নিয়মিত রেল দুর্ঘটনাই কি এখন নিয়মে পরিণত হলো

রেলযাত্রাকে মনে করা হয় সড়ক যোগাযোগের সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। কিন্তু সেই নিরাপদ রেলই এখন অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রেল দুর্ঘটনায় বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে গেছে যাত্রী দুর্ভোগও। রেল খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হয়েছে; কিন্তু যাত্রীসেবা, যাত্রীর নিরাপত্তা, দুর্ঘটনা হ্রাস ও দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি হয়নি। ত্রুটিপূর্ণ রেলপথ, ইঞ্জিন বা বগির যান্ত্রিক সমস্যা, সিগন্যালব্যবস্থার সমস্যা, নিরাপত্তাব্যবস্থার আধুনিকায়ন না করা, অপ্রশিক্ষিত ও অস্থায়ী জনবল নিয়োগসহ রেলের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন কল্লোল মোস্তফা।

৩ মে গাজীপুরের জয়দেবপুরে ভুল সিগন্যাল বা সংকেতের কারণে দুই ট্রেন এক লাইনে এসে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। তেলবাহী ট্রেনের সঙ্গে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের এই সংঘর্ষে নয়টি বগি লাইনচ্যুত হয় এবং আহত হন চারজন।

দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকারী ট্রেন এনে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেন দুটি লাইন থেকে সরানো এবং ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন মেরামত করে ট্রেন চলাচল শুরু করতে সময় লাগে ৩১ ঘণ্টার বেশি। এই সময়ে পাশাপাশি থাকা দুটি রেললাইনের মধ্যে শুধু একটি লাইন দিয়ে ট্রেন চলার কারণে জয়দেবপুর ও ধীরাশ্রম স্টেশনে আসা-যাওয়ার ট্রেনগুলোকে অপেক্ষায় রেখে একটি একটি করে চলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এতে দুর্ঘটনাস্থল পার করতে প্রতিটি ট্রেনের এক থেকে দেড় ঘণ্টা বেশি সময় লেগেছে। (৫ মে ২০২৪, প্রথম আলো)

এর ফলে ঘটনার দিন ও তার পরদিন পূর্বাঞ্চলের অনেক ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে, উত্তরবঙ্গ এবং বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার প্রায় ৬০টি ট্রেন অস্বাভাবিক দেরিতে ছেড়ে যায়। এমনকি ঘটনার তিন দিন পরও ট্রেনের সময়সূচি স্বাভাবিক হয়নি, উত্তরবঙ্গ ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের জেলাগুলোর ট্রেনগুলো দেরিতে ছেড়েছে। (প্রথম আলো, ৬ মে ২০২৪)

আরও পড়ুন

দুর্ঘটনায় ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের ফলে প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ট্রেনের যাত্রীদের দুর্ভোগের শেষ ছিল না। স্টেশনগুলোতে শত শত যাত্রী অনিশ্চয়তা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছিলেন। তাঁদের জানার কোনো উপায় ছিল না কোন ট্রেন কখন ছাড়বে, কখন গন্তব্যে পৌঁছাবে। যাত্রীদের অনেকে সকালে স্টেশনে গিয়ে ট্রেন পান বিকেলে ও সন্ধ্যায়, কেউ মাঝপথে থেমে থাকা ট্রেনে বসে ছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রীসেবার মান ও সক্ষমতার বেহালের বিষয়টি আবারও সামনে এল। রেল খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হয়েছে; কিন্তু যাত্রীসেবা, যাত্রীর নিরাপত্তা, দুর্ঘটনা হ্রাস ও দুর্ঘটনা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে কোনো উন্নতি হয়নি।

একটি দুর্ঘটনার পর ট্রেন উদ্ধার ও লাইন চালু করতে ৩১ ঘণ্টার বেশি সময় লাগার অর্থ হলো, উদ্ধারের যন্ত্রপাতি ও লোকবলের সক্ষমতার ঘাটতি আছে। যেমন রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের আওতায় বর্তমানে ছয়টি উদ্ধারকারী ট্রেন আছে। এগুলোর অবস্থান ঢাকা, চট্টগ্রাম, আখাউড়া, লাকসাম, ময়মনসিংহের কেওয়াটখালী ও কুলাউড়ায়। এর মধ্যে চট্টগ্রামে থাকা উদ্ধারকারী ট্রেনটি ৫০ বছরের বেশি পুরোনো হওয়ায় অকেজো হয়ে পড়ে আছে। (উদ্ধারকারী ট্রেনগুলো অনেক পুরোনো, সংখ্যায়ও কম, প্রথম আলো, ৫ মে, ২০২৪)

উদ্ধারকারী ট্রেনগুলো সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমনভাবে রাখা প্রয়োজন, যেন যেকোনো স্থানে দুর্ঘটনা ঘটলে এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধারকারী ট্রেনের পক্ষে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছানো সম্ভব হয়। কিন্তু রেলের উদ্ধারকারী ট্রেনের সংখ্যা কম, পুরোনো, কম সক্ষমতার এবং ধীরগতির হওয়ার কারণে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে এবং উদ্ধারকার্য সম্পন্ন করতে অনেক দেরি হয়। ফলে কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলেই ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় ঘটে এবং যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ে।

শিডিউল বিপর্যয়ে যাত্রীদের ভোগান্তি কিছুটা হলেও কমানো যায় যাত্রীদের নতুন শিডিউল সময়মতো জানানো হলে। সে ক্ষেত্রে যাত্রীদের স্টেশনে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয় না, তাঁরা নতুন শিডিউল অনুযায়ী বাসা থেকে বের হতে পারেন।

তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে মোবাইলের এসএমএস, ই-মেইল, ওয়েবসাইট, ফেসবুক ইত্যাদি নানা মাধ্যমেই কিন্তু রেলওয়ে কাজটি সহজে করতে পারে। কিন্তু আফসোসের ব্যাপার হলো, যাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য এই সামান্য কাজটুকু করার ব্যাপারে রেলওয়ের কোনো আগ্রহ নেই। এসব ক্ষেত্রে, এমনকি স্টেশনে থাকা ডিসপ্লেতেও সঠিক তথ্য দেওয়া হয় না।

আরও পড়ুন

একইভাবে দুর্ঘটনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও রেলের উদ্যোগ কম। তেলবাহী ট্রেনের সঙ্গে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের এই সংঘর্ষের পরদিনই ভুল সিগন্যালের আরেকটি ঘটনা ঘটে। ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী এক্সপ্রেস ও ঢাকা-রাজশাহীর ধূমকেতু এক্সপ্রেস বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিমে সিগন্যালের ভুলে এক লাইনে এলেও অল্পের জন্য দুর্ঘটনাথেকে রক্ষা পায়। শুধু এ দুটি নয়, ভুল সংকেতে প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসেই তিনবার ভুল সংকেতের ঘটনা ঘটেছে। (রেলের সিগন্যালে ভুল আর ভুল, সমকাল, ৫ মে ২০২৪)

আপাতদৃষ্টিতে ভুল সিগন্যালের এই ঘটনাগুলোর জন্য রেলকর্মীদের দায় থাকলেও এর মূল কারণ কিন্তু অনেক জায়গায় স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল সিস্টেম না থাকা এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে অদক্ষ জনবল নিয়োগ।

সর্বশেষ প্রকাশিত বাংলাদেশ রেলওয়ে ইনফরমেশন বুক ২০২০ অনুযায়ী, বাংলাদেশ রেলওয়ের ৪৮৯টি স্টেশনের মধ্যে ৩৫৯টিতে সংকেতের ব্যবস্থা আছে, যার মধ্যে আধুনিক কম্পিউটার বেজড ইন্টারলকিং সংকেতের ব্যবস্থা আছে মাত্র ১১২টিতে; অর্থাৎ প্রায় ৬৯ শতাংশ রেলস্টেশনে উন্নত সংকেতের ব্যবস্থা নেই। (বাংলাদেশ রেলওয়ে ইনফরমেশন বুক ২০২০, পৃষ্ঠা-১৪)

রেলওয়ে খাতের অপচয়, দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করা না হলে; রেলওয়ের বিদ্যমান অবকাঠামো, রেলপথ, সেতু, ইঞ্জিন, বগির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও রেলওয়ের সিগন্যাল, নিরাপত্তাব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা না হলে এবং পর্যাপ্তসংখ্যক লোকবল ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে যথাযথ তদারকি করা না হলে রেল দুর্ঘটনা ও যাত্রী দুর্ভোগের অবসান হবে না।

আবার সব স্টেশনের সংকেতের ব্যবস্থাও একই রকম নয়। এর ফলে সংকেতের ব্যবস্থায় ভুলের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অন্যদিকে যেসব জায়গায় ইন্টারলকিং সংকেতের ব্যবস্থা আছে, সেসব ক্ষেত্রেও বছরের পর বছর ধরে রেলের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প চলায় বিভিন্ন স্থানে ইন্টারলকিং সংকেতের ব্যবস্থা কার্যকর রাখা যায় না, সনাতন পদ্ধতির নন-ইন্টারলিংকের ব্যবস্থায় সংকেত দেওয়া হয়। ফলে মাঝেমধ্যেই ভুল হয়।

এ ছাড়া আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে লোক নিয়োগে রেলের খরচ সাশ্রয় হলেও বিশেষায়িত কাজে অপ্রশিক্ষিত ও অস্থায়ী জনবল নিয়োগে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে গেছে। যেমন আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে ঠিকাদারের সরবরাহ করা পয়েন্টসম্যানরা রেলের বিশেষায়িত কাজ জানেন না। এভাবে নতুন নিয়োগ পাওয়া জনবল ম্যানুয়াল সংকেত পদ্ধতিতে দক্ষ হয়ে উঠতে না পারার কারণেও অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটেছে।

এ ছাড়া লাইনচ্যুত হয়ে ট্রেন দুর্ঘটনা যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে ইনফরমেশন বুক ২০২০ থেকে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১৯-২০ এই ১২ বছরে মোট ২ হাজার ৬০১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনা ২ হাজার ৩১৯টি; যা মোট দুর্ঘটনার ৮৯ শতাংশ। (ইনফরমেশন বুক ২০২০, বাংলাদেশ রেলওয়ে, পৃষ্ঠা ১০০)

আরও পড়ুন

আর ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনার পেছনে যেসব কারণ দায়ী, তার মধ্যে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ রেলপথ, ইঞ্জিন বা বগির যান্ত্রিক সমস্যা, সিগন্যালব্যবস্থার সমস্যা, বিভিন্ন ধরনের মানবীয় ভুল ও নিয়ম অমান্য করা ইত্যাদি। এক হিসাবে, লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনার প্রায় ৬৩ শতাংশই হয় ঝুঁকিপূর্ণ লাইন ও দুর্বল সেতুর কারণে। (ইত্তেফাক, ২১ মার্চ ২০২৪)

উচ্চ ব্যয়ে নতুন রেললাইন ও স্টেশন ভবন নির্মাণের প্রকল্প নিতে যতটা উৎসাহ দেখা যায়, ততটাই নিরুৎসাহ বিদ্যমান রেলপথ ও রেলসেতু সংস্কারে। ফলে সারা দেশে ৩ হাজার ৪০০ কিলোমিটারের বেশি রেললাইনের মধ্যে মানসম্পন্ন রেললাইন মাত্র ১ হাজার কিলোমিটার। (ইত্তেফাক, ২১ মার্চ ২০২৪)

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের করা এক সমীক্ষা অনুসারে, দেশের ৪৩ জেলার মধ্যে ৩৯ জেলার রেললাইনই ছোট-বড় নানা সমস্যায় জর্জরিত। রেলের মান নষ্ট হওয়া, লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা, মাটি সরে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এতে দেশের প্রায় অর্ধেক রেললাইন ঝুঁকিতে পড়েছে। (উন্নত সংকেতব্যবস্থা নেই ৬৯ শতাংশ রেলস্টেশনে, ২৫ অক্টোবর ২০২৩, কালের কণ্ঠ)

এ রকম জীর্ণদশার কারণে ট্রেনের গতি কমেছে, দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে গ্রীষ্মকালে বাড়তি তাপমাত্রায় রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা। এই কারণে বিভিন্ন স্থানে ট্রেনের গতি আরও কমানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

লক্ষণীয় বিষয় হলো, সারা দেশের তাপমাত্রা প্রায় কাছাকাছি থাকলেও এই নির্দেশনা সব জায়গার জন্য দেওয়া হয়নি। যেসব অঞ্চলে রেললাইন বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে, সেখানেই ট্রেনের গতি কমানোর বার্তা দেওয়া হয়েছে। যেমন চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা বেশি থাকলেও সেখানে ট্রেনের গতি কমানোর নির্দেশ দেওয়া হয়নি। অথচ চট্টগ্রামে তুলনামূলক তাপমাত্রা কম থাকলেও এই অঞ্চলে তাপ বাড়লে ট্রেনের গতি কমাতে বলা হয়েছে। (লাইনের দুর্বলতা ঢাকার ফন্দি, তাপের ওপর দায় চাপাচ্ছে রেল, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, কালের কণ্ঠ)

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই সম্প্রতি যাত্রীবাহী ট্রেনের ভাড়া বাড়ানো হলো। ১০০ কিলোমিটারের অধিক দূরত্বে ভ্রমণের ক্ষেত্রে যাত্রীদের জন্য যে ছাড় ছিল, সেটা প্রত্যাহার করার ফলে ১০০ কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ভাড়া ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রশ্ন হলো, ভাড়া বৃদ্ধির ফলে রেলের দুর্ঘটনা কতটা কমবে, যাত্রীসেবার মান কতটা বাড়বে। এর আগে ২০১২ ও ২০১৬ সালে দুই দফায় রেলের ভাড়া বাড়ানো হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

রেলওয়ে খাতের অপচয়, দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করা না হলে; রেলওয়ের বিদ্যমান অবকাঠামো, রেলপথ, সেতু, ইঞ্জিন, বগির যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও রেলওয়ের সিগন্যাল, নিরাপত্তাব্যবস্থার আধুনিকায়ন করা না হলে এবং পর্যাপ্তসংখ্যক লোকবল ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে যথাযথ তদারকি করা না হলে রেল দুর্ঘটনা ও যাত্রী দুর্ভোগের অবসান হবে না।

  • কল্লোল মোস্তফা টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক। ই–মেইল: [email protected]