কাবুল পতনের এক বছর: বাইডেন–তালেবান দোস্তি বেড়েছে

গত ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের এক বছর পূরণের দিন কাবুলে মার্কিন দূতাবাসের সামনে তালেবান সদস্যরা উল্লাস করেন।
ছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে অপমানজনকভাবে বিদায় নেওয়ার মাধ্যমে দেশটিকে তালেবানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে যে কোনো যুক্তিশীল পর্যবেক্ষকের ভবিষ্যদ্বাণীকে সত্য করে সেখানে একটি মধ্যযুগীয়, জিহাদি ও সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয়দানকারী আমিরাত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

এ কথা ঠিক যে, আফগান মিত্রদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আগামী দীর্ঘ সময়ের জন্য মূল্য দিয়ে যেতে হবে। তবে সবচেয়ে বেশি যাঁদের মূল্য দিতে হবে তাঁরা হলেন আফগান জনগণ।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি অনুসরণ করেছেন এবং আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার অপমানজনক পশ্চাদপসরণে তার ভূ-রাজনৈতিক পরিণতি সবাইকে বরণ করতে হচ্ছে।
আফগানিস্তান থেকে ল্যাজ গুটানোর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে পতনমুখী শক্তি হিসাবে চিত্রিত করেছে। এটি সবখানেই ইসলামপন্থী জঙ্গিদের প্রবল উৎসাহ দিয়েছে। এই প্রত্যাহার রাশিয়া এবং চীনকেও অধিকতর যুদ্ধংদেহী হতে উৎসাহিত করেছে।
এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয় যে, কাবুল পতনের পরপরই রাশিয়া ইউক্রেনের সীমানা বরাবর সামরিক বাহিনী জড়ো করতে শুরু করে এবং চীন তাইওয়ানের ঘোষিত নিজ আকাশ সীমায় রেকর্ডসংখ্যক যুদ্ধবিমান পাঠায়।

আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা পুনর্দখলের প্রথম বর্ষপূর্তিতে গত ১৫ আগস্ট কাবুলে বক্তব্য দেন তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি
ছবি: এএফপি

তবে আফগানিস্তানে পরিস্থিতি আরও খারাপ। নারী ও মেয়েরা চাকরি ও শিক্ষার অধিকার হারিয়েছে। অনেক মেয়ে সেখানে তালেবান যোদ্ধাদের জোরপূর্বক বিয়ের মাধ্যমে যৌন দাসত্বের শিকার হয়েছে।

তালেবান ডেথ স্কোয়াড মার্কিন বাহিনীকে সহযোগিতা দেওয়া আফগান নাগরিকদের পরিকল্পিতভাবে চিহ্নিত করে হত্যা করছে। অত্যাচার ও মৃত্যুদণ্ড সেখানে সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফগানিস্তানের হিন্দু এবং শিখরা, যারা মধ্যযুগের আরব বিজয়ীদের দ্বারা সুন্নি ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়াকে প্রতিরোধ করেছিল, তাদের বংশধররা হত্যা এড়াতে ভারতে পালিয়েছে।

আরও পড়ুন

তালেবান সরকারের মন্ত্রিসভায় যাঁরা আছেন তাঁরা চিহ্নিত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী এবং মাদক চক্রের সদস্য। সিরাজুদ্দিন হাক্কানি, যিনি বর্তমানে আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন এবং দেশটিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হতে বাধা দেন, তিনি হলেন ভয়ংকর নির্মম হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসী’ হিসাবে ঘোষণা করেছিল এবং তাঁর মাথার দাম এক কোটি ডলার ঘোষণা করেছিল।

এটি মোটেও অবাক করা খবর নয় যে, তালেবান পরিচিত সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিয়ে চলেছে। যেমন সাম্প্রতিক ঘটনায় আমরা বাইডেনের নির্দেশে মধ্য কাবুলে আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরিকে হত্যা করার ঘটনা দেখেছি।

আরও পড়ুন

আল-জাওয়াহিরির হত্যার পর বাইডেন যখন এটিকে তাঁর বিজয় হিসেবে দাবি করছিলেন, তখন তাতে তাঁর কৃতিত্ব খুব কমই প্রতিফলিত হয়। এক বছর আগে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্যদের দ্রুত পশ্চাদপসরণ করার নির্দেশ দেওয়ার সময় বাইডেন দাবি করেছিলেন, আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনো আগ্রহ নেই, কারণ আল-কায়েদা ইতিমধ্যেই ‘চলে গেছে’। (যাই হোক না কেন, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, আল-কায়েদা জঙ্গিরা তাদের তালেবান সহযোগীদের সঙ্গে লড়াই করছে।)

আরও পড়ুন

আফগানিস্তান এবং দেশটির প্রতিবেশীদের জন্য বিপদ আরও বাড়িয়ে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশৃঙ্খলভাবে আফগানিস্তান ছাড়ার সময় ৭১০ কোটি ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রেখে গেছে। পেন্টাগনের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন অনুসারে, তালেবান ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ফেলে যাওয়া কিছু ক্ষতিগ্রস্ত বিমান আফগান বিমানবাহিনী মেরামত করেছে এবং সেগুলো অপারেশনে ব্যবহার করার উপযোগী করে তুলেছে। এটি স্বীকার করা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরঞ্জামগুলো পুনরুদ্ধার বা ধ্বংস করার বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেয়নি।

বাইডেন তাঁর নিজের লক্ষ্য অনুযায়ী ১১ সেপ্টেম্বরের এক মাস আগে জেনারেলদের বাতিল করার এবং আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিরাপত্তা এবং মানবিকতা ইস্যুতে একটি দুঃস্বপ্ন তৈরি করেছেন।

জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে মানবিক ছাড় প্রদানের প্রস্তাবে নেতৃত্ব দিয়েছে। মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট আফগানিস্তানে মানবিক ত্রাণ প্রদান সহজতর করার লক্ষ্যে এখন তালেবান এবং হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত আর্থিক লেনদেনে অনুমতি দিচ্ছে

কাবুল পতনের পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ঘোষণা করেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে তাঁদের ভবিষ্যৎ সম্পৃক্ততার বিচার করবে ‘একটি সহজ প্রস্তাবের’ ওপর ভিত্তি করে। অর্থাৎ তালেবান নেতৃত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার স্বার্থকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে কিনা তার ওপর ভিত্তি করে এই সরকারের সঙ্গে ওয়াশিংটন কী ধরনের সম্পর্ক রাখবে তা নির্ভর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই স্বার্থের মধ্যে আফগানিস্তানে ‘নারী অধিকার সমুন্নত রাখা’, মানবিক সহায়তা প্রদান করা এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার বিষয় অন্তর্ভুক্ত।
তবে এই তিনটি ক্ষেত্রেই তালেবান ব্যর্থ হলেও বাইডেন প্রশাসন ধীরে ধীরে তালেবান শাসকদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করছে।

আরও পড়ুন

জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে মানবিক ছাড় প্রদানের প্রস্তাবে নেতৃত্ব দিয়েছে। মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট আফগানিস্তানে মানবিক ত্রাণ প্রদান সহজতর করার লক্ষ্যে এখন তালেবান এবং হাক্কানি নেটওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত আর্থিক লেনদেনে অনুমতি দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের জব্দ করা সাড়ে তিন শ কোটি ডলার ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে তালেবানের সঙ্গে আলোচনা করছে।

এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাবুলে হাক্কানি গ্রুপের বা অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সন্ত্রাসীদের টার্গেট করতে অস্বীকার করছে। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আল-জাওয়াহিরিকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন তাঁকে যেভাবে বর্ণনা করে আসছে, আদতে তিনি সর্বশেষ অবস্থায় ততটা প্রভাবশালী ছিলেন না। তিনি মূলত অবসরপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি হাক্কানির সুরক্ষায় কাবুলের একটি বাড়িতে তাঁর ‘বর্ধিত পরিবারের’ সদস্যদের সঙ্গে বসবাস করছিলেন।

তাহলে এরপর কী? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি এখন তার ‘অ-ন্যাটো মিত্র’ পাকিস্তানকে (যে দেশটি জাওয়াহিরিকে হত্যা করার জন্য ব্যবহৃত ড্রোন ওড়ার জন্য নিজের আকাশ সীমা ব্যবহার করতে দিয়েছিল) পুরস্কৃত করবে?

এটা সবাই জানে, পাকিস্তান তালেবান গোষ্ঠীকে লালন-পালন করেছে এবং আফগানিস্তানে মার্কিন পরাজয়ে পাকিস্তান ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এখন তারাই ঋণ খেলাপি এড়াতে সাহায্য করার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ চাচ্ছে।

একইভাবে সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় দেওয়া এবং একটি নিপীড়ক ও সহিংস ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি এখন তালেবানদের কাছে আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয়-ব্যাংকের রিজার্ভগুলো ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবে?

বাইডেন প্রশাসন তালেবানের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার সমর্থনে এই যুক্তি দিচ্ছে যে, সেখানে তৎপর আইএস-কে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করতে তালেবানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যূনতম যোগাযোগ রাখা দরকার। কারণ তালেবান আইএস-কের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছে।

আজ এটি অমোঘ সত্য যে, আফগানিস্তান থেকে তাড়াহুড়া করে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে বাইডেন প্রশাসন ইসলামপন্থীদের হাতে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় তুলে দিয়েছে। কিন্তু আফগানিস্তানে যুদ্ধ শেষ হয়নি। তালেবানের কথিত আমির মোল্লা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার সাম্প্রতিক ঘোষণায় তা স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘এই জিহাদ কখনই শেষ হবে না এবং এটি কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে।’

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক