মিডিয়ার ‘ফটোকার্ড’ যখন গুজবের অস্ত্র

‘নির্দিষ্ট করে ফটোকার্ডের জন্মলগ্ন সেভাবে বলা না গেলেও মূল ধারার গণমাধ্যমের আদল ব্যবহার করে ভুল তথ্য ছড়ানো নতুন কিছু নয়।’

গুজবের ময়দানে নতুন অস্ত্র এখন মিডিয়ার বানানো ‘ফটোকার্ড’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত মনোযোগ আকর্ষণ এবং ভিউয়ারশিপ বাড়ানোর জন্য গণমাধ্যমগুলো ফটোকার্ড উদ্ভাবন করেছিল। ফটোকার্ড হচ্ছে মূলত একটি ছবি, যেখানে মূল খবরের শিরোনাম বা সারাংশ থাকে, থাকে প্রাসঙ্গিক একটি ছবি।

বিভিন্ন মিডিয়া তাদের লোগো দিয়ে নিজেদের জন্য প্রাসঙ্গিক একটা টেমপ্লেট বানিয়ে ফটোকার্ড শেয়ার করে থাকে। এতে সংবাদটি বেশি ভিউয়ারশিপ পায়। পরিহাসের বিষয় হলো, এই সহজলভ্য প্রযুক্তি বর্তমানে গুজব নির্মাতাদের প্রিয় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। কারণ, ফটোকার্ড খুব সহজেই সম্পাদনযোগ্য একটি টেমপ্লেট। গুজব যাঁরা তৈরি করেন, তাঁদের কাছে এটি কিছুটা দুই মিনিটে বানানো ম্যাগি নুডলসের মতোই লোভনীয় ও সহজ।

এই ফটোকার্ডকে ঘিরে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে আছে মূল ধারার গণমাধ্যম ও গুজব নির্মাতারা। একদিকে প্রচারিত সংবাদকে বিকৃত করে বিশেষ কোনো মিডিয়ার ব্যানারে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে এই গুজবকে শনাক্ত করতে গিয়ে সেই মিডিয়াকেও অতিরিক্ত তৎপর থাকতে হচ্ছে। ফলে তারা তৈরি করছে আরেকটি ফটোকার্ড। নির্বাচনকে সামনে রেখে এই তৎপরতা এখন বেশ লক্ষণীয়।

নির্দিষ্ট করে ফটোকার্ডের জন্মলগ্ন সেভাবে বলা না গেলেও মূল ধারার গণমাধ্যমের আদল ব্যবহার করে ভুল তথ্য ছড়ানো নতুন কিছু নয়। দুই-এক বছর আগেও সংবাদমাধ্যমের লোগো ব্যবহার করে মনগড়া তথ্য শেয়ার করার নজির পাওয়া যায়। এই যেমন ২০২১ সালে যুগান্তরের লোগো ব্যবহার করে ভুয়া স্ক্রিনশট ছড়ানো হয়েছিল। আবার ২০২২ সালে রাজনীতিবিদদের পলায়ন প্রসঙ্গে একটি গুজবে প্রথম আলোর লোগো এবং তার ওয়েবসাইটে ব্যবহৃত খবরের টেমপ্লেট নকল করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া ডিসমিস ল্যাবের একটি প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যমের লোগো ব্যবহার করে কীভাবে অবৈধ বেটিং সাইটের প্রচার করা হয়েছে, সে বিষয়ও উঠে এসেছিল। কিন্তু এর কোনোটাই সম্প্রতি আলোচিত ফটোকার্ডের মতো নয়। এটি কিছুটা ভিন্ন।

অনেক গণমাধ্যম আগের মতো এখন আর সরাসরি খবরের লিংক ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে না। যেহেতু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলনামূলকভাবে ছবি ও ভিডিওর জনপ্রিয়তা ও গুরুত্ব বেশি, সেহেতু ফটোকার্ডের মাধ্যমেই তারা খবর প্রকাশ করে। এসব ফটোকার্ডে ব্যবহার করা হয় গণমাধ্যমের লোগো।

এখন দেখা যাচ্ছে, অনেকেই এই পরিচয় ঠিক রেখে ছবিটি বিকৃত করে ভুয়া তথ্য জুড়ে দিচ্ছেন। তাই ভুয়া ফটোকার্ডকে আমরা বিকৃত ছবি বা ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে সম্পাদিত ছবি হিসেবেই চিন্তা করতে পারি।

উদাহরণ হিসেবে সময় টিভি প্রকাশিত ফটোকার্ড আর সময় টিভি প্রকাশিত নয় এমন একটি ফটোকার্ড দেখুন

মেসিকে নিয়ে সময় টিভির ফটোকার্ড (বামে)। সময় টিভির লোগো জুড়ে দিয়ে বানানো আরেকটি ফটোকার্ড (ডানে)

অতটা নিখুঁত না হলেও এটি পরিষ্কার যে সময় টিভির ফটোকার্ড থেকে মূল লেখাটি মুছে বানোয়াট একটি মন্তব্য জুড়ে দিয়ে আরেকটি ফটোকার্ড বানানো হয়েছে।

এবার ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের বক্তব্য নিয়ে প্রথম আলো প্রকাশিত আরেকটি ফটোকার্ড এবং সেই বক্তব্য বিকৃত করে তৈরি আরেকটি ফটোকার্ড লক্ষ করুন:

মাহ্ফুজ আনামের নামে দুইটি ফটোকার্ড। বামেরটি প্রথম আলো প্রকাশিত আর ডানেরটি বক্তব্য বিকৃত করে বানানো।

বিকৃত করে বানানো ফটোকার্ডটি আগের তুলনায় অনেক নিখুঁতভাবে বানানো। সাম্প্রতিক যেসব ফটোকার্ড ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে, সেগুলো অনেকটাই এ রকম নিখুঁত। ফলে বিভ্রান্তি বাড়ছে পাঠকের। দুশ্চিন্তা বাড়ছে মিডিয়ার।

বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর গত এক মাসের প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমের নির্দিষ্ট কিছু টেমপ্লেট ব্যবহার করে এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, একাত্তর টিভি, সময় টিভিসহ বেশ কিছু গণমাধ্যমের ফটোকার্ড নকল করা হয় এসব ক্ষেত্রে। তবে এসব গুজবে ব্যবহৃত ফটোকার্ডের সিংহভাগই শুধু প্রথম আলো প্রকাশিত ফটোকার্ডের নকল। শুধু যে মূল ধারার গণমাধ্যমের টেমপ্লেট ব্যবহার করা হচ্ছে তা-ও নয়, ইআরকি নামের একটি স্যাটায়ার ফেসবুক পেজের টেমপ্লেটও এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে।

আরও পড়ুন

আমার ধারণা, এসব গুজব নির্মাতা কার নাম-পরিচয় ব্যবহার করবেন, তা ঠিক করেন গণমাধ্যমগুলোর জনপ্রিয়তা, নির্ভরযোগ্যতা ও প্রাসঙ্গিকতার ওপর ভিত্তি করে। তবে এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের গ্রহণযোগ্যতা বড় একটি বিষয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে যে সাধারণ পাঠকের কাছে কোন গণমাধ্যমটি বেশি গ্রহণযোগ্য, সেটি এই বিশেষ ধরনের গুজবের মাধ্যমে জানা সম্ভব কি না?

এবার যদি এসব নকল ফটোকার্ডে উঠে আসা ইস্যুগুলো পর্যবেক্ষণ করি, দেখা যাবে যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইস্যুগুলো রাজনৈতিক এবং সমসাময়িক সামাজিক ঘটনাসংবলিত। এর মধ্যে রাজনৈতিক গুজবের সংখ্যাই বেশি। রাজনৈতিক বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে সমসাময়িক বিভিন্ন কথাবার্তা, যার বড় একটি অংশজুড়ে আছে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উক্তি বিকৃত করা। যেমন হিরো আলমকে নিয়ে মির্জা ফখরুলের বক্তব্য, আন্দালিব রহমান পার্থকে নিয়ে হিরো আলমের বক্তব্য, পিনাকী ভট্টাচার্যকে নিয়ে নুরুল হক নুরের বক্তব্য ইত্যাদি।

অন্যদিকে, সমসাময়িক সামাজিক বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ২০২৩ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। যেখানে খুবই অদ্ভুত কিছু দাবি দেখতে পাওয়া যায়। যেমন ‘ডেঙ্গু হলেই “অটো জিপিএ-৫” পাবে এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা’, ‘এইচএসসি পরীক্ষার সময়সূচি বদলানোর জন্য সভা ডেকেছেন শিক্ষামন্ত্রী’ ইত্যাদি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত এসব গুজবের নিচে মানুষের মন্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ ধরনের গুজব বিশ্বাস করছেন এমন মানুষের সংখ্যা একদমই কম নয়। তারেক জিয়ার পক্ষে মাহ্ফুজ আনামের বক্তব্য থেকে শুরু করে ‘ডেঙ্গু হলে অটো জিপিএ-৫’—এই সব গুজবকেই ভালোসংখ্যক মানুষ সত্যি বলে মনে করেছে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, মানুষ বিশ্বাস কেন করছে? এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। একটা কারণ হতে পারে, আমাদের কগনিটিভ বায়াস বা জ্ঞানগত পক্ষপাত।
অর্থাৎ আমি যা দেখতে চাই, যা সত্যি হলে আনন্দ পাই, সেটি তথ্য আকারে এলে যাচাই ছাড়াই বিশ্বাস করে ফেলার মতো ঘটনা ঘটে।

আরও পড়ুন

গুজব আমাদের জ্ঞানগত পক্ষপাতকে চাতুর্যের সঙ্গে ব্যবহার করে। যেমন সাঈদীর মৃত্যুর সংবাদে যখন ‘একাত্তরের ঘৃণ্য রাজাকার’ শব্দগুলো খুঁজে পাওয়া গেল, তখন একটি গোষ্ঠীর সেটি ভালো লেগেছে। কারণ, তারা তাঁকে ‘ঘৃণ্য রাজাকার’রূপে চিহ্নিত করেন। কিংবা যখন দেখছেন, ডেইলি স্টার সম্পাদকের জবান থেকে তারেক জিয়া সম্পর্কে ইতিবাচক বক্তব্য গুজব আকারে আসছে, তখন তারেক জিয়ার সমর্থকেরা এটাকে অবলীলায় বিশ্বাস করে ফেলছেন।

আবার মাহ্ফুজ আনামের সমালোচকেরা তাঁর ‘দুরভিসন্ধি’ নিয়ে নিশ্চিত হয়ে পড়ছেন কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই। আবার, ডেঙ্গু হলে জিপিএ-৫ দিয়ে দেবে; এই দাবি সম্পূর্ণ বাস্তবতাবিবর্জিত হলেও কারও কারও মনের ভেতর এমন আকাঙ্ক্ষা থাকায় অনেক পরীক্ষার্থী ও অভিভাবক সেটি বিশ্বাস করতে চান। গুজব এভাবে পালে হাওয়া দেয়।

এ ছাড়া এসব ফটোকার্ডের সূত্রগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, কোনো দল বা মতের আদর্শিক অবস্থান থেকে তার পক্ষে যাচ্ছে, এমন কোনো সংবাদ বা মন্তব্য প্রকাশ করা হচ্ছে। যেমন মাহ্ফুজ আনামের ভুয়া বক্তব্যটি যেসব পেজ থেকে ছড়িয়েছে, তার ভেতর একটি হচ্ছে ‘ফ্যানস অফ জার্নালিস্ট ইলিয়াস হোসেন’ নামের একটি পেজ, যেটি স্বভাবতই আদর্শিকভাবে বিএনপিপন্থী।

একইভাবে ‘উই ওয়ান্ট শেখ হাসিনা’ নামক ফেসবুক পেজ বা ক্ষমতাসীন সরকারের পক্ষের মতাদর্শের ফেসবুক পেজগুলো থেকে প্রকাশিত হয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত ও জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যু নিয়ে নিম্নোক্ত ফটোকার্ডটি:

আরেকটি কারণ হলো, উক্ত সময়ে নির্দিষ্ট ওই গুজবের প্রাসঙ্গিকতা। যেমন ডেঙ্গুর গুজবটিই দেখা যাক; এখানে বলা হচ্ছে, ডেঙ্গু হলেই ‘অটো জিপিএ-৫’ পাবেন এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। খেয়াল করলে দেখা যাবে, গুজবটি এ বছর আগস্টের মাঝামাঝি সময় ছড়ায়। তখন কী হচ্ছিল? এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের একাংশ দাবি করছিল যেন পরীক্ষাটি পিছিয়ে নেওয়া হয়। এর কারণ হিসেবে তারা অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা ও ডেঙ্গুর প্রকোপকে সামনে নিয়ে এসেছিল। অর্থাৎ গুজবটি যদি প্রাসঙ্গিক হয়, তাহলে সেটি যে গোষ্ঠীর পক্ষে যাচ্ছে, তারা সেটিকে বিশ্বাস করতে চাচ্ছে।

এই বিশ্বাসযোগ্য করার কাজটিকে আরও সহজ করে দিচ্ছে প্রথম আলো কিংবা ডেইলি স্টার এর মতো সংবাদমাধ্যমগুলোর লোগো আর টেমপ্লেট। পরিচিত গণমাধ্যমের পরিচয় ব্যবহার করার কারণে একধরনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। এ কারণেই বেশির ভাগ ফটোকার্ড নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমের নামেই প্রকাশিত হচ্ছে। অর্থাৎ পরিচয় নকলের মাধ্যমে একধরনের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, গণমাধ্যমের এই সংক্ষেপকরণই এখন তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুজবসংবলিত এসব ফটোকার্ডের বিপরীতে আরেকটি সতর্কতামূলক ফটোকার্ড এখন প্রায় নিয়মিত ঘটনা। মূল ধারার গণমাধ্যম বিশেষ করে প্রথম আলোকে প্রায় নিয়মিতই বানোয়াট এসব ফটোকার্ডের বিপরীতে সেটিকে ‘মিথ্যা প্রচারণা’ বলে আরেকটি ফটোকার্ড প্রকাশ করতে হচ্ছে।

ডেইলি স্টার কিংবা অন্যান্য গণমাধ্যমকেও আমরা দেখেছি একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে। এতে করে একদিকে যেমন তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি, অন্যদিকে এর পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে একটা ভালো পরিমাণ সময় এবং জনবল। নকল ফটোকার্ড একদিকে যেমন অপতথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করছে, অন্যদিকে মূল সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে করছে প্রশ্নবিদ্ধ।

  • শুভাশীষ দীপ তথ্য যাচাই কার্যক্রম ফ্যাক্টওয়াচের একজন ফ্যাক্ট-চেকার।