খাদের কিনারায় ইন্দোনেশিয়ার গণতন্ত্র

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়েছেনছবি: রয়টার্স

দায়িত্ব নেওয়ার ১১ মাসও হয়নি, এর মধ্যেই ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়েছেন। পরিস্থিতি এমন যে তিনি চাইলে স্মরণীয় হয়ে উঠতে পারেন এমন একজন নেতা হিসেবে, যাঁর শাসনকাল জনগণের ক্ষোভ আর অসন্তুষ্টিতে ডুবে ছিল; আবার চাইলে এমন নেতা হিসেবেও পরিচিত হতে পারেন, যিনি দেশের চ্যালেঞ্জগুলো বুঝে জাতীয় স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

দুই সপ্তাহ ধরে ইন্দোনেশিয়াজুড়ে যে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে, তা কোনো ক্ষণস্থায়ী উত্তেজনা নয়। এটি দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভের প্রকাশ। এই আন্দোলন ক্ষমতার অপব্যবহার, সাংবিধানিক নিয়ম ভঙ্গ এবং মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের কাছে দুঃখ প্রকাশ বা সহানুভূতি চান না। তাঁরা এমন জীবন চান, যেখানে তাঁদের মর্যাদা ও মানবাধিকার রক্ষা পাবে।

শুধু অতীত সরকারের ভুলের দায় বর্তমান সরকারের ওপর চাপানো বা ক্ষমতা একটি প্রধান দলের হাতে কেন্দ্রীভূত করা ঠিক হবে না। এমন করা হয়তো সাময়িক শান্তি বা স্থিতিশীলতা দিতে পারে। কিন্তু এটি গণতন্ত্রের শক্তি ও স্থিতিশীলতা কমিয়ে দেয়। সুতরাং বর্তমান সরকারকে এখন বাস্তব সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে। দারিদ্র্য কমানো, নতুন চাকরি সৃষ্টি করা এবং জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার মতো কাজ করে সংকটের সমাধান করতে হবে।

দেশের সামাজিক বিভাজন সারাতে নীতিনির্ধারকদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।

প্রথমত, ক্ষমতার সংহতি রোধ ও স্বার্থের সংঘাত দূর করতে হবে। মনে রাখা দরকার, গণতন্ত্র তখনই শক্তিশালী হয়, যখন নির্বাহী, আইনসভা ও বিচারিক শাখাগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ায় এখনো ক্ষমতা অত্যধিক কেন্দ্রীভূত। অনেক রাজনৈতিক দল পরিবারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। সেখানে নেতারা একদিকে সরকারি দায়িত্ব পালন করেন, অন্যদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসায়ও অনেক প্রভাব রাখেন। এর ফলে তঁারা নিজেরা ভুল বা অপরাধ করলে শাস্তি পান না। এটিকে বলা হয় ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতি’।

ইন্দোনেশিয়ার সরকার এখন এমন একটি আইন প্রণয়ন করছে, যা দিয়ে বোঝা যাবে কে বড় অঙ্কের সম্পদ জমা করেছে, কিন্তু তা ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে পারছে না। এই সম্পদ সরকার ফেরত নিতে পারবে। এটা দেখায় যে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এবং নাগরিকদের পাশে আছে।

দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা মানে হলো সরকার কোথায় কত টাকা ব্যয় করছে এবং তা ঠিকভাবে জনগণের কাজে লাগছে কি না, তা পরিষ্কারভাবে জানা ও জানানো। এটা নিশ্চিত করলে সামাজিক সহায়তা সঠিকভাবে পৌঁছাবে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোও দ্রুত সংস্কার করা যাবে।

তৃতীয়ত, সামরিক হস্তক্ষেপ কমাতে নাগরিক ক্ষমতা শক্তিশালী করতে হবে। সামরিক বা পুলিশি হস্তক্ষেপ সাধারণ প্রশাসনিক কাজে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে। ইন্দোনেশিয়ায় সামরিক বাহিনী এখনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাব রাখে। তাই স্পষ্ট সীমারেখা বজায় রাখা, শক্তিশালী নাগরিক তত্ত্বাবধান এবং মানবাধিকার মান অনুসরণ করা বিশেষভাবে জরুরি। এসব নিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়া ইন্দোনেশিয়া মিয়ানমার বা লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার মতো অস্থিতিশীলতার দিকে ঝুঁকতে পারে।

সর্বশেষ দীর্ঘদিন ধরে বিলম্বিত অ্যাসেট রিকভারি বিল পাস করতে হবে। এটি কোনো অপরাধমূলক সাজার অপেক্ষা ছাড়াই রাষ্ট্রকে অপরিমিত সম্পদ পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা দেবে। এর লক্ষ্য এলোমেলোভাবে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা নয়; বরং চুরি করা সরকারি সম্পদ জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। এ বিলের প্রথম খসড়া ২০০৮ সালে তৈরি হয়। ২০১২ সালে এটি পার্লামেন্টে পেশ করা হয়। কিন্তু প্রায় দুই দশক এই বিল স্থগিত থাকায় দুর্নীতিবাজেরা সরকারি সম্পদ লুট করতে পেরেছে।

ইন্দোনেশিয়ার সরকার এখন এমন একটি আইন প্রণয়ন করছে, যা দিয়ে বোঝা যাবে কে বড় অঙ্কের সম্পদ জমা করেছে, কিন্তু তা ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে পারছে না। এই সম্পদ সরকার ফেরত নিতে পারবে। এটা দেখায় যে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এবং নাগরিকদের পাশে আছে।

যদি প্রাবোও এই পুনরুদ্ধার করা অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক কাজে ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি সত্যি জনগণের জন্য ভালো কিছু করেছেন। এটি তাঁর নেতৃত্বের ইতিবাচক স্মৃতি হয়ে থাকবে। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়ার নেতৃত্বের দুটি পথ আছে। এক. কঠোরভাবে শাসন চালানো; দুই. গণতান্ত্রিকভাবে শাসন শক্তিশালী করা।

প্রাবোওর সাফল্য শুধু ভোটে জয়ের মাধ্যমে নয়; বরং মানুষকে ভালো জীবন, ভালো চাকরি, উন্নত স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে বিচার করা হবে।

  • লিলি ইয়ান ইং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব

    স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ