প্রবাসে থেকে কেন তাঁরা দেশের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামান?

তুরস্কে এরদোয়ানের জয়ের পর জার্মানিতে অভিবাসী তুর্কিদের উল্লাস
ছবি: এএফপি

তুরস্কে সম্প্রতি শেষ হওয়া নির্বাচনে জেতার জন্য সম্ভবত প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের জার্মান-তুর্কি এবং ডাচ-তুর্কি ভোটারদের ভোটের প্রয়োজন ছিল না। তার পরও জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসে বসবাসরত তুর্কিদের প্রায় ৭০ শতাংশ ভোটার এরদোয়ানকে ভোট দিয়েছেন। অন্যান্য দেশে থাকা তুর্কিদেরও বড় অংশ এরদোয়ানকে ভোট দিয়েছে।

অবশ্য তুর্কি বংশোদ্ভূত জার্মান অথবা ডাচ নাগরিকদের সবাই যেহেতু তুরস্কের নির্বাচনে ভোট দেননি, সে কারণে এই ধরনের পরিসংখ্যানকে সতর্কভাবে বিবেচনা করা দরকার। তবে দ্বৈত নাগরিকদের মধ্যে ডানপন্থী তুর্কি জাতীয়তাবাদের জোরালো আবেদন আছে বলে মনে হয়।

আরও পড়ুন

প্রবাসে থাকা এই জাতীয়তাবাদীদের প্রবাসেও সরব থাকতে দেখা যাচ্ছে এবং জার্মানির শহরগুলোতে এরদোয়ানের জয়ের পর তাঁর সমর্থকদের উচ্চশব্দে একযোগে হর্ন বাজিয়ে এবং রাজনৈতিক স্লোগান দিয়ে উল্লাস করতে দেখা গেছে।

বিদেশের মাটিতে এই সরব বিক্ষোভ ও হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে এক ধরনের অবাধ্যতার সুর নিহিত আছে। এটি আত্মপরিচয়ের রাজনীতির একটি কর্কশ প্রকাশ। জাতিগত সংখ্যালঘুদেরও যে প্রতিবাদের ভাষা আছে, সেই বার্তা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে দেওয়ারও এটি একটি প্রতীকী মাধ্যম। কিন্তু অভিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা যে দেশ থেকে আসেন, সে দেশের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে তাদের এত সরব থাকতে দেখা যায়, যা তাদের দেশে বসবাসকারী নাগরিকদের মধ্যেও দেখা যায় না।

উদাহরণ স্বরূপ, ভারতের পাঞ্জাবে একটি আলাদা স্বাধীন শিখ রাষ্ট্রের দাবি তোলা খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতে যতটা না সোচ্চার, তার চেয়ে তারা বেশি সোচ্চার কানাডা অথবা যুক্তরাজ্যে।

একইভাবে, আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি আইরিশ বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের কাছ থেকে বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে; ব্রিটেনের কিছু অংশে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বেশ জোরালো অবস্থান তৈরি করেছে এবং পশ্চিম ইউরোপীয় শহরগুলো উগ্র ইসলামপন্থীদের জন্য দলে লোক ভেড়ানোর উর্বর ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

যদিও এটি পশ্চিমের অধিকতর উদার এবং মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রবণতাকে প্রতিফলিত করে। তবে একই সঙ্গে এর অন্যান্য বিষয়গুলো দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসীরা কেন ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের দিকে ঝোঁকে, তার কারণ ব্যাখ্যা করে।

আরও পড়ুন

কেন কিছু অভিবাসী ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তার একটি সাধারণ ব্যাখ্যা হলো, ইউরোপে জন্ম নেওয়া অ-পশ্চিমা কিংবা অ-খ্রিষ্টান সংখ্যালঘুরা পশ্চিমা সমাজের মূলধারায় নিজেদের তুলনামূলকভাবে কম যুক্ত করতে পারেন। অভিবাসীদের মূলধারায় যুক্ত হতে না পারার জন্য প্রায়শই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর জাতি গৌরব ও কুসংস্কারকে দায়ী করা হয়। আবার এর জন্য সেই সব ধর্মগুরুদের ওপর দোষ পড়তে পারে যাঁরা ধর্মীয় উপাসনালয়ে মৌলবাদী, এমনকি হিংসাত্মক বার্তা প্রচার করেন।

‘মার্ডার ইন আমস্টারডাম’ শিরোনামে ২০০৭ সালে প্রকাশিত আমার একই বইয়ে আমি মোহাম্মাদ বুয়েরি নামের এক যুবকের কথা লিখেছিলাম। বুয়েরির বাবা মা মরক্কো থেকে নেদারল্যান্ডসে আসা নাগরিক। নেদারল্যান্ডসেই বুয়েরির জন্ম। প্রথম দিকে বুয়েরি দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসীদের মতোই মূলধারায় মিশে যাওয়া এক প্রাণোচ্ছল তরুণ ছিলেন। তিনি ফুটবল, বিয়ার ও রক মিউজিক পছন্দ করতেন। কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ের কিছু ঘটনা তাঁকে উগ্রপন্থায় নিয়ে যায়। তিনি এমন ইসলামপন্থী বিপ্লবী হয়ে পড়েন যে, নেদারল্যান্ডসের শীর্ষস্থানীয় ইসলাম ধর্মের সমালোচক থিও ভ্যান গঘকে ২০০৪ সালে খুন করেন।

জন্মভূমি নেদারল্যান্ডসে বুয়েরির নিজেকে একজন অস্পৃশ্য বহিরাগতের মতো মনে হতো। মরক্কোয় একবার বাপদাদার ভিটেবাড়িতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল, সেখানেও তিনি কখনো স্বচ্ছন্দভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন না। অর্থাৎ তিনি একদিকে নেদারল্যান্ডসে নিজেকে বহিরাগত মনে করছিলেন, অন্যদিকে মরক্কোকেও স্বদেশ ভাবতে পারছিলেন না।

চরমপন্থীরা সব সময়ই সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাদের কর্মকাণ্ড তাদের সম্প্রদায়ের ওপর প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামপন্থী সব সহিংসতাই শান্তিকামী নিরপরাধ মুসলমানদের অযাচিত চাপে ফেলে। এমনকি যিনি কখনো ধর্মকর্ম চর্চা করেনও না, তাঁকেও এটি প্রমাণ করতে হয় যে, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।

ইংরেজি ভাষার একটি বিপ্লবী ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বুয়েরি একটি বিশেষ উগ্র মতাদর্শভিত্তিক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন এবং ইসলামভিত্তিক সেই মতাদর্শের পরিচয়ে গৌরববোধ করতে থাকেন। সেই পরিচয়েই তিনি নিজের স্বাধীন সত্তার অনুভূতি খুঁজে পান। যখন তিনি নেদারল্যান্ডস এবং মরক্কো উভয়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করেছিলেন, তখন তিনি ক্ষুব্ধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ একটি গোষ্ঠীর মধ্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন।

এই বিচ্ছিন্নতা ব্যাপকভাবে ক্ষতির কারণ হতে পারে যা শুধু অভিবাসী সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করে, তা-ই নয়, সেটি বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক গতিশীলতাকেও প্রভাবিত করে।

চরমপন্থীরা সব সময়ই সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং তাদের কর্মকাণ্ড তাদের সম্প্রদায়ের ওপর প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামপন্থী সব সহিংসতাই শান্তিকামী নিরপরাধ মুসলমানদের অযাচিত চাপে ফেলে। এমনকি যিনি কখনো ধর্মকর্ম চর্চা করেনও না, তাঁকেও এটি প্রমাণ করতে হয় যে, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।

এরদোয়ান একজন চতুর রাজনৈতিক কৌশলবিদ। ইউরোপে তুর্কি অভিবাসীরা যে সমস্যার মুখে পড়ছে তা বুঝতে তাঁর সমাজবিজ্ঞানে ডিগ্রি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি ভালো করেই জানেন, তাঁর অটোমান সাম্রাজ্যভিত্তিক মহিমা প্রচার এবং ধর্মীয় ও জাতিগত বিশুদ্ধতার আবেদনগুলো কোণঠাসা অবস্থায় থাকা অভিবাসীদের মধ্যে বিদ্রোহাত্মক অনুরণনের সৃষ্টি করে।

এ কারণে তিনি বিদেশে তুর্কি নাগরিকদের আত্তীকরণ ঠেকানোর আহ্বান জানিয়েছেন। এটি এরদোয়ানকে জয়ী করলেও সম্ভবত অভিবাসীদের জীবনকে আরও খারাপ দিকে নিয়ে যায়।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
ইংরেজি থেকে অনূদিত
ইয়ান বুরুমা রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দ্য চার্চিল কমপ্লেক্স: দ্য কার্স অব বিয়িং স্পেশাল বইয়ের লেখক