প্রতিষ্ঠান ‘ঠিকঠাক’ করতে ৫৩ মাসই কি যথেষ্ট নয়?

সম্প্রতি দি ঢাকা ফোরাম আয়োজিত ‘রাজনীতি অর্থনীতি: বাংলাদেশ এখন’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতটা অকার্যকর করা হয়েছে, যা ৫৩ বছরেও ঠিক করা যাবে না।ছবি: প্রথম আলো

কয়েক বছর ধরেই শুনে আসছি এবং বলাবলি করছি, দেশে গণতান্ত্রিক, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সর্বনাশ হয়ে গেছে। সম্প্রতি এক সেমিনারে সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিরা সে উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছেন সমবেত কণ্ঠে।

প্রতিনিধিরা বলেছেন, দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতটাই অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে যে, দেশে কোনো দিন পরিবর্তন এলে এগুলো ঠিকঠাক করার কাজ ৫৩ বছরেও শেষ করা যাবে না।

এই নৈরাশ্যজনক মন্তব্য বাস্তবতার প্রতিফলন। তবে এর উল্টো দিকও আছে। অকার্যকর বা ধ্বংস হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আবার গড়ে তুলতে ৫৩ মাসের বেশি লাগলে মেরামতের কাজটিই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে।

আর ৫৩ বছরেও শেষ হলে সমসাময়িক প্রজন্মের কয়জনই বা থাকবে সেই দায়িত্ব পালনের জন্য?

আরও পড়ুন

তত দিনে মানুষ প্রশ্ন করতে পারেন, কোনো প্রতিষ্ঠান ‘ঠিকঠাক’ করার কী ‘ঠেকা’ পড়েছে তাঁদের? পরিবর্তনের জোয়ারে তখনকার গোষ্ঠী নেতৃত্ব বলে বসতে পারে, এত প্রতিষ্ঠানের ঠেলা সামলানোর কী দরকার?

প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতার বিষয়টি সাধারণভাবে সর্বসাধারণের মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। তবে তাদের বোঝাপড়ায় স্কুল-কলেজে লেখাপড়া কেমন হয়, তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুণাগুণ সম্পর্কে ধারণা পায়।

নিয়ন্ত্রণকারী ও সেবা প্রদানকারী সংস্থা ও অন্যান্য নির্বাহী অফিস, বিচারালয় ও জাতীয় সংসদ যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সেটা তুলনামূলক অগ্রসর মানুষেরা ভালো বোঝেন। তাঁরা চাইলে সাধারণ মানুষকে ফাঁকিও দিতে পারেন।

ধরুন, যদি বলি, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ভোটাধিকার হরণ—এসবের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাই দায়ী, তাহলে জনসাধারণ না পারে নিজেদের যুক্ত করতে, না পারে কাউকে দোষারোপ করতে। জনসমক্ষে কথাবার্তা স্পষ্ট করে না বললে রাষ্ট্রযন্ত্রের পেছনে থাকা পরিচালনাকারী ব্যক্তিরা দায় থেকে রেহাই পেয়ে যান।

তারপরও কবিগানের এ দেশে মানুষ কিছুটা ‘জ্ঞানের’ কথাও শুনতে চান, কখনো কখনো পুরোপুরি না বুঝলেও। ‘সিন্ডিকেট’ শব্দটি বিদেশি হলেও ব্যবসায় এটি কী করে, তা তাঁরা ভালোই বোঝেন এবং তাঁদের বোঝাটা একেবারেই বাজারে যাওয়ার নিজস্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে।

আরও পড়ুন

শেয়ারবাজারে কারসাজি হলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন বলেই দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখান। কিন্তু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বাড়লে আমানতকারীরা চট করে রেগে যান না; কারণ, এর দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত সবাই আগে থেকে জানেন না।

তেমনি চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রভাব নাগরিকেরা তখনই টের পান, যখন তাঁদের বেশি কর ও সেবার মূল্য এবং পদে পদে টোল দিতে হয়।
কেউ চাকরি থেকে বঞ্চিত হলে কিংবা হাসপাতালে সেবা না পেলেও ব্যাপারটিকে যেন কিছুটা ভুক্তভোগীদের বিচ্ছিন্ন সমস্যা হিসেবেই দেখেন বাকিরা।

এগুলোর সমালোচনাও হয় বিচ্ছিন্নভাবে। বায়বীয় বিশ্লেষণে অনেকে আগ্রহী হন মূল ইস্যু অথবা নিজেদের দায় আড়াল করতে; আবার কিছু সমালোচক তা করেন নিরাপদ অবস্থানে থাকার আশায়।

আরও পড়ুন

ব্যাংক, শেয়ারবাজার, নিত্যপণ্যের বাজার ইত্যাদি প্রসঙ্গে যেমন আলোচনা-পর্যালোচনা হয়, তেমনি হয় বৈষম্য বৃদ্ধি নিয়েও—কেবল রোগ নিরাময় হয় না। জনদুর্ভোগ এবং মানুষের মৌলিক অধিকার ভঙ্গের জন্য কোন প্রতিষ্ঠান ও কারা দায়ী, তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য করে আলোচিত হয় খুব কমই।

রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের বিষয়টি নিয়ে কারও দিকে আঙুল তুলতে দ্বিধাই বেশি লক্ষ করা যায়।

নব্বইয়ের দশকে প্রতিষ্ঠান গড়ার গুরুত্ব নিয়ে আমরা এত সব আলোচনা শুনেছি যে মনে হতো প্রতিষ্ঠানের ভবন, জনবল কাঠামো ও বাজেট বরাদ্দ থাকলেই জনজীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ভূমিকাই যে মুখ্য, তা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলাম।

সুতরাং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস এবং তা অপব্যবহারের আলোচনায় কিছু কিছু নাম না এলে আমজনতা বুঝতে পারবে না, চেয়ারটা কী জিনিস এবং সমস্যাটা কোথায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে বিচারপতি খায়রুল হকের অবসরে যাওয়ার পর লিখিত রায় জাতির কী নির্বাচনী উপকার করেছে, সে আলোচনা আসবেই।

কাজী রকিবুদ্দিন আহমদ, কে এম নুরুল হুদা ও কাজী হাবিবুল আউয়ালেরা নির্বাচন কমিশনকে কোন উচ্চ মার্গে নিয়ে গেছেন, সে সম্পর্কে নির্মোহ মূল্যায়ন হওয়া উচিত।
এখন যারা সংসদে আছেন তাদের আত্মতৃপ্তি কোথায় তা বেশি বোঝা দরকার সেই প্রজন্মের, যে প্রজন্ম কার্যকর জাতীয় সংসদ দেখেনি।

প্রশাসনে দলীয়করণ, আর্থিক খাতের সর্বনাশ বা জাতীয় শিক্ষাকে গোল্লায় নিয়ে যাওয়ার ‘কৃতিত্বের’ জন্য ফিসফিস করে কিছু নাম উচ্চারিত হয় তাদের সঙ্গে, যাঁরা বিভিন্ন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বারোটা বাজিয়েছেন।

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দলগুলো অকার্যকর হয়ে গেলে অনুশোচনা দেখি না অনেকের মধ্যেই। সরকারি দল হারিয়ে গেছে ক্ষমতার উন্মাদনায় আর সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ রহিত করা হয়েছে বিরোধী দলের জন্য। যে দল ভাঙার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তার নেতৃত্বও এর কারণ জানে না। শুধু বোঝে, খেলছে এমন কেউ, যার কাজ এটি নয়।

তবু ভালো যে হতাশায় আচ্ছন্ন জাতির মধ্য থেকে বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ ৫৩ বছরেও প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকঠাক করা যাবে না বলে পরিস্থিতির গভীরতা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। জাতীয় বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা করায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের পর এই সিভিল সোসাইটিই কর্তৃপক্ষের ‘টার্গেট’ হয়ে যায়।

রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দলগুলো অকার্যকর হয়ে গেলে অনুশোচনা দেখি না অনেকের মধ্যেই। সরকারি দল হারিয়ে গেছে ক্ষমতার উন্মাদনায় আর সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ রহিত করা হয়েছে বিরোধী দলের জন্য। যে দল ভাঙার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তার নেতৃত্বও এর কারণ জানে না। শুধু বোঝে, খেলছে এমন কেউ, যার কাজ এটি নয়।

প্রতিষ্ঠান বিনষ্ট ও ‘রুলস অব দ্য গেম’ কাজ না করার কী অসাধারণ দৃষ্টান্ত!

সেবা নিয়ে নিজস্ব ক্ষোভের কথা কিছু মানুষ প্রকাশ করেন চায়ের আড্ডায়, কোনো গুরুগম্ভীর আলোচনা সভা বা টকশোর আগে ও পরে এবং অন্যদের সামনে মুখ খোলার সুযোগ থাকলে সেখানেই।

তাঁদের আক্ষেপ, কেন সহজে ব্যবসা করা যায় না বা আইনসম্মত প্রতিযোগিতার পরিবেশ নেই চারপাশে।

তাঁরা তো কারও বাড়া ভাতে ছাই দিচ্ছেন না, তাই তাঁদের প্রাপ্যটুকু কেন বিনা বাধায় পাওয়া যাবে না? এসব বুদ্ধিমান ভদ্রলোক শুধু বুঝতে পারছেন না, যে পারিপার্শ্বিক অবস্থায় তাঁরা আছেন, সেখানকার বৃহত্তর রাজনৈতিক ও শাসনপ্রক্রিয়া ও সংস্কৃতির বাইরে ভিন্ন কিছু ঘটবে কীভাবে?

আজকের এ বাস্তবতার সৃষ্টি এক দিনে হয়নি। অতীতে কখনো ফেরা যাবে না সত্য, কিন্তু প্রশ্ন তো আসেই। ঠিক সময়ে ‘হক’ কথাগুলো সোজা করে বললে, ন্যায়ের পক্ষে সরলভাবে অবস্থান নিলে অন্য কিছুও তো হতে পারত। এখন কৈফিয়ত চাওয়া জরুরি নিশ্চয়ই।

পরিবর্তন চাইলে মানুষকে তা ব্যাখ্যা করতে হবে পরিষ্কার ভাষায়। নিদেনপক্ষে এর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে হবে। এই অ্যাজেন্ডার ভিত্তিতে একটি প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা চালু হলে তখন পাঁচ বছরের জনপ্রিয় ম্যান্ডেট থাকবে তার পক্ষে।

মানুষের সম্মিলিত ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠান গড়া বা সংস্কার আনার জন্য ৫৩ মাস সময় কি যথেষ্ট নয়?

  • খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক