বিএনপি ৪৭ বছরে পা দিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম করা দলটি এখন এক নতুন যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ১৫ বছরের কঠিন সংগ্রামের পর শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক এবং মাফিয়াবাদী শাসনতন্ত্র উৎখাতের মধ্যে দলটি এবং দলের নেতাকর্মীরা অনেক দিন পর একটু স্বস্তির জায়গায় পৌঁছেছে। আসন্ন নির্বাচনে জিতলে আবারও দলটির নতুনভাবে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব (যার সুযোগ নিতে আমরা এত দিন চরমভাবে ব্যর্থ), আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নতুন যুগ, দেশের পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য যেই ক্ষমতায় আসুক, তাকে দায়িত্ব নিতেই হবে। আর সাম্প্রতিক জনমত জরিপেও মানুষ এখন পর্যন্ত মনে করছে—বিএনপিই ক্ষমতায় আসবে।
১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দলটি আমাদের দিয়েছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। আমরা এখন জোর গলায় বলতে পারি, আমরা বাংলাদেশপন্থী মানুষ। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমাদের দেশে শুধু বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দলগুলোই আছে, যার শুরুটা বিএনপির হাত দিয়েই। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সংসদীয় গণতন্ত্রে ফেরত যাওয়ার মতো পুরো ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন হয়েছিল বিএনপির হাত দিয়েই। আসলে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তন বা সংস্কারগুলো এখন পর্যন্ত বিএনপির হাত দিয়েই হয়েছে।
বাকশালের পর বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফেরত এনেছিল বিএনপিই। এরপর এনেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। অনেক নতুন জিনিস এসেছিল বিএনপির হাত দিয়েই। যেমন ভ্যাট ব্যবস্থা প্রবর্তন। বাংলাদেশের আয় এক ধাক্কায় বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এই আইন।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যখন দেশের সবার চাহিদা মেটাতে পারছিল না, ১৯৯৪ সালে দেওয়া হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি। খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা বা মেয়েদের মাধ্যমিকে বৃত্তি এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনেছে। নিজেদের মেয়র দেওয়ার সুবিধা থাকা সত্ত্বেও দলটি ১৯৯৪ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে মেয়র নিয়োগের আইন করে। ২০০৪ সালের সাফটা চুক্তি বাস্তবায়ন হলে পুরো সাফই এখন অন্য রকম থাকত। যে নারী ফুটবল নিয়ে এত কথা, তারও শুরু বিএনপির আমলে।
বাংলাদেশ তার রাজনীতিতে এখনো একজন জিয়াউর রহমানকে খুঁজে বেড়ায়। স্বাধীনতার ঘোষণার মাধ্যমে নিজের মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষণা করা, যুদ্ধে আহত হওয়া—বাংলাদেশের একমাত্র সেনা অফিসার, যিনি দুই দেশের জীবিতদের মধ্যে একমাত্র সর্বোচ্চ খেতাবধারী ছিলেন।
খাল খনন এবং আধুনিক কৃষিব্যবস্থা প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের আমদানি তিন ভাগের দুই ভাগ কমিয়ে এনেছিলেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কথাও তাঁর মাথা থেকে আসে, যা এখন চরমভাবে ব্যর্থ। গার্মেন্টস দিয়ে দেশের পুরো অর্থনীতির মোড় ঘোরানোর শুরু তাঁর হাতে। আবার ছিলেন সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম জিয়ার চরিত্রহননের বহু গল্প বানালেও তাঁর সততাকে কখনোই প্রশ্ন করতে পারেনি।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর একজন গৃহিণী বেগম খালেদা জিয়া দায়িত্ব নেন। সেই খালেদা জিয়াই এখন বাংলাদেশের ঐক্যের প্রতীক। তাঁর আপসহীন এবং হার না মানা চিন্তাভাবনা থেকে দেশের মানুষের অনেক কিছু শেখার আছে। তাঁর শাসনামলের প্রধান লক্ষ্যই ছিল দেশকে শিক্ষা এবং অর্থনীতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা।
আওয়ামী লীগ যে এত উন্নয়ন বাজেটের টাকা পেয়েছিল, তা ছিল ২০০৪–এর এনবিআর সংস্কারের ফল। সেই সময় ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৫, যা এখন শুধু স্বপ্নই মনে হয়। ভারতের রুপির সঙ্গে টাকার মূল্যমানও তখন প্রায় সমান হয়ে গিয়েছিল।
অসুস্থ খালেদা জিয়ার পর দলের হাল এখন তারেক রহমানের হাতে। তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য দলকে এত অত্যাচারের মধ্যেও এক রাখতে পারা এবং দলকে একটা উদারপন্থী গণতান্ত্রিক দল হিসেবে টিকিয়ে রাখা। ৩১ দফা ঘোষণার মাধ্যমে দেশের সংস্কার যে প্রয়োজন তা আসলে বিএনপিরই ঘোষণা।
বিএনপির দল হিসেবে সাফল্যের খতিয়ান দিতে গেলে বড় বই লেখা যাবে। কিন্তু সমালোচনাও কি নাই? অবশ্যই আছে। বাংলাদেশের কোনো দলেরই সমালোচনার বাইরে থাকা সম্ভব না। যেমন মাগুরা ইলেকশন বা ২০০8–এ বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো, জামায়াত থেকে মন্ত্রী করা।
তারেক রহমানের নামে যে দুর্নীতির অভিযোগ সেটা রাজনৈতিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং শেখ হাসিনার সরকার— কেউই তাঁর দুর্নীতির অভিযোগ আইনগতভাবে প্রমাণ করতে পারে নাই। যদি প্রমাণই না হয়, আদালতে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকারও তারেক রহমানের আছে। কারণ, তাঁর মতো শারীরিক নির্যাতনও এ দেশে খুব কম রাজনীতিকই সহ্য করেছেন।
বর্তমানে তারেক রহমানের দেশে আসা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। অনেকে নিরাপত্তার কথা বলেন, কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের কি ভয় পেলে চলবে? যিনি দেশকে নেতৃত্ব দেবেন? তাঁর বাবা তো সবার মাঝখান দিয়ে চলতেন। তখন নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও খারাপ ছিল।
বিএনপির সবচেয়ে বড় দুই সমস্যার একটি লাগামছাড়া তৃণমূল। প্রতিটি আসনে দুইয়ের অধিক প্রার্থী। নিজেদের দলাদলিতে ভুক্তভোগী হচ্ছে মানুষ। তারা তিন হাজারের বেশি বহিষ্কার করেছে, তা–ও পারছে না। মানুষ ভাবছে এটা একমাত্র সম্ভব তারেক রহমান দেশে এসে দলের দায়িত্ব নিলে। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ কি সরকারের দায়িত্ব না? তিন হাজার বহিষ্কারের মধ্যে কতজন গ্রেপ্তার হয়েছে, আমি চেষ্টা করেও খুঁজে পেলাম না।
এবং দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, কিছু জ্যেষ্ঠ নেতৃত্বের বেফাঁস কথা। হ্যাঁ! বয়স হয়ে গেলে অনেকেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু তাঁদেরও বুঝতে হবে তাঁদের একটা বেফাঁস কথা বিএনপিকে কোথায় থামিয়ে দেয়—তা যাঁরা জনমত জরিপ করেন, সহজেই টের পান। এই জেনারেশন সব ধরার জন্য বসে থাকে। পার পাওয়া যাবে না। ফজলুর রহমানের স্থগিতাদেশ অনেকেই সতর্ক করবে আশা করি।
বিএনপি ১৯৯৬, ২০০৬ কোনোবারই স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেনি। শুধু তা–ই নয়, ২০০৬–এর ভুলের জন্য দলের নেতাকর্মীকে এবং পুরো দেশকে মাত্রাতিরিক্ত ও চূড়ান্ত রকম দাম দিতে হয়েছে। যদি সম্ভাব্য আগামী প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান পাঁচ বছর গণতান্ত্রিকভাবে দেশ শাসন করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আবার নির্বাচনী প্রচারে নামতে পারেন, এটা হবে তাঁর এবং তাঁর সরকারের একটা অনন্য সফলতা।
আরেকটা ক্ষতি হতে পারে, উচ্চ আত্মবিশ্বাস। যার ফলে অনেকেই ধরাকে সরা জ্ঞান করে, অনেকে ভোটারদের বিরক্তের কারণ হচ্ছে।
এই সমস্যাগুলো কিন্তু বিএনপি দল হিসেবেই কিছুটা সমাধান করতে পারত। তাদের যদি একটা রেজিস্টার্ড মেম্বার লিস্ট থাকত এবং যা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা থাকত, বাইরের থেকে কেউ এসে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করে যেতে পারত না। এদিকে দলে অনেক দিন কাউন্সিল না হওয়ায় নেতাদের মধ্যে মানুষের কাছে জবাবদিহির কালচারটাও হারিয়ে গেছে। জিয়াউর রহমানের সময়ে দলের ভেতরের গণতন্ত্র অনেক বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। দলে তরুণ নেতৃত্ব আনতে হবে, করতে হবে পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে মূল্যায়ন। ডাকসুতে যেমন চমৎকার একটা প্যানেল হয়েছে, এ রকম প্রার্থী হতে হবে দেশজুড়েই।
বিএনপি ১৯৯৬, ২০০৬ কোনোবারই স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেনি। শুধু তা–ই নয়, ২০০৬–এর ভুলের জন্য দলের নেতাকর্মীকে এবং পুরো দেশকে মাত্রাতিরিক্ত ও চূড়ান্ত রকম দাম দিতে হয়েছে। যদি সম্ভাব্য আগামী প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান পাঁচ বছর গণতান্ত্রিকভাবে দেশ শাসন করে নিয়মতান্ত্রিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে আবার নির্বাচনী প্রচারে নামতে পারেন, এটা হবে তাঁর এবং তাঁর সরকারের একটা অনন্য সফলতা।
আরেকটা কথা না বললেই নয়। বিএনপি বারবার মানুষ চিনতে ভুল করেছে। বিএনপি এরশাদ, নাসিম ও মইনের মতো উচ্চাভিলাষীদের সেনাপ্রধান বানিয়েছে। জেনারেল মাসুদউদ্দিন, জেনারেল মতিনসহ অনেককেই দিয়েছিল সুযোগ। এখনই সময় মানুষ চিনতে সতর্ক হওয়া। শেখ হাসিনা পালানোর পর এখন অনেক সুবিধাভোগী তাদের পাশে ঘুরঘুর করছে। এদের যদি চিনতে না পারে, শুধু বিএনপি না, দেশও পস্তাবে।
বিএনপিকে জনমানুষের সঙ্গে যতটুকু সম্ভব নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে। রাজনৈতিক দল মানেই গণমানুষের, তাই সবাই যাতে যোগাযোগ করতে পারে, একটা হেল্প সেন্টার, সঙ্গে ই–মেইল অ্যাকসেস থাকতে হবে। সেই অনুযায়ী নিতে হবে ব্যবস্থা। আমরা এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকেও মেইল করতে পারি, সেখানে নিজের দেশে থেকে কেন যোগাযোগ করতে পারব না? সামনের তফসিলে আমরা আমাদের ভাষায় সুনির্দিষ্ট ইশতেহার দেখতে চাই। কথা দিয়ে কথা রাখার সংস্কৃতি এখন সারা বাংলাদেশের প্রত্যাশা।
বাংলাদেশের ভালো থাকা আসলে কীভাবে জানি বিএনপির সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে। তাই আমাদের ভালোর জন্যই বিএনপির ভালো করতে হবে, ভালো থাকতে হবে এখন। খেয়াল করে দেখেন বিএনপির সফলতার লিস্টে কোনো উন্নয়নকাজ নাই, বরং সব কাজই সংস্কারমূলক। এবারও বিএনপি প্রায় সব বড় সংস্কারসহ ৯৪ শতাংশ প্রস্তাব পুরোপুরি বা আংশিক মেনে নিয়েছে। একটাই বড় সংস্কারে দ্বিমত আছে—আনুপাতিক উচ্চকক্ষ, কে জানে এখন পর্যন্ত একমাত্র প্রমাণিত সংস্কারক দল বিএনপির হাত ধরেই হয়তো আনুপাতিক উচ্চকক্ষ আসবে, কিন্তু কারও প্রেশারে নয়। দলের গঠনতন্ত্র সংস্কারসহ গণতন্ত্রে ফিরে আসাসহ আমরা হয়তো আগামী ৪৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আগেই অনেক নতুন কিছু দেখতে পাব।
সুবাইল বিন আলম প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
এহতেশামুল হক ইউএস অ্যাটর্নি
*মতামত লেখকদের নিজস্ব