নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ বরাবরই আমার খুব প্রিয় একটি কবিতা। নিজের সম্পাদিত ধূমকেতু পত্রিকায় এই কবিতা ছাপার কারণেই কারাবরণ করতে হয়েছিল তাঁকে। সেই কবিতায় ‘মরার দেশের মড়া-শান্তি’র প্রতি তীব্র শ্লেষে ভরা আঘাত হেনেছিলেন কবি। বলেছিলেন, ‘হান তলোয়ার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র দেখা’। এই অমর হওয়ার মন্ত্র সবাই খুঁজে পান না। যে অল্প কিছু মানুষ তা খুঁজে পান, তাঁদের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ী আবু সাঈদ নিঃসন্দেহে একজন।
তিনি কি জানতেন, দেশের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দেওয়ার ডাক এসে গেছে তাঁর জন্য? না হলে কেন স্মরণ করলেন আরেক বীরকে, যিনি কালের সীমানা ছাড়িয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন, যুগ থেকে যুগান্তরে? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহাকে স্মরণ করে ২৪–এর গণ-অভ্যুত্থানের প্রতীক আবু সাঈদ লিখলেন:
‘স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার স্যার! আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিল সবাই তো মরে গেছে, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত।
‘প্রজন্মে যাঁরা আছেন, আপনারাও প্রকৃতির নিয়মে একসময় মারা যাবেন। কিন্তু যত দিন বেঁচে আছেন মেরুদণ্ড নিয়ে বাঁচুন। ন্যায্য দাবিকে সমর্থন জানান, রাস্তায় নামুন, শিক্ষার্থীদের ঢাল হয়ে দাঁড়ান। প্রকৃত সম্মান এবং শ্রদ্ধা পাবেন। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। আজন্ম বেঁচে থাকবেন শামসুজ্জোহা হয়ে।
‘অন্তত একজন “শামসুজ্জোহা” হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের।’
আজ এক বছর হলো আবু সাঈদ শহীদ হয়েছেন। সন্তানহারা মায়ের প্রশ্ন ‘হামার বেটাক মারলু কেনে?’—আজও দেশের দেয়ালে দেয়ালে। এ প্রশ্ন তো শুধু আবু সাঈদের মায়ের নয়, প্রতিটি শহীদ পরিবারের। এ প্রশ্নের উত্তর শহীদ পরিবারগুলোর কাছে এ জাতির ঋণ। কেন জীবন দিল এতগুলো তাজা প্রাণ? নিশ্চয় এক বছরের মাথায় ক্ষমতা আর কৃতিত্বের ভাগ নিয়ে টানাহেঁচড়া দেখার জন্য নয়!
গত বছরের ১৬ জুলাই দুই হাত ছড়িয়ে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লেন দেশের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের শিরা–উপশিরায়। ১৭ তারিখ পত্রিকায় তাঁর আত্মদানের খবর পড়েছি। কিন্তু সন্ধ্যা নাগাদ যখন তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোর ভিডিও সামনে চলে এল, তখন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একের পর এক গুলি চলছে, নির্ভীক দাঁড়িয়ে আছেন আবু সাঈদ, প্রতিরোধ, সাহস আর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে।
একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম যেন। আমি আর আমার স্ত্রী সাবন্তী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতাম না বললেই চলে। মুঠোফোনে ফেসবুকের অ্যাপ পর্যন্ত ছিল না। কিন্তু সেদিন আবু সাঈদকে বারবার দেখার তীব্র টানে অ্যাপ ডাউনলোড করলাম দুজনেই। ততক্ষণে প্রোফাইল ছবিগুলো বদলে যেতে শুরু করেছে। সবাই হয়ে উঠছেন একেকজন আবু সাঈদ। প্রসারিত বাহু, পেছনে অলক্ষ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন ‘চিরবিদ্রোহী বীর’ নজরুল, যেন আবু সাঈদের কণ্ঠে বলে উঠছেন ‘আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠয়াছি একা চির-উন্নত শির’।
আবু সাঈদের আত্মদান লাখো কোটি আবু সাঈদের জন্ম দিয়েছে এ দেশের ঘরে ঘরে। তাঁরা মৃত্যুর মুখে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়াতে জানেন। তাঁরা জানেন, কীভাবে ভয়ের টুঁটি চেপে ধরতে হয়। তাঁরা জানেন, আবু সাঈদদের মৃত্যু নেই। তাঁরাই এরপর প্রতিদিন রাস্তায় নেমে এসেছেন, কখনো মুগ্ধ, কখনো সৈকত, কখনো ফারহান, কখনো নাফিসা মারওয়া হয়ে।
আজ এক বছর হলো আবু সাঈদ শহীদ হয়েছেন। সন্তানহারা মায়ের প্রশ্ন ‘হামার বেটাক মারলু কেনে?’—আজও দেশের দেয়ালে দেয়ালে। এ প্রশ্ন তো শুধু আবু সাঈদের মায়ের নয়, প্রতিটি শহীদ পরিবারের। এ প্রশ্নের উত্তর শহীদ পরিবারগুলোর কাছে এ জাতির ঋণ। কেন জীবন দিল এতগুলো তাজা প্রাণ? নিশ্চয় এক বছরের মাথায় ক্ষমতা আর কৃতিত্বের ভাগ নিয়ে টানাহেঁচড়া দেখার জন্য নয়!
দেশ পুনর্গঠনের বিরল সুযোগ নিয়ে এসেছিল জুলাই, জীবন দিয়ে এ সুযোগ তৈরি করেছিলেন আবু সাঈদরা। সেই অপার সম্ভাবনার কিছুটা হলেও বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু তা করতে হলে বারবার মনে করতে হবে আবু সাঈদের কথা, জুলাইয়ের সহস্রাধিক শহীদের কথা। তবে একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, এ দেশের প্রতিটি মানুষ জানেন, কীভাবে আবু সাঈদ হয়ে উঠতে হয়, কীভাবে শামসুজ্জোহা হয়ে উঠতে হয়। চালকের আসনে বসে বেপথু হলে তাঁরা ঠিক উঠে আসেন বিস্মৃতির ওপার থেকে, দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়ান দেশকে নতুন জীবন দিতে।
মানজুর-আল-মতিন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী