রোল মডেলের শিরোপা রক্ষা কঠিন হয়ে যাচ্ছে কি

আচানক হামুন কেন কক্সবাজারপানে ছুটে এল? যাওয়ার কথা বরগুনায়, কেন গেল কক্সবাজার?

এই লেখা যখন শুরু করেছি, তখন হামুন চলে যাওয়ার পর ৪০ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। তখনো বিদ্যুতের দেখা নেই ক্ষতিগ্রস্ত কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও কক্সবাজার শহরের বেশির ভাগ এলাকায়। খাবার, পানীয় জলসহ নানা সংকটে কাতর সেখানকার বসতি। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক না থাকায় মুঠোফোন নেটওয়ার্কও বিপর্যস্ত এসব এলাকায়।

নামধাম দিয়ে হামুনকে যত জাঁদরেল বলেই হাজির করা হোক না কেন, এটা আদতে ছিল আশ্বিন-কার্তিকের স্বাভাবিক এক মৌসুমি ঝড়। কিতাবের ভাষায় বলা যায়, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়। হামুনের ছোটার গতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মাত্র ঘণ্টা কয়েকের জন্য এই ঝড় হয়ে উঠেছিল সিভিয়ার ট্রপিক্যাল স্টর্ম বা তীব্র ঝড়। তাতে কক্সবাজারে ৩৭ হাজার ৮৫৪টি বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আত্মতুষ্টির কোনো স্থান নেই। প্রতিটি দুর্যোগে সাড়াদান প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছতার সঙ্গে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করে ভুলভ্রান্তিগুলো কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা করতে হবে। একটা সোজাসাপটা সাইক্লোন-পূর্বাভাস চালু করা এখন সময়ের দাবি

কক্সবাজার সদরে পল্লী বিদ্যুতের ৪৫টি খুঁটি ভেঙে যায়, হেলে পড়ে ৪০টি খুঁটি। তিন উপজেলার (কুতুবদিয়া, চকরিয়া ও মহেশখালী) সংখ্যা যোগ করলে ভেঙে পড়া বৈদ্যুতিক খুঁটির সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩৫৪। ট্রান্সফরমার নষ্ট হয় ১৫টি, ভেঙে যায় ২৫০টি বৈদ্যুতিক মিটার, বিভিন্ন স্থানে সঞ্চালন লাইনের ওপর গাছ পড়ে ছিঁড়ে যায় বিদ্যুতের তার। এক চকরিয়া উপজেলায়ই পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মোট ৯১ হাজার ২৫৭ জন গ্রাহক বিদ্যুৎহীন ছিলেন দীর্ঘক্ষণ।

সংকেত নিয়ে বিভ্রান্তি

হামুন ২৪ অক্টোবর রাতে কক্সবাজার উপকূলীয় অঞ্চল অতিক্রম করে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে ফোন আসতে থাকে। সবাই বিস্মিত। ঝড় এখানে কেন? আমরা তো ঝড়ে উড়ে যাচ্ছি! সন্ধ্যার আগে থেকেই বিদ্যুৎ ছিল না। মুঠোফোন চার্জ দিতে না পারলে কী হবে, সেটা নিয়েই চিন্তা বেশি। কক্সবাজারে কর্মরত বিভিন্ন জেলার অধিবাসীদের দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। অনেকেই অভ্যস্ত মুঠোফোনে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না।

সবারই একটি প্রশ্ন, আচানক হামুন কেন কক্সবাজারপানে ছুটে এল? যাওয়ার কথা বরগুনায়, কেন গেল কক্সবাজার? খটকাটা এখানেই। শুরুতে একটু অস্পষ্টতা থাকলেও হামুনের কিন্তু বরাবরই কক্সবাজার দিয়ে ইম্ফলের দিকে ছুটে যাওয়ার ঝোঁক ছিল। ঝড়ের পূর্বাভাস নিয়ে কাজ করা সংস্থা ট্রপিক্যাল স্টর্ম রিস্ক (টিএসআর) প্রথম থেকেই তাদের পূর্বাভাস মানচিত্রে সে রকমই দিকনির্দেশ বা সতর্কসংকেত দিয়ে আসছিল। তাদের কথাই ফলেছে, শেষ পর্যন্ত সেটাই ঘটেছে। কিন্তু কক্সবাজারের বাসিন্দারা এ রকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিল না। তারা পড়ে যায় এক অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে।

হামুন ছিল চটজলদি জন্ম নেওয়া এক ঝড়। এসব ঝড়ের প্রকৃতি ধীরে ধীরে জন্ম নেওয়া ঝড়ের সঙ্গে মেলে না। আশ্বিন-কার্তিক মাসে এ ধরনের ঝড়ের যেমন দ্রুত সৃষ্টি, তেমনি চট করেই এর পতন হয়। অপরদিকে সাগরে সময় নিয়ে সৃষ্টি হওয়া ঝড়ের চেহারা হয় অন্য রকম। সময় নিয়ে ঘনীভূত হওয়া আর ধীরে–সুস্থে এগোতে থাকা ঝড়ের রূপ হয় ভয়াবহ। সেদিক থেকে হামুন ছিল এক মামুলি ঝড়। তবে মামুলি হলেও পতনের সময় আর জোয়ারের সময় খুব কাছাকাছি হয়ে যাওয়ায় বাতাসের গতিবেগ মামুলি ঝড়ের মতো ছিল না।

আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান টাইড ফোরকাস্টের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ অক্টোবরের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার সময় জোয়ারের কারণে কক্সবাজার উপকূলে পানির উচ্চতা ছিল প্রায় ৯ দশমিক ১ ফুট। পূর্ণিমার সময় হলে উচ্চতা আরও দুই থেকে আড়াই ফুট বেড়ে যেত। আমাদের আবহাওয়া অফিস নানা সীমাবদ্ধতা আর নিয়মনীতির ঘেরাটোপে কাজ করে। অনেক সময় বুঝতে পারলেও বোঝাতে পারে না। হামুন-সতর্কতা আবারও সেসব কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।

হামুন আমাদের প্রস্তুতির ঘাটতিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল, কে কবে বাংলাদেশকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় চ্যাম্পিয়ন বা রোল মডেলের শিরোপা দিয়েছিল, তা কোথাও লেখা নেই। হয়তো মনের অজান্তে আমরা নিজেরাই নিজেদের ইমেরিটাস ঘোষণা দিয়ে আত্মতুষ্টির স্বর্গে চলে গেছি। দেশে-বিদেশে বলে বেড়াই, আমাদের ব্যবস্থাপনার ঠ্যালায় এখন আর মানুষ আগের মতো মরছে না।

লাশের সংখ্যা দিয়ে দুর্যোগের ঘনত্ব মাপা আর দক্ষতার উৎকর্ষ দেখানো ঠিক নয়। কিন্তু ‘মানুষ এটা খায় বেশি’ ধারণার বশবর্তী হয়ে এটাই আমরা বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াই, রউব দেখাই, গর্ব করি। কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও বা কম মানুষ মরলেও একটা দুর্যোগ যে দেশের মাজা ভেঙে দিতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ সাইক্লোন ‘আম্পান’।

হামুন তো সেই অর্থে কোনো সাইক্লোন নয়, তাতেই সন্ধ্যায় তিনজন মানুষ মারা গেলেন? ভাবতে হবে, রোল মডেলরা কোন রোলটা পালনে গাফিলতি করেছে? বনায়নের নামে ভুল জায়গায় ভুল গাছ লাগিয়ে মানুষের ঝুঁকি বাড়ানো হয়েছে, না অন্য কিছু। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত খবরে জানা যাচ্ছে, কক্সবাজার এলাকার হামুনজনিত ক্ষয়ক্ষতির পেছনে প্রধানত দায়ী ভুল জায়গায় ভুল গাছ লাগানো। সেই সব ভুল গাছ পড়েই বিদ্যুতের খুঁটির তার ছিঁড়ে গেছে। মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।

আগামী সাইক্লোনের আগে আমাদের করণীয়

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আত্মতুষ্টির কোনো স্থান নেই। প্রতিটি দুর্যোগে সাড়াদান প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছতার সঙ্গে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করে ভুলভ্রান্তিগুলো কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা করতে হবে। একটা সোজাসাপটা সাইক্লোন-পূর্বাভাস চালু করা এখন সময়ের দাবি। সাইক্লোন-পূর্বাভাসের বাক্যবিন্যাস এবং প্রচারের কাজে আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোকে আস্থায় নেওয়া দরকার।

সিলেটে বন্যা এবং কক্সবাজারে হামুন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মুঠোফোন আর ইন্টারনেট-নির্ভরতাজনিত সংকটের দিকটা তুলে ধরেছে। সতর্ক আর প্রস্তুতি বার্তায় এগুলো সম্পর্কে দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা আদর্শ দেশের আসন তখনই দাবি করতে পারব, যখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় গণমানুষের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা যাবে। মানুষ রাষ্ট্রকে রাষ্ট্রযন্ত্রের স্থানীয় ও জাতীয় চালকদের প্রশ্ন করতে পারবে নির্ভয়ে। বুঝতে পারবে নিজের আধিকার আর দায়িত্বের সীমারেখা।

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

  • [email protected]