আমাদের সফটওয়্যার খাত কি কুমিরের সাত ছানার গল্প হয়ে উঠেছে?

গল্পের সেই কুমিরের সাত ছানার কথা নিশ্চয় মনে আছে। লেখাপড়া শেখানোর জন্য কুমির তার বাচ্চাদের নিয়ে রেখে এল শিয়াল পণ্ডিতের কাছে। পাঠদানের ভান করা শিয়াল প্রতিদিন একটি করে কুমিরছানা খেয়ে ফেলতে থাকল। কুমির তার বাচ্চাদের দেখতে এলে চতুর শিয়াল সব কটি বাচ্চা একসঙ্গে না দেখিয়ে একটি একটি করে দেখায়। প্রথম দিন একটি বাচ্চা খেয়ে ফেলার পর বাকি ছয়টি বাচ্চা কুমিরকে দেখিয়ে সাত নম্বর হিসেবে আগে দেখানো একটি বাচ্চাকে আরেকবার দেখিয়ে দেয়। এভাবে একের পর এক ছানাগুলোকে খেয়ে শেষ করে আগে দেখানো বাচ্চাকে বারবার দেখিয়ে বোকা কুমিরকে বুঝ দিতে থাকে গল্পের শিয়াল।

আমাদের সফটওয়্যার খাত হয়ে উঠেছে কুমিরছানার গল্পের মতো। সেই কবে আওয়াজ তোলা হয়েছিল, ২০২১ সালের মধ্যে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের সফটওয়্যার রপ্তানি করা হবে। তারপর সুনীলের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার মতো ‘কত চন্দ্রভুক অমাবস্যা এসে চলে গেল’, কিন্তু সেই পাঁচ বিলিয়ন ডলার আর এল না। এখন বলা হচ্ছে, সেই লক্ষ্য অর্জিত হবে ২০২৫ সালের মধ্যে। কিন্তু কোথাও বলা হচ্ছে না সফটওয়্যার খাতের কোন কোন উপখাত থেকে সেই পাঁচ বিলিয়ন ডলার আসবে? নাকি ঘুরেফিরে সেই ফ্রিল্যান্সিংয়ে বিশ্বে দ্বিতীয় আর জনমিতির সুবিধার (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) সেই পুরোনো বাণীই চলতে থাকবে।

বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিবছর ভালোসংখ্যক তথ্যপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। সীমিত মাত্রায় হলেও চলছে গবেষণা। সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি থেকে শিল্প-শিক্ষা সহযোগিতার যে ঘোষণা এসেছে, সেটি আশার বিষয়। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সে সহযোগিতার ধরন কী হবে, সেটি সতর্কতার সঙ্গে নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষা খাত ও শিল্প খাত, দুটি খাতেই সীমাবদ্ধতা আছে।

২০২১ সালের মধ্যে নির্ধারিত পাঁচ বিলিয়ন ডলার আমরা কেন লক্ষ্য অর্জন করতে পারলাম না, সেটির বিশ্লেষণ কি হয়েছে? সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২৫ সালের সেই ভুলের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সেটির উদ্যোগ কি নেওয়া হয়েছে? আমাদের এমন এক সংস্কৃতি, যেখানে বাজেট ঘোষণার আগেই ‘এই বাজেট মানি না’ ব্যানার প্রস্তুত হয়ে যায়, পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার আগেই পরীক্ষা পেছানোর আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ২০২৫ সালের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করে সঙ্গে সঙ্গে কেন সেই লক্ষ্য অর্জন করা যায়নি, সেই অজুহাতও আমরা আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখিনি তো?

বাংলাদেশে অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি বলেছেন, ‘আমরা তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আসলে ভালো নেই। আমাদের অনেক কিছু করার আছে। সে কাজগুলো করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশে কী করতে পারিনি, আমাদের তা দেখতে হবে। সে কাজগুলো স্মার্ট বাংলাদেশে করতে হবে’ (প্রথম আলো, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩)। বেসিস সভাপতির এই কথাগুলো উদ্বেগের এবং সরকারের ওপর মহল থেকে মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। আমাদের সফটওয়্যার খাতটি খুব সম্ভাবনায়। সত্যিকার অর্থেই কয়েক বছরের মধ্যে পাঁচ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় সম্ভব। তবে সে জন্য সঠিক ও যৌক্তিক বিশ্লেষণ এবং সরকারি সহায়তা জরুরি।

বেসিস সভাপতি আরও জানিয়েছেন, ২০৩১ সালের মধ্যে ২০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় সম্ভব। এটি আদৌ কি কোনো যৌক্তিক বক্তব্য? যৌক্তিক হয়ে থাকলে সেটি খুশির কথা। তবে কীভাবে হিসাব করে এটি নির্ধারণ করা হয়েছে, ২৫ কিংবা ১৫ না হয়ে ঠিক ২০ বিলিয়ন কীভাবে এল, সফটওয়্যারে বিভিন্ন খাতের কোন খাত থেকে কত আসবে (ব্রেকডাউন), এ প্রশ্নগুলোর উত্তরও পরিষ্কার করা প্রয়োজন। সেটি হলে অন্তত কোন খাতে আমরা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছি, তা নির্ণয় করা সম্ভব হবে।

এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পরপর তিন অর্থবছরে কম্পিউটার সেবা (সফটওয়্যার, ডেটা প্রক্রিয়াকরণ, পরামর্শ প্রদান) খাতের রপ্তানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৭৬, ৩০৩ ও ৫৯২ মিলিয়ন ডলার। উল্লেখ্য, সফটওয়্যার খাতের বেশ কিছু ডেটা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে উঠে আসে না।

কিছুটা অনানুষ্ঠানিক ডেটার ওপর ভিত্তি করে বলা হয়ে থাকে যে সফটওয়্যার খাত থেকে বর্তমানে বছরে আমরা ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে থাকি।
সরকারের পাশাপাশি বেসিস সভাপতি শিল্প-শিক্ষা সহযোগিতার (ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া কোলাবরেশন) কথা বলেছেন। শিল্প-শিক্ষা সহযোগিতার বেশির ভাগ মডেলের বৈশিষ্ট্য হলো, ইন্ডাস্ট্রি কী কী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, যেটি প্রচলিত উপায়ে সমাধান করা যাচ্ছে না, প্রথমে সেটি চিহ্নিত করা; তারপর সমস্যার ধরন অনুযায়ী একাডেমিক গবেষণার মাধ্যমে ইন্ডাস্ট্রি থেকে ক্রমাগতভাবে ফিডব্যাক গ্রহণ করে সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করা।

এ কার্যক্রমের অন্তরায় হিসেবে একদিকে আছে একাডেমিয়ার ধীরগতিতে চলার সংস্কৃতি, অন্যদিকে ইন্ডাস্ট্রির ডেডলাইন মেনে কাজ চালানোর বাধ্যবাধকতা, কিংবা অল্প দিনের মধ্যেই বিনিয়োগ তুলে আনার প্রবণতা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একাডেমিয়া নিয়মিতভাবে কারিকুলাম হালনাগাদ করার ক্ষেত্রে অনীহা প্রদর্শন করে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি শেখার যে চ্যালেঞ্জ আসে, সেটি গ্রহণ না করে সে পুরোনো কারিকুলাম আঁকড়ে ধরে থাকে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের লব্ধ জ্ঞান ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়ে অকেজো হয়ে পড়ে।

কেউ কেউ আবার মনে করেন, এই কোলাবরেশনের অর্থ হচ্ছে, যে সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তি নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি কাজ করে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সে প্রযুক্তিতে পারদর্শী গ্র্যাজুয়েট তৈরি করে ইন্ডাস্ট্রিতে পাঠিয়ে দেবে। বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য কর্মী তৈরি করা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর ভিত্তি তৈরি করবে, মৌলিক জ্ঞান প্রদান করবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে প্রস্তুত করবে পানির মতো করে, যাতে শিক্ষার্থীকে যখন যে পাত্রে রাখা হবে, তখন সে পাত্রের আকার ধারণ করতে পারবে। ইন্ডাস্ট্রির কাজ হবে সদ্য গ্র্যাজুয়েট হওয়া শিক্ষার্থীকে প্রয়োজনীয় আকার (প্রশিক্ষণ) দিয়ে ইন্ডাস্ট্রির উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।

আরও পড়ুন

বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিবছর ভালোসংখ্যক তথ্যপ্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। সীমিত মাত্রায় হলেও চলছে গবেষণা। সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি থেকে শিল্প-শিক্ষা সহযোগিতার যে ঘোষণা এসেছে, সেটি আশার বিষয়। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সে সহযোগিতার ধরন কী হবে, সেটি সতর্কতার সঙ্গে নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের দেশের শিক্ষা খাত ও শিল্প খাত, দুটি খাতেই সীমাবদ্ধতা আছে। পথ চলতে গিয়ে প্রতিনিয়ত সেগুলোকে পথে পথে হোঁচট খেতে হচ্ছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটিও মনে রাখতে হবে, পথ চলতে হোঁচট খাওয়ার মানে এই নয় যে সঠিক পথ ফেলে ভুল পথে হাঁটা শুরু করতে হবে।

  • ড. বি এম মইনুল হোসেন অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
    Email: [email protected]