২০১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বসবাসের ৮ বছর হলেও তাদের প্রত্যাবাসনের কোনো ফলপ্রসূ অগ্রগতি আমরা দেখতে পাইনি। বিগত সময়ে আমরা কেবল তাদের প্রত্যাবাসনের নানা রকম আশার বাণীই শুনে এসেছি, যা ছিল বাস্তবতাবিবর্জিত এবং জনতুষ্টিবাদী পদক্ষেপ।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন যে দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর দিকে যাচ্ছে, সেটা বোঝার জন্য কাউকে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হবে না। প্রত্যাবাসনের জটিলতার সঙ্গে রয়েছে তহবিলের সংকট। সে কারণেই হয়তো সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যেও এক দীর্ঘ হতাশা কাজ করছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের জটিলতা ও অনিশ্চয়তার বিষয়গুলো বিবেচনা করে বেশ কয়েক বছর আগে লিখেছিলাম যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন একটি মিথে পরিণত হচ্ছে কি না। আমরা এখনো সে প্রশ্নের উত্তর জানি না।
এ সংকট মোকাবিলায় বর্তমান সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ হাতে নিলেও এর মাধ্যমে আসলে প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা কতটা বৃদ্ধি পেল, তা বলা মুশকিল। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থী বিষয়টিকে তারা যে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে, সেটা বোঝা যায়।
আমরা জানতে পেরেছি, সামনের দিনগুলোয় উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে, যার শুরু হবে কক্সবাজারে তিন দিনব্যাপী একটি সম্মেলনের মাধ্যমে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারে বাকি দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হওয়ার খবর আমরা জানতে পারি।
আমরা ধারণা করতে পারি, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলার আলোচনা কক্সবাজারের এই সম্মেলনে হবে, যা রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার দিকনির্দেশনা খুঁজে পেতে আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেহেতু প্রত্যাবাসন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, এর দ্রুত সমাধান এখানে পাওয়ার সম্ভাবনা কম, তাই এ সম্মেলনে যদি তহবিল সংগ্রহে কিছু অগ্রগতি আসে, সেটাও সহায়ক একটি বিষয় হবে। কেননা, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার জন্য তহবিল কমে যাওয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল বন্ধ করার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরনের ধাক্কা।
আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের পরিপূর্ণ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনই হতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। একে এখন প্রকল্পিত একটি বিষয় মনে হলেও যতটুকু সুযোগ আমাদের রয়েছে, তার যথাযথ ব্যবহার করার উদ্যোগ আমাদের হাতে নিতে হবে। অতীত কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ যেহেতু এই সংকটের কোনো সমাধান খুঁজে বের করতে পারেনি, তাই বাংলাদেশকে বিকল্প সমাধানেরও অন্বেষণ করতে হবে।
এর সঙ্গে এটিও মাথায় রাখতে হবে যে রোহিঙ্গা বিষয়কে কেন্দ্র করে ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক জটিলতাকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো সক্ষমতা বাংলাদেশের কম। এর পেছনে রয়েছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তার মধ্যে একটি হলো রাখাইনকে ঘিরে ভারত ও চীনের অন্তর্নিহিত স্বার্থ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল আগ্রহ।
রাখাইনকে কেন্দ্র করে ভারতের কালাদান প্রকল্প এবং চীনের জ্বালানি পাইপলাইনের অবস্থানের কথাও সাম্প্রতিক সময়ে বেশ জোরেশোরে জানা যাচ্ছে, যা বিগত সময়ে এতটা প্রকাশিত হয়নি। এর সঙ্গে রয়েছে রাখাইনে চলমান আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারে সামরিক জান্তার যুদ্ধ। এ প্রসঙ্গে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, আরাকান আর্মির উত্থান ও রাখাইনে তাদের প্রভাবের কারণে সেখানে বিদ্যমান রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মিয়ানমার সামরিক জান্তা, আরাকান আর্মি ও স্থানীয় রাখাইন জনগোষ্ঠীর যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে রোহিঙ্গাদের জীবনমানের সংকট আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা একদিকে মিয়ানমার জান্তার হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, আবার আরাকান আর্মিও তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বিগত ১৮ মাসে আরও প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
এই দমন–পীড়নে অনেক রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ চালিয়ে আসছে বলে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে। যদিও আরাকান আর্মি মনে করছে, এর পেছনে বাংলাদেশের ইন্ধন রয়েছে, যা বাংলাদেশ বেশ জোরেশোরেই খারিজ করেছে। শরণার্থীশিবিরে বসবাসরত অনেক রোহিঙ্গাও এই সশস্ত্র প্রতিরোধের বিষয়কে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বলে আমাদের সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মাঠপর্যায়ের গবেষণায় উঠে এসেছে।
এ প্রসঙ্গে এটাও ভেবে দেখা দরকার, এ ধরনের সশস্ত্র প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে দর-কষাকষির জন্য কতটা শক্তি সঞ্চয় করতে পারবে। তবে এর মাধ্যমে যে রোহিঙ্গা ও আরাকান আর্মির মধ্যকার সম্পর্কের আরও অবনতি হচ্ছে, সেটি অনুমেয়।
এমন একটি জটিল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে এই রোহিঙ্গা সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আরও বেশি কৌশলগত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। গবেষকেরা সব সময়ই বলে আসছেন, এ সংকটের কোনো সহজ ও দ্রুত সমাধান নেই। যেহেতু আরাকান আর্মি রাখাইনের একটি বড় অংশের দখলদারিত্বে রয়েছে, যা খুব শিগগির তাদের হাত থেকে চলে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশ আরাকান আর্মির সঙ্গে একধরনের দর–কষাকষির সুযোগ তৈরি করতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের একটি সুযোগ তৈরি হতে পারে।
মিয়ানমার জান্তার সঙ্গে যুদ্ধের কারণে আরাকান আর্মি রাখাইনের অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তাদের নানা ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তাদের যোগাযোগব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা তৈরি হওয়ার ফলে রাখাইনে খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিসের সংকট তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে জরুরি চিকিৎসাসামগ্রীও রয়েছে। এর থেকে উত্তরণের একটা সহায়ক মাধ্যম হতে পারে বাংলাদেশ।
যেহেতু মানবিক করিডর নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে, যা অনেক দেশের প্রেক্ষাপটে আর মানবিক থাকেনি, তাই বিকল্প হিসেবে আরাকানের সঙ্গে একধরনের অনানুষ্ঠানিক ব্যবসার ধারণা কাজে লাগানো যেতে পারে। এটি তাদের জন্য একটি প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে, যাতে করে রাখাইনে খাদ্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর একটি প্রবাহ শুরু হবে।
সীমান্তবর্তী এলাকায় এ ধরনের ব্যবসা আসলে নতুন কোনো উদ্যোগ নয়, সীমান্ত এলাকায় সব দেশে এটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে থাকে। রাখাইনের সঙ্গেও বাংলাদেশের এমন ব্যবসায়িক বন্দোবস্ত দীর্ঘ সময় ধরে ছিল, এখনো কোনো না কোনোভাবে তা সীমিত আকারে রয়ে গেছে।
এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থার উন্নয়ন ঘটবে, যা রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় ভবিষ্যৎ সংলাপে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। এর সঙ্গে দ্বিতীয় যে বিষয় সামনে নিয়ে আসতে হবে, সেটি হলো আরাকান আর্মিকে বোঝাতে হবে যে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের উদ্যোগের মাধ্যমে আরাকান আর্মি আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজেদের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারবে, যা আরাকান আর্মির জন্য একটি বড় প্রণোদনা হিসেবে কাজ করবে।
এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের কৌশলগত তৎপরতাও চালিয়ে যেতে হবে। যেমনটি আমরা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের মালয়েশিয়া সফরের একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারি, আসিয়ানের আঞ্চলিক একটি দল মালয়েশিয়ার নেতৃত্বে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি শান্তি মিশন মিয়ানমার যাবে রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে আলোচনার জন্য। বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার এ ধরনের সহযোগিতার পূর্ণ ব্যবহার করতে চায়।
আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গাদের পরিপূর্ণ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনই হতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। একে এখন প্রকল্পিত একটি বিষয় মনে হলেও যতটুকু সুযোগ আমাদের রয়েছে, তার যথাযথ ব্যবহার করার উদ্যোগ আমাদের হাতে নিতে হবে। অতীত কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ যেহেতু এই সংকটের কোনো সমাধান খুঁজে বের করতে পারেনি, তাই বাংলাদেশকে বিকল্প সমাধানেরও অন্বেষণ করতে হবে।
এর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার দিকেও মনোযোগ দিতে হবে, যাতে তারা এ দক্ষতা দেশে ফেরত গেলে কাজে লাগাতে পারে। তহবিলসংকটের এই সময়ে প্রত্যাবাসন আরও দীর্ঘায়িত হলে যেন আমাদের হাতে বিকল্প পরিকল্পনা থাকে, সেদিকেও মনোযোগ দিতে হবে। নির্যাতনের শিকার ও বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের ভাগ্য উন্নয়নের দায় যেহেতু আমাদের কাঁধেই, তাই এর যথাযথ ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের সাহায্য নিয়ে সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
বুলবুল সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়