জাতিসংঘের ব্যয় কমানোতে বাংলাদেশে মানবিক সহায়তা কি হুমকির মুখে

কক্সবাজারের টেকনাফে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরফাইল ছবি

বদলে যাওয়া বিশ্বের চাহিদা মেটাতে ২০১৭ সালে জাতিসংঘ চালু করে ‘ইউএন ২.০’ নামে আধুনিকায়ন উদ্যোগ। এই মডেলের মূল লক্ষ্য জাতিসংঘকে সময়োপযোগী, আধুনিক ও গতিশীল একটি প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে তোলা। এতে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত, প্রযুক্তি, উদ্ভাবন, পূর্বপরিকল্পনা ও আচরণগত বিশ্লেষণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। জাতিসংঘকে আরও বেশি সক্রিয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা এই পরিবর্তনের মূল লক্ষ্য।

বিগত দিনের বৈশ্বিক অনিশ্চয়তায় জাতিসংঘ ক্রমান্বয়ে অর্থসংকটে পড়েছে। তাই জাতিসংঘের ব্যয় সংকোচন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। এদিকে বিগত বছরগুলোতে জাতিসংঘের কাজের পরিধি ক্রমেই বেড়েছে। সংস্থাটি বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ৪০০০ স্থানে সক্রিয়। এসব কাজে বিশ্বের ১৬২টি দেশের ১ লাখের বেশি বেসামরিক লোক কাজ করছেন। জাতিসংঘের কর্মসূচি বিশ্বের ১৬০ মিলিয়নের বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। টেকসই লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজিএস) অর্জনের দ্বিতীয় ধাপে এই সংস্থা আরও কার্যকর ভূমিকা রাখার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘকে আরও বেশি কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার উদ্দেশ্যে এবং আধুনিক ‘ইউএন ২.০’ প্রতিষ্ঠার সহযোগী পদক্ষেপ হিসেবে জাতিসংঘের ৮০ বছরে ‘ইউএন ৮০’ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

১২ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘অনেক সদস্যরাষ্ট্র চাঁদা সময়মতো বা পূর্ণপরিমাণে পরিশোধ না করার ফলে টানা সাত বছর ধরে জাতিসংঘ অর্থসংকটে ভুগছে। এই প্রেক্ষাপটে ইউএন ৮০ হবে একটি সমন্বিত আত্মবিশ্লেষণধর্মী পর্যালোচনা।’ এর জন্য জাতিসংঘের নীতিমালাবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল গাই রাইডারের নেতৃত্বে একটি অভ্যন্তরীণ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এই টাস্কফোর্স জাতিসংঘ ব্যবস্থার দক্ষতা ও ব্যয়সংক্রান্ত সংস্কার প্রস্তাব তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে।

২৬ মার্চ ‘ভবিষ্যতের জন্য অঙ্গীকার’ বাস্তবায়ন নিয়ে এক সংলাপে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জানান, ‘ইউএন ৮০’ উদ্যোগের আওতায় জাতিসংঘের কার্যকারিতা ও কাঠামোগত সংস্কার পর্যালোচনা চলছে। এতে ম্যান্ডেট বাস্তবায়ন, কর্মসূচির পুনর্গঠন এবং ব্যয় হ্রাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত।

আন্তোনিও গুতেরেস আরও বলেন, ম্যান্ডেটের শুরু থেকেই জাতিসংঘে কার্যক্রমের ধরন ও সেবাদান প্রক্রিয়া আরও দক্ষ ও খরচ-সাশ্রয়ী করতে একটি উচ্চাকাক্ষী সংস্কার এজেন্ডা নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় প্রক্রিয়া সহজ করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিকেন্দ্রীকরণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি এবং ডেটা ও ডিজিটাল খাতে সক্ষমতা স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, ‘প্যাক্ট ফর দ্য ফিউচার’ ও ‘ইউএন ২.০’—এর মূল লক্ষ্যই হচ্ছে একুশ শতকের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘকে আধুনিক ও উপযোগী করে তোলা।

এই সংকটের ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বাংলাদেশে তাদের জরুরি সহায়তার কাজে অর্থের একটি সংকটজনক ঘাটতির ব্যাপারে সতর্ক করছে, যা এক মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর খাদ্যসহায়তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

জরুরি নতুন অর্থ সহায়তা ছাড়া, প্রতি ব্যক্তির মাসিক রেশন ১২ দশমিক ৫০ মার্কিন ডলার থেকে অর্ধেকে, অর্থাৎ ৬ মার্কিন ডলারে নামিয়ে আনতে হবে। সব রোহিঙ্গা নির্ধারিত খুচরা বিক্রেতার দোকানে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী খাদ্য কেনার জন্য ভাউচার পান। পূর্ণ রেশন বজায় রাখতে এপ্রিলের জন্য ডব্লিউএফপির জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন ১ দশমিক ৫ কোটি মার্কিন ডলার এবং ২০২৫ সালের শেষ পর্যন্ত প্রয়োজন ৮ দশমিক ১ কোটি মার্কিন ডলার।

‘রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট এখনো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী সংকট’, বলেন বাংলাদেশে ডব্লিউএফপির কান্ট্রি ডিরেক্টর ডমেনিকো স্কালপেল্লি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য সম্পূর্ণভাবে মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। খাদ্যসহায়তা হ্রাস তাদের আরও গভীর খাদ্যসংকটে ফেলবে এবং কেবল টিকে থাকার জন্য তাদের চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করবে।

বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের কার্যালয় শরণার্থী ক্যাম্পগুলো তদারকি করে। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই, যাতে তারা প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিয়ে এগিয়ে আসে, যাতে এই জীবনরক্ষাকারী কর্মসূচিগুলো টিকিয়ে রাখা যায়।’

অন্য এক বিবৃতিতে ইউনিসেফ জানিয়েছে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে পুষ্টি চিকিৎসার জন্য ভর্তি হওয়া শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অতি তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুর সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেড়েছে। চলতি বছর এই সংখ্যা ১৪ হাজার ২০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।

জীবনরক্ষাকারী পুষ্টি চিকিৎসার চাহিদা যেখানে বাড়ছে, সেখানে মানবিক সহায়তার জন্য বরাদ্দ কমছে। এতে শিশুদের জীবন আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে। খাদ্যসংকট, নিম্নমানের খাবার, নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতির পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

‘আপাতত রোহিঙ্গা মায়েরা এসে যেসব সেবা চাইছেন এবং অত্যন্ত অসুস্থ শিশুদের যেসব চাহিদা, সেগুলো আমরা পূরণ করতে পারছি। কিন্তু যেহেতু চাহিদা বাড়ছে এবং তহবিল কমছে, সে কারণে পরিবারগুলো এসে আমাদেরকে বলছে যে যদি তাদের খাবারের বরাদ্দ আরও কমানো হয় এবং জীবন রক্ষাকারী পুষ্টি চিকিৎসার সেবাগুলো বন্ধ হয়ে যায় তাহলে কী হবে, তা নিয়ে তারা আতঙ্কিত’, বলেছেন বাংলাদেশে ইউনিসেফের কান্ট্রি ডিরেক্টর রানা ফ্লাওয়ার্স।

২০২৫ সালের ২৮ মার্চ এক ব্রিফিং নোটে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে স্বাস্থ্যসেবা খাতে তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ গুরুতর সংকটে পড়েছেন। চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হওয়ায় হাজারও মানুষের জীবন এখন হুমকির মুখে।

ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, সংস্থার সহায়তায় পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ৪০ হাজারের বেশি গর্ভবতী নারী গর্ভকালীন সেবা পাওয়ার সুযোগ হারাতে পারেন। এর মধ্যে পাঁচ হাজার নারী ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে সন্তান প্রসবের শঙ্কায় আছেন। তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা প্রায় ১৯ হাজার শিশুর জন্য জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। একইভাবে গুরুতর অসুস্থ ১০ হাজার শরণার্থী মাধ্যমিক ও বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। ১০ হাজার রোগী হেপাটাইটিস সি চিকিৎসাও আর পাবেন না। ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, এখনই জরুরি অর্থ সহায়তা না এলে শরণার্থীশিবিরগুলোর চিকিৎসাব্যবস্থা ভেঙে পড়বে আর এতে হাজারও মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে।

এই তথ্যগুলো থেকে স্পষ্ট যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সদস্যরাষ্ট্রগুলোর আর্থিক দায়বদ্ধতার অভাবে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো তাদের নীতিগত ও মানবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চরম সংকটে পড়েছে। ‘ইউএন ২.০’ ও ‘ইউএন ৮০’ উদ্যোগের মাধ্যমে কাঠামোগত সংস্কার ও দক্ষতা বৃদ্ধির যে প্রচেষ্টা চলছে, তা প্রশংসনীয়। তবে বাস্তবতা হলো যখন জরুরি খাদ্য, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা থমকে যায়, তখন জীবন বাঁচানোই হয়ে ওঠে প্রধান চ্যালেঞ্জ। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট আন্তর্জাতিক সহানুভূতির বাইরে চলে গেলে শুধু একটি জনগোষ্ঠী নয়, সমগ্র মানবতা হুমকির মুখে পড়বে।

  • মাহমুদুল করিম গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যমকর্মী