শাস্তি দিলেই কি বিচারকেরা কটুকথা থেকে সুরক্ষিত থাকবেন?

লাহোর হাইকোর্টছবি: এএফপি

পাকিস্তানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারের কারণ কী খুঁজে দেখতে সরকার একটি যৌথ তদন্ত দল গঠন করেছে। এই দলে তদন্ত ও গোয়েন্দা সংস্থার বেশ কজন কর্মকর্তা আছেন।

এই প্রেক্ষাপটে তিনটি জরুরি প্রশ্ন তোলা যায়। যৌথ তদন্ত দল যাকে আমরা জেটিআই বলছি, তাদের পক্ষে কি প্রকৃত তথ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে? যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রকটভাবে বিভক্ত ও বিষাক্ত? সরকার কি সত্যিই জানে না বিচারকেরা কেন নিশানা হচ্ছেন?

আদালত থেকে কিছু রায় এসেছে, যেগুলোকে বিতর্কিত বলে ধারণা করছেন অনেকে। সেটিই কি কারণ? তৃতীয় প্রশ্ন হলো, জেআইটি অপরাধীদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করলেই কি বিচারকেরা কটুকথা থেকে সুরক্ষিত থাকবেন? যখন আদালতের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়মিত বিতর্ক চলছে এবং আদালতের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি স্পষ্ট?

এই প্রশ্নের জবাব পেতে বিচার বিভাগসহ আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা ও বৈশিষ্ট্য এবং জনগণের ওপর তাদের প্রভাব অনুধাবন করতে হবে।

গণতন্ত্রে বিচারকসহ সরকারি সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের কাজ  জনগণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে। প্রকৃতপক্ষে সাংবিধানিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে কারা নিয়োগ পাচ্ছেন, তার সঙ্গে জবাবদিহি নিশ্চিতের প্রসঙ্গ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে, সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের মূল্যায়ন কী করে হবে, সেই বিধিবিধান ঠিক করে দেওয়া হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা কাজ করেন জনগণের অংশ হিসেবে; যে জনগণের পয়সায় তাঁদের বেতন হয়। ফলে তাঁদের কাজ করা উচিত জনস্বার্থে।

গণতন্ত্রে বিচার বিভাগ একটি পৃথক কিন্তু বিশেষ শাখা। তাই বলে বিচারকদের কাজ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে আলাদা নয়। তাদের অবশ্যই জনসাধারণের জন্য সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি আইন ও সংবিধানের মধ্যে থেকে যেন রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালিত হয়, তা–ও নিশ্চিত করতে হবে।

একইভাবে বিচারকদের কাছ থেকে পেশাদারি ও নৈতিকতা কাঙ্ক্ষিত। এর ব্যত্যয় ঘটলে মানুষ তিরস্কার করবেন। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। পশ্চিমা গণতন্ত্রে বিচারকদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যে আইন তা বহু আগেই গুরুত্ব হারিয়েছে। নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে শুধু বিচার বিভাগের নির্দেশ অমান্য করার চেষ্টায়।

পর্যাপ্ত সুরক্ষার অনুপস্থিতি থাকলেও বিচারকেরা কখনো বিদ্রূপের শিকার হয়েছেন, এমন ঘটনা বিরল। যোগ্য ও ন্যায়নিষ্ঠ বিচারকেরা সব সময়ই শ্রদ্ধার পাত্র। কারণ, তাঁরা জনগণকে সুরক্ষা দেন। ব্যক্তিমানুষ এবং সমষ্টিকে তাঁরা তাঁদের মতোই মানুষ বা কর্তৃপক্ষের বাড়াবাড়ি থেকে বাঁচান। তাঁরা কেবল অসদাচরণ বা প্রশ্নবিদ্ধ বিচারের কারণে সমালোচিত হন।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দুজন বিচারপতি—থমাস ক্লারেন্স ও স্যামুয়েল অ্যালিটো মারাত্মক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। প্রথমজন দামি দামি উপহার নিয়েছিলেন আর দ্বিতীয়জন বিনা পয়সায় ভ্রমণ করেছিলেন। কিন্তু জনগণের এই সমালোচনা বিফলে যায়নি। দ্রুতই বিচার বিভাগ আদালতের সদস্যদের আচরণবিধি নিয়ে আইন করে। একইভাবে রিপাবলিকানদের বসানো রক্ষণশীল বিচারকেরা গর্ভপাত, এলজিবিটি, বন্দুক এবং ভোটাধিকার–সংক্রান্ত আইনকে ওলটপালট করে আপত্তির মুখে পড়েন।  

আমাদের নৈতিক ও আইনি কিছু সমস্যা আছে। সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতিকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কোনো এক রহস্যজনক কারণে আরেক বিচারপতিও পদ ছেড়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁর ব্যক্তিগত নথিপত্রে কিছু ঝামেলা আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা রীতি আলাদা। আমাদের বিচারকেরা পান থেকে চুন খসলেই তাঁদের ভাবমূর্তি গেল কি না, তা নিয়ে পেরেশান হয়ে যান। কিন্তু তাঁদের এখতিয়ার মোতাবেক কর্তৃত্ব দেখানোয় চিন্তিত নন।

আদালতের প্রতি লাখ লাখ মানুষের মনোভাব বদলে যাবে—কর্তৃপক্ষ বা বিচারকদের এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ, মানুষ মনে করে আদালত তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। বরং পরিবর্তন দরকার বিচার বিভাগের আচরণের। মানুষ নিরাপত্তা, মুক্তি ও মর্যাদাপ্রত্যাশী। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতারা দেশের নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। প্রত্যেক বিচারকও এই প্রত্যাশা পূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

আদালত অবমাননার অভিযোগে অনেক রাজনীতিকের শাস্তি হয়েছে পাকিস্তানে। তবে বিচারকদের সম্মান রক্ষার ঔপনিবেশিক এই রীতি ক্রমে অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু দণ্ডবিধি আর রাষ্ট্রযন্ত্র সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই জনগণের একমাত্র আশ্রয়, যেখানে তারা তাদের অসন্তুষ্টি জোরেশোরে প্রকাশ করতে পারেন। মানুষ সমালোচনা করছে কারণ, বিচারকেরা কোনো না কোনো শিবিরে কিংবা রাজনৈতিক দলের দিকে হেলে পড়েছেন বলে ধারণা তৈরি হয়েছে।

আদালতের প্রতি লাখ লাখ মানুষের মনোভাব বদলে যাবে—কর্তৃপক্ষ বা বিচারকদের এ ধারণা সঠিক নয়। কারণ, মানুষ মনে করে আদালত তাদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। বরং পরিবর্তন দরকার বিচার বিভাগের আচরণের। মানুষ নিরাপত্তা, মুক্তি ও মর্যাদাপ্রত্যাশী। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতারা দেশের নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। প্রত্যেক বিচারকও এই প্রত্যাশা পূরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানের রাজনীতিকেরা সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে আইন পাস করার চেষ্টা করে থাকেন; কিন্তু গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, বিচার বিভাগও আইনকানুন নিয়ে কখনো এগোন, কখনো পেছান। আইন নিয়ে তাঁরা গুটি খেলেন। সাম্প্রতিক রায় তার প্রমাণ। নতুন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আদালত এ সময়ে বিভিন্ন রায়ে কিছু কর্মকাণ্ডকে সংশোধন ও উন্নয়নের চেষ্টা করেছেন। কখনো কখনো শাস্তিরও বিধান দিয়েছেন।

সংশোধনমূলক কাজের অংশ হিসেবে আদালত সংবিধানের ৬২ (১) এর (এফ) অনুচ্ছেদের অপসারণ করেছেন। ওই অনুচ্ছেদে রাজনীতিকদের যাবজ্জীবন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সুযোগ ছিল।

ধারণা করা হয়, বিবেকের তাড়না এবং কলঙ্কমুক্ত থাকতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়ার যে দায়, তা থেকে বিচারকেরা মুক্তি চান। কিন্তু আদালতের ভালো সিদ্ধান্ত হঠাৎ উল্টে যায়। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি বেঞ্চ পিটিআই যেন নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ না পায়, সেই আবেদনে সাড়া দেয়। ফলে দলটি নির্বাচনের বাইরে চলে যায়। নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্ত হয়তো সঠিক। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত আইনের ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ এবং অতীত দৃষ্টান্ত নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত ঘটায়।

প্রধান বিচারপতির কি এমন কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক ইস্যুতে বিচারে বসা উচিত, যিনি ক্ষমতায় থাকার সময় তাঁর (প্রধান বিচারপতি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন, তাঁর ক্ষমতা ও ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছেন এবং তাঁর পরিবারকে হতাশায় নিমজ্জিত করেছেন?

যদি বিকল্প সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ থাকত (যেমনটা তারা করেছিল নির্বাচন কমিশনের বেলায়), তাহলে কি পিটিআইকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ করে দেওয়াই শ্রেয় হতো না? কারণ, পিটিআই একটা জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। তারা যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত, তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বী সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা যেত।

বেনজির ভুট্টোর মামলাসহ বেশ কিছু দৃষ্টান্ত আদালতের হাতে ছিল। সেখান থেকে তাদের কেন সরে আসতে হলো? অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ইতিহাসেই এসব প্রশ্নের জবাব আছে। যদিও যে জবাব আমরা পেয়েছি, তা ছিল বিয়োগান্ত। যেমন সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ, ভুয়া ভোট, বিচার বিভাগের মেরুকরণ, নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র, রাজনীতিকদের ওপর নির্যাতন ইত্যাদি; কিন্তু আমরা কখনোই কিছু শিখলাম না।

জেআইটি অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে বিচার বিভাগের বিপথে যাওয়ার কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের যে মনোভাব, তাকে নিয়ন্ত্রণও করা যাবে না। আইনি ন্যায্যতা এবং আইনের ব্যাখ্যায় ধারাবাহিকতাই বিচারপতিদের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ বন্ধ করতে পারে। ইতিহাস বলে, নির্বাচনকে হাত করতেই বেছে বেছে নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

  • শাহাব উস্ত আইনজীবী ও শিক্ষাবিদ।
    পাকিস্তানের ডন পত্রিকার অনলাইন থেকে নেওয়া,  ইংরেজি থেকে অনূদিত