার আলো আদৌ পৌঁছে দিতে পারছি কি? এ ব্যর্থতাই অসুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রচারে ভূমিকা রাখছে।

ওদিকে অসুস্থ, প্রশিক্ষণবিহীন, প্রচলিত ধারাবিরোধী সংগীত ও তাঁর অযৌক্তিক অতিমূল্যায়ন আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে আরও অনেক অনেক বছর। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, সংগীত ও শিল্পীদের অবমূল্যায়ন করে ভয়ংকর এক সাংস্কৃতিক আবহে ডুবে যাচ্ছি, যা অপসংস্কৃতির চরমতম নিদর্শন। প্রকৃত সংগীত, প্রশিক্ষিত শিল্পী ও দেশীয় সংগীতধারা মূল্যায়ন না করে আমরা (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া) আমাদের সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত করছি।

অবিভক্ত ভারতবর্ষ এবং তারপর বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘকাল ধরে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সমাজের প্রথিতযশা মানুষের জন্মদিন, মৃত্যুদিনকে উপলক্ষ করে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।

আরও পড়ুন

গুণীজনকে সম্মান জানানো, তাঁদের জীবনাদর্শ নিয়ে আলোচনা নতুন প্রজন্মকে সৎ পথে চলার প্রেরণা জোগায়। গুণী শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে গণমাধ্যম ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো, যা সমাজের সচেতন মানুষকে আনন্দ দিত।

আমরা জানি, প্রাচীনকাল থেকে সম্রাট, রাজা-মহারাজা, জমিদার, সমাজের গণ্যমান্য ধনবান মানুষ সমাজের শিল্পী, সাহিত্যিক ও কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করে তাঁদের শিল্পচর্চার পথ আরও গতিশীল করে তুলতেন, যা এখন প্রায় নেই বললেই চলে। কাজেই সেই প্রচলিত সুস্থ সংস্কৃতির ধারা আজ চরম বাধাগ্রস্ত।

এখন বিত্তবান ক্ষমতাশালীরা নিজেদের চিত্তবিনোদনের পথ পাল্টে ফেলেছেন। রুচিবিকৃতি নেমে গেছে চরম পর্যায়ে, যা থেকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অনুসরণ করার মতো কিছুই দিয়ে যেতে পারছি না।

যুগ যুগ ধরে যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক, সিনেমা, টেলিভিশন নাটক আমাদের মানসিক প্রশান্তির এক শক্তিশালী মাধ্যম। কিন্তু বর্তমান অবস্থা কেমন, সেটা বুকে হাত দিয়ে সাহস করে কয়জন বলতে পারবেন?

বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা যদি স্বাধীনতা-পূর্ববর্তীকাল থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল পর্যন্ত মোটামুটি ৩০ বছরের নাটক-সিনেমার কথা বলি, তাহলে বলতেই হয় আমরা অনেক কম সুযোগ-সুবিধার মধ্যে থেকেও অসাধারণ সব প্রযোজনা-পরিচালনা দেখেছি। কিন্তু এখন কী দেখি?

সস্তা, স্থূল, মেধাহীন, ভাঁড়ামি, যৌন সুড়সুড়িমূলক কিছু নির্মাণ, যা আমাদের সমাজকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। এটাই অপসংস্কৃতির চূড়ান্ত নিদর্শন।

এত অধঃপতনের মধ্যে একটু হলেও আনন্দ লাগে, আশা জাগায় দেশের ক্রীড়াক্ষেত্র। গত তিন দশকে বাংলাদেশের ক্রিকেট একটা সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। সেই সঙ্গে ফুটবলকে অবহেলা করে তাঁর অর্জিত জায়গা থেকে একটু হলেও নামানো হয়েছে। আবার রাজনীতির অকারণ করাল থাবাও ক্ষতবিক্ষত করেছে ক্রীড়াঙ্গনকে।

এই অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সব খেলাকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে বেশি ক্রীড়াবিদকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তাহলেই দেশের নতুন প্রজন্ম বিভিন্ন খেলায় উৎসাহী হয়ে ভবিষ্যতে পেশা হিসেবে নেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হবে।

কামনা করি, দেশ হোক সমৃদ্ধ। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে যোগ্য ও সৎ মানুষকে মূল্যায়ন করে দেশকে সমৃদ্ধ করি। কারণ, যোগ্যের মূল্যায়ন না করলে দেশে যোগ্য মানুষ তৈরি হয় না। নতুন প্রজন্মের মধ্যে একটা বিশাল অংশের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এখন বিদেশ।

আজ থেকে ১০ বছর আগেও যত মানুষ বিদেশে জীবনধারণ ও জীবিকা নির্বাহের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতেন, এখন তার চেয়ে ঢের বেশি ছেলেমেয়ে শিক্ষা অর্জন, জীবনধারণ ও জীবিকা নির্বাহের জন্য বিদেশে যেতে চাইছেন, নিজের দেশকে খালি করে।

এটা কেন হচ্ছে আমরা ভেবে দেখেছি কি? কারণ আর কিছুই নয়, নতুন প্রজন্মের কাছে এই বার্তা চলে যাচ্ছে যে এ দেশে সুকুমারবৃত্তি ও সৎপথে চলে আনন্দের সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। আর এমন বার্তা আমাদের দেশের জন্য ভালো নয় মোটেও।

  • সালাউদ্দিন আহমেদ উচ্চাঙ্গ ও নজরুলসংগীতশিল্পী ও শিক্ষক