শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ, অধ্যাপক ফার্গুসন ও চিলির উদাহরণ

প্রতীকী ছবিতে মডেল হয়েছে আহিল
ছবি: সুমন ইউসুফ

আপনি কি জানেন যে, মস্তিষ্কের বৃদ্ধির  শতকরা ৮০ ভাগ শিশুদের জীবনের প্রথম তিন বছরে ঘটে, যা তাদের  শিক্ষা এবং সারাজীবনের অর্জনের ভিত্তি তৈরি করে? সঠিক উদ্দীপনা দিয়ে এবং শিশু প্রতিপালনের যথাযথ পরিবেশ তৈরি করে মা-বাবা, পরিবারের সদস্য ও সমাজের সবাই শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগীয় ও সামাজিক বিকাশে সহায়তা করতে পারেন। 

নামকরা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রোনাল্ড ফার্গুসন শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশে নিরলস কাজ করছেন। তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাচিভমেন্ট গ্যাপ ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১১ সালে তাদের উদ্যোগে এক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। আলোচ্য সূচি ছিল জীবনের প্রথম কয়েক বছরে শিশুরা যে ধরনের যত্ন পায়, তা তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ এবং কিন্ডারগার্টেনের জন্য প্রস্তুতিতে কী ভূমিকা রাখে, তা বিশ্লেষণ করা। সম্মেলনে উপস্থাপিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে আর্থসামাজিক অবস্থাভেদে শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে পার্থক্য আছে; যা শুরু হচ্ছে তাদের বয়স দুই বছর হওয়ার আগেই। যেসব শিশু পরিবারে পর্যাপ্ত উদ্দীপনা পেয়েছে (যাদের মা-বাবা শিক্ষিত এবং ভালো উপার্জন করেন), তাদের বিকাশ যারা উদ্দীপনা পায়নি, তাদের চেয়ে বেশি। এই দ্বিতীয় দলের শিশুদের বাবা-মায়ের শিক্ষা এবং আয় তুলনামূলকভাবে কম।

অধ্যাপক ফার্গুসন বুঝতে পারেন, শিশুর জন্মের পর যদি তাদের বিকাশ না হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে নানা আর্থসামাজিক অবস্থার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অর্জনের পার্থক্য ঘোচানো যাবে না। এর প্রভাব পড়বে তাদের উপার্জনের ক্ষমতার ওপরও। তাই জীবনের শুরুতে যাতে সব শিশু সমানভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়, সেই উদ্দেশ্যেই তিনি বেসিক্স নামের একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। 

বেসিক্সের কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় পর্যায়ের একটা কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি পাঁচটি সহজ বার্তা তৈরি করে। তাদের মতে, মা-বাবা, অভিভাবকসহ সবাই যা করতে পারেন তা হলো, শিশুদের ভালোবাসা দেওয়া এবং নিজেদের মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা; শিশুদের সঙ্গে কথা বলা, গান গেয়ে শোনানো এবং কোনো কিছু তাদের দৃষ্টিগোচর করতে সেদিকে নির্দেশ করা; খেলাধুলার মাধ্যমে শিশুদের নানা বিষয়ে শিখতে উৎসাহিত করা; শিশুদের গুনতে শেখানো, তাদের সঙ্গে সংখ্যা, আকার-আকৃতি, নকশা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলা; শিশুদের গল্প পড়ে শোনানো এবং তা নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করা।

কীভাবে শিশুদের বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে, তা শেখার প্রয়োজন আছে। আমরা কেউ কেউ হয়তো অল্প বয়সী শিশুদের দামি খেলনা কিনে দিয়ে আত্মতৃপ্তি পাচ্ছি। কিন্তু গবেষণা বলছে, শিশুদের সময় দিয়ে উদ্দীপনা দিতে হবে। আমরা তা দিচ্ছি কি? নাকি শিশু মনোযোগ চাইলেও তাকে উপেক্ষা করে মুঠোফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকছি?

বেসিক্স মা-বাবা, অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ ইত্যাদির মাধ্যমে ওপরের এই বার্তাগুলো পৌঁছে দেয়। সচেতন করে তোলে শিক্ষক, ধর্মীয় নেতা থেকে শুরু করে নাপিত পর্যন্ত সব স্তরের মানুষকেও। এ ছাড়া মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে, বিলবোর্ডে প্রচারসহ নানাভাবে মা-বাবাকে শিশুর বিকাশ সম্পর্কে মনে করিয়ে দেওয়া হয়। বেসিক্স বিশ্বাস করে যে সমাজের সবাই সম্পৃক্ত হলেই শিশুদের যথাযথ বিকাশ নিশ্চিত করা যাবে।

বর্তমানে বেসিক্স যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে কাজ করছে। শিশুর বিকাশে করণীয় নিয়ে বড়দের দক্ষতা বাড়ায় তাঁরা শিশুদের জীবনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছেন।

বাংলাদেশে বেশির ভাগ মা-বাবা সন্তানদের পড়াশোনার সাফল্যকে খুব বেশি গুরুত্ব দেন। কিন্তু বেশির ভাগই জানেন না, বিদ্যালয়ে প্রবেশের আগে উদ্দীপনার অভাব একটি শিশুর শ্রেণিকক্ষের শেখাকে কমিয়ে দেয়। অল্প বয়সী সন্তানদের মা-বাবা সাধারণত শিশুদের খাবার, টিকার গুরুত্ব ইত্যাদি নিয়ে জানেন। এই পর্যায়ে মস্তিষ্কের বিকাশ কীভাবে দীর্ঘ মেয়াদে শিশুদের প্রভাবিত করে, এ বিষয়ে সমাজের বেশির ভাগ মানুষের সচেতনতার অভাব আছে।

বাংলাদেশে শিশুর প্রারম্ভিক যত্ন এবং বিকাশের সমন্বিত নীতি (২০১৩) আছে। কিন্তু বিষয়টি অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। এ ক্ষেত্রে কাজ করতে হলে শিশু, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজসেবা ইত্যাদি খাতের মধ্যে সমন্বয় দরকার এবং বিনিয়োগও প্রয়োজন। বাংলাদেশে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশে কাজ করছে, কিন্তু তা সীমিত আকারে। শিশুদের বিদ্যালয়ের প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে সরকার প্রাক্‌-প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করেছে। কিন্তু এ ধরনের বিদ্যালয়ের সংখ্যা এখনো খুবই কম এবং মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। তা ছাড়া পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা প্রাক্‌-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। সুতরাং, তিন বছরের কম বয়সী শিশুদের বিকাশের জন্য আলাদাভাবে কাজ করতে হবে। 

কীভাবে শিশুদের বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে, তা শেখার প্রয়োজন আছে। আমরা কেউ কেউ হয়তো অল্প বয়সী শিশুদের দামি খেলনা কিনে দিয়ে আত্মতৃপ্তি পাচ্ছি। কিন্তু গবেষণা বলছে, শিশুদের সময় দিয়ে উদ্দীপনা দিতে হবে। আমরা তা দিচ্ছি কি? নাকি শিশু মনোযোগ চাইলেও তাকে উপেক্ষা করে মুঠোফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকছি?

যেকোনো আর্থসামাজিক অবস্থানের মা-বাবা, পরিবারের সদস্য এবং শিশুর জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই ইচ্ছা করলেই শিশুদের বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারেন। গণমাধ্যম, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে।

চিলি ও উরুগুয়েতে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য শিশুযত্ন, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক কর্মসূচিগুলো একত্র করে সমন্বিতভাবে কাজ করা হচ্ছে। চিলিতে শিশুদের প্রারম্ভিক বিকাশের জন্য একটি আইন প্রণয়ন করেছে। এটি নিশ্চিত করেছে, সরকারের পরিবর্তন হলেও এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের কোনো হেরফের হবে না।

রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে অনেক কিছুই সম্ভব। এর সঙ্গে প্রয়োজন সমাজের সবার শিশু সংবেদনশীল হওয়া, শিশুদের বিকাশ নিয়ে জানা এবং শিশুদের সঠিকভাবে উদ্দীপনা দিয়ে তাদের বেড়ে ওঠায় নিজেদের দায়িত্ব পালন করা।

লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী