দেশের ভবিষ্যৎ ও বর্তমান নিয়ে জনমনে কেন বাড়ছে হতাশা

দেশের সামগ্রিক পথচলা নিয়ে ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যে ক্রমবর্ধমান আশাবাদ দেখা যাচ্ছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। নির্বাচনের ঠিক আগে জনগণের এই হতাশাকে দেশের জাতীয় মনোভাবের প্রতিফলনই বলা চলে। সম্প্রতি বাংলাদেশের পাঁচ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ওপর করা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সমীক্ষায় জনমনের হতাশা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। দেশ কোন পথে চলছে, এ প্রশ্নে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ইতিবাচক উত্তরের হার কমেছে ৩১ পয়েন্ট, অন্যদিকে হতাশা প্রকাশ করা মানুষের হার বেড়েছে আরও বেশি। এ মনোভাবের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে রয়েছে অর্থনৈতিক দুরবস্থা, হতাশা প্রকাশকারীদের মধ্যে ৬১ শতাংশের অর্থনৈতিক কারণ উল্লেখ করা তারই ইঙ্গিত দেয়।

দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে’ থেকে জনমনের এই পরিবর্তন আরও স্পষ্ট হয়েছে। চলমান একটি গবেষণার অংশ হিসেবে ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বমূলক এই সমীক্ষা করা হয়, যেখানে অংশ নিয়েছিলেন ১০ হাজার ২৪০ প্রাপ্তবয়স্ক নারী ও পুরুষ। সমীক্ষায় বিগত ১২ মাসে জনগণের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল, যার মাধ্যমে ২০২২ সালের জাতীয় মনোভাবকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সমীক্ষাটিতে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, যার ফলে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে জনমনের চিত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুন

আইআরআইয়ের মতো এশিয়া ফাউন্ডেশন-বিআইজিডি সমীক্ষায়ও রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক—তিন ক্ষেত্রেই নাগরিকদের মনোভাবের নেতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন দেখা গেছে অর্থনীতির অবস্থাসম্পর্কিত মনোভাবে—২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালে এ বিষয়ে আশাবাদী মানুষের হার কমেছে ৪৫ পয়েন্ট। রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নিয়ে একই সময়ের ব্যবধানে ইতিবাচক উত্তর হ্রাস পেয়েছে ২৫ পয়েন্ট।

এখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের মধ্যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সম্পর্ক লক্ষ করা গেছে। দেশের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণকারীর অধিকাংশই (৮৫%) অর্থনৈতিক হালচাল সম্পর্কেও নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। উল্টোদিকে, রাজনীতি নিয়ে আশাবাদীদের মধ্যে ব্যাপারটি নেই–ই—অর্থনীতি নিয়ে তাঁদের মনোভাব সমানভাবে বিভক্ত। দুটি বিষয় একসঙ্গে বিবেচনা করলে এটা বলা ভুল হবে না যে যদি রাজনৈতিক দৃশ্যপট সম্পর্কে মানুষের ইতিবাচক ধারণা বর্তমান সরকারের প্রতি তাঁদের সমর্থনের নিয়ামক হয়ে থাকে, কঠোর অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সেই সমর্থন ক্ষীণ হয়ে আসছে।

এশিয়া ফাউন্ডেশন-বিআইজিডি সমীক্ষায় যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা কেন ইতিবাচক বা নেতিবাচক উত্তর দিয়েছেন, সেটি তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত উত্তরগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের আশাবাদী মনোভাবের নেপথ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির উপাখ্যান এবং বৃহৎ অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলো, যেমন পদ্মা সেতু। অন্যদিকে, যাঁরা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তাঁরা ইঙ্গিত করেছেন দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অত্যধিক ব্যয়বৃদ্ধি ও অভাবের মতো ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক চাপের দিকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে আমলে নিলে, দৈনন্দিন জীবনের আর্থিক টানাপোড়েনকেই জনমনে হতাশা বৃদ্ধির প্রধান কারণ বলে মনে হয়। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৪% উত্তরদাতা বলেছেন, তাঁরা সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধির দ্বারা প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত।

উত্তরদাতাদের আয় অনুযায়ী তাঁদের আশাবাদ কমার চিত্র পর্যালোচনা করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যাঁদের পারিবারিক আয় বেশি, ৩০ থেকে ৫০ হাজারের মধ্যে, তাঁদের মধ্যেও আশাবাদ কমেছে, তবে তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক—এ তিন বিষয়েই আশাবাদ কমার হার সবচেয়ে কম। অন্যদিকে যাঁদের পারিবারিক আয় ১০ হাজারের কম, তাঁদের আশাবাদ কমেছে সবচেয়ে বেশি, অর্থনৈতিক বিষয়ে তো বটেই, রাজনৈতিক এমনকি সামাজিক বিষয়েও।

আরও পড়ুন

কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ—এই সব নানা সংকটের কারণে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপট আগের ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষার মনোভাব’ থেকে সরে এসেছে ‘দুর্দশাপীড়িত সহনশীলতায়’। ফলে বৈষম্য উসকে দেওয়া প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জীবনযাত্রার উচ্চমূল্য একটি গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

জনমনে বেড়ে ওঠা নেতিবাচক ধারণাগুলো, বিশেষত অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতিসম্পর্কিত ধারণাগুলো বাস্তব ও গভীর। এর মূলে বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব থাকলেও জাতীয় ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সুশাসন ও ব্যবস্থাপনাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর মাধ্যমেই সরকার জনসমর্থন পায়। আইআরআইয়ের সমীক্ষায় দেখা গেছে, নাগরিকেরা রাস্তা, বিদ্যুৎ, খাওয়ার পানি ও শিক্ষার মতো বিষয়ে সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করলেও মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব ও দুর্নীতি নিয়ে অসন্তুষ্ট। স্পষ্টতই, জনগণ মনে করেন যে বর্তমানে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট সত্ত্বেও রাষ্ট্রের উচিত কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। কিন্তু, তাঁরা মনে করেন, এখন অবধি সেসব পদক্ষেপ বলিষ্ঠ বা কার্যকর হয়নি।

আর ঠিক এখানেই প্রয়োজন নীতি প্রণয়ন ও নীতি বাস্তবায়নসংক্রান্ত উদ্ভাবনী চিন্তার প্রয়োগ।

  • ড. ইমরান মতিন নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়