গত বছর শফিকুল যখন সৌদি আরবের বিমানে ওঠেন, সঙ্গে ছিল মাত্র দুটি জিনিস—কিছু কাপড়ভর্তি একটি ছোট ব্যাগ এবং তাঁর পরিবারের কল্পনার বাইরে এক বিশাল ঋণ। একটি সাধারণ নির্মাণকাজের চাকরি নিশ্চিত করতে তাঁকে প্রায় পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় পাঁচ লাখ টাকার বেশি ধার নিতে হয়। গ্রামে দালালদের দাবিকৃত মূল্যই ছিল এই ঋণের কারণ।
শফিকুলের পরিকল্পনাটা ছিল সোজাসাপটা—কঠোর পরিশ্রম করবেন, দেশে টাকা পাঠাবেন আর দ্রুত ঋণ শোধ করবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা—যা স্বল্প দক্ষ অভিবাসী শ্রমিকদের গড় মজুরির কাছাকাছি—শফিকুল তাঁর প্রথম বছরের প্রায় পুরোটাই ঋণ শোধ করতে খরচ করে ফেলেন। তাঁর অভিবাসনযাত্রা তাঁকে এগিয়ে নেয়নি; কেবল শূন্যের কাছাকাছি ফিরিয়ে এনেছে। শফিকুলের গল্প ব্যতিক্রম নয়—এটাই বাস্তবতা।
শ্রম অভিবাসন এখনো বাংলাদেশের কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির অন্যতম শক্তিশালী চালিকা শক্তি। উপসাগরীয় দেশগুলো, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলে ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মী কাজ করছেন। ২০২৪ সালে তাঁরা দেশে পাঠিয়েছেন আনুমানিক ২৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার—জাতীয় জিডিপির প্রায় ৬ শতাংশ।
কিন্তু এই সাফল্যের আড়ালে আছে এক উদ্বেগজনক বাস্তবতা। বাংলাদেশি কর্মীরা বিশ্বে সর্বোচ্চ নিয়োগ ব্যয়ের অন্যতম বোঝা বহন করেন। শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪ অনুযায়ী, অভিবাসনের গড় ব্যয় ৩ হাজার ৫০০ ডলারের বেশি (৪ লাখ ৬২ হাজার টাকা), যা আয় করতে প্রয়োজন প্রায় ১০ মাসের কঠোর পরিশ্রম।
এই ভারী ঋণ শ্রমিকদের কম মজুরি, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ ও অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা মেনে নিতে বাধ্য করে; দর-কষাকষি বা অভিযোগ জানানোর সক্ষমতাও সীমিত করে। দেশে থাকা পরিবারগুলো পড়ে আর্থিক চাপে। অনেক প্রত্যাবর্তনকারী সঞ্চয়হীন অবস্থায় আবারও ঝুঁকিপূর্ণ পথে অভিবাসনে যেতে বাধ্য হন—ফলে তৈরি হয় ঋণনির্ভর অভিবাসনের এক দুষ্টচক্র।
অতিরিক্ত নিয়োগ ফি শুধু শ্রমিকদের জন্য শোষণমূলক নয়; এটি বাংলাদেশের শ্রমবাজার প্রতিযোগিতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। জিসিসি দেশগুলো ও মালয়েশিয়ায় একই কাজের জন্য বাংলাদেশি শ্রমিকেরা ভারতীয় বা নেপালি শ্রমিকদের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি খরচ দেন। এই বৈষম্য বিদেশি নিয়োগকর্তা ও সরকারের কাছে সুপরিচিত এবং এতে উৎসদেশ হিসেবে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়।
অতিরিক্ত নিয়োগ ফি শুধু শ্রমিকদের জন্য শোষণমূলক নয়; এটি বাংলাদেশের শ্রমবাজার প্রতিযোগিতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। জিসিসি দেশগুলো ও মালয়েশিয়ায় একই কাজের জন্য বাংলাদেশি শ্রমিকেরা ভারতীয় বা নেপালি শ্রমিকদের তুলনায় দুই থেকে তিন গুণ বেশি খরচ দেন। এই বৈষম্য বিদেশি নিয়োগকর্তা ও সরকারের কাছে সুপরিচিত এবং এতে উৎসদেশ হিসেবে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়।
ফলে শ্রমিকেরা দ্রুত আয় করার চাপে পড়েন, যার পরিণতিতে বিরোধ, ঘন ঘন নিয়োগকর্তা বদল, মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থান ও অনিয়মিত কাজের প্রবণতা বাড়ে।
এসব কোনো ব্যক্তিগত পছন্দ নয়; এগুলো ঋণের পরিণতি।
একই সময়ে বৈশ্বিক প্রত্যাশাও বদলাচ্ছে। বড় বাজারগুলোয় মানবাধিকার ও ডিউ ডিলিজেন্স আইন কঠোর হওয়ায়, কোম্পানিগুলো এখন শুধু কর্মপরিবেশ নয়, ন্যায্য নিয়োগপ্রক্রিয়ার প্রতিও জবাবদিহির মুখোমুখি। অতিরিক্ত ফি ফেরত দেওয়া ব্যয়বহুল ও টেকসই নয়—ফলে নিয়োগকর্তারা স্বচ্ছ ও নিয়ন্ত্রিত নিয়োগব্যবস্থা থাকা দেশগুলো থেকে শ্রমিক নিতে আগ্রহী হচ্ছেন।
উচ্চ নিয়োগ ব্যয় কেবল শ্রমবাজারে চাহিদা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না; বড় আকারের বেকার বা অর্ধবেকার জনগোষ্ঠী থাকা অনেক দেশেই এমন ব্যয় নেই। নজরদারি দুর্বল হলে, অনৈতিক চর্চা নিয়ন্ত্রণহীন থাকলে, মধ্যস্থতাকারীরা জবাবদিহিহীনভাবে কাজ করলে এবং অভিবাসন করিডরজুড়ে আইন প্রয়োগ ব্যর্থ হলে তখনই ফি বাড়ে।
শ্রম সংস্কার কমিশন যথার্থভাবেই নিয়োগ ফি-কে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ডিজিটাল যাচাই ও শক্তিশালী কল্যাণ সহায়তার মতো পদক্ষেপগুলোকে আমরা স্বাগত জানাই; তবে এর সঙ্গে আরও সাহসী উদ্যোগ প্রয়োজন—নিয়োগকারীদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ, কার্যকর অভিযোগ ব্যবস্থাপনা এবং অতিরিক্ত ফির জন্য স্পষ্ট দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা।
বিদেশে কর্মসংস্থান বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের সংকট লাঘবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই শ্রমিকদের দক্ষতায় বিনিয়োগের পাশাপাশি নিয়োগ ব্যয় কমানোকে জাতীয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। অভিবাসনের শুরু ঋণ ও হতাশা দিয়ে হওয়া উচিত নয়। শ্রমিকের মর্যাদা রক্ষা এবং ভবিষ্যৎ শ্রমবাজারের সুযোগ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে নিরাপদ ও টেকসই অভিবাসনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা অভিবাসনের ব্যয়—এর মুখোমুখি হতে হবে।
● ম্যাক্স টুনন কান্ট্রি ডিরেক্টর, আইএলও বাংলাদেশ অফিস
● ল্যান্স বোনো চিফ অব মিশন, আইওএম বাংলাদেশ