সব যুদ্ধ যেভাবে শেষ হয়, তেমন করেই গাজা যুদ্ধ একদিন শেষ হবে। কিন্তু এর অভিঘাত ও পরিণতি হবে অনন্য, সেটা এই যুদ্ধের ধরন ও গভীরতা—দুই বিবেচনাতেই।
যুদ্ধবিরতি (১৫ মাস পর যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে) আসন্ন হোক অথবা আরও দীর্ঘদিন যুদ্ধ প্রলম্বিত হোক—যা–ই হোক না কেন, উপসংহারের রূপরেখাটা কেমন হবে, সেটা এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। পরের চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
গাজার বেশির ভাগ এলাকা এমনভাবে ধ্বংস হয়েছে যে সেটা আর বসবাসের উপযোগী নেই। হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে অগুনতি মানুষ।
গাজার বাসিন্দাদের তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িঘরের ঘটনাটি হজম করে যেতে হবে। শীত আর ক্ষুধা মোকাবিলা করতে হবে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে তুলবে, তবে এটি সংঘর্ষের সামগ্রিক গতিপথকে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করবে না।
রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করলে এই যুদ্ধের তাৎক্ষণিক ফলাফল হলো, হামাসকে সামরিকভাবে দুর্বল করতে পারল ইসরায়েল। হামাসও তাদের কৌশল পাল্টাতে বাধ্য হবে। শেষ বিচারে গাজায় নিয়ন্ত্রণ হারাতে হতে পারে হামাসের। সংগঠন পুনর্গঠন করতে তাদের আরও অনেক বছর লেগে যাবে। কিন্তু এটিই পুরো গল্প নয়। গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পটভূমির কেন্দ্রীয় চালক হিসেবে ইসরায়েল ফিলিস্তিন ইস্যুটিকে মুছে ফেলতে পারবে না।
এই যুদ্ধ অনস্বীকার্যভাবে আবার নিশ্চিত করল যে ফিলিস্তিন ইস্যুটি নিরাপত্তার অথবা আরব–ইসরায়েল সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের মাপকাঠি দিয়ে উপেক্ষা করা যাবে না। ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত একদা বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিরা তাদের রাষ্ট্রীয় অধিকার অর্জন না করা পর্যন্ত কোনো নিরাপত্তা অথবা শান্তি আসতে পারে না। এই সমীকরণ আজও সমানভাবে বিরজ করে।
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের পাশাপাশি গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করার জন্য এক বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জনে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
হাসপাতাল, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, বাড়িঘর, পানি সরবরাহব্যবস্থা, চিকিৎসাকর্মী, সংবাদিক—ফিলিস্তিনিদের জীবনযাপনের প্রতিটি জায়গায় যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা তাদের মাটি আঁকড়ে রয়ে গেছে। এটা ইসরায়েলের জন্য মতাদর্শিক, কৌশলগত ও নৈতিক ব্যর্থতা। দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় ও জাতিবাদী জায়নবাদীদের গাজাকে ‘জনশূন্য’ করার প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে।
ফিলিস্তিনিদের গাজা থেকে উৎখাত করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার মানে হচ্ছে, ইসরায়েলকে অবশ্যই এখন ফিলিস্তিনি বাস্তবতাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
যুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিনিদেরও তাদের নিজস্ব উপসংহার টানতে হবে। তারা দেখেছে, আলাপ–আলোচনা কতটা ফলহীন হতে পারে। একদিকে আলোচনা চলেছে আর অন্যদিকে ইসরায়েলিরা তাদের ভূমি চুরি করে বসতি বাড়িয়ে গেছে। আবার একই সঙ্গে ফিলিস্তিনিরা দেখেছে, বেপরোয়া ধরনের প্রতিরোধ কেমন করে একটা গণহত্যামূলক যুদ্ধের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।
এ বাস্তবতা অনেক ফিলিস্তিনিকে বিকল্প একটা প্রতিরোধের উপায় খুঁজে বের করতে বাধ্য করছে। ইতিহাস বলছে, যখন সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে, তখনো ফিলিস্তিনিরা নতুন পথ খুঁজে বের করেছে।
দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ১৯৮২ সালে লেবানন থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর তারা সংগ্রামের একটি অভূতপূর্ব রূপ হিসেবে ইন্তিফাদাকে সামনে এনেছিল। সব দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন আবার ফিলিস্তিনিরা নতুন পথ উদ্ভাবন করছে। ‘ইতিবাচক দৃঢ়তার’ নামে এটি বিকশিত হচ্ছে। এখানে ফিলিস্তিনিদের সংকল্প আর জন্মভূমিতে তাদের অস্তিত্বের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বড় পরিসরকে ধারণ করে এবং প্রতিরোধের অনেকগুলো হাতিয়ারকে একসঙ্গে ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি করে। একই সঙ্গে ফিলিস্তিনি জনগণের সব শক্তিকে একত্র করার ক্ষমতা ধারণ করে। ধ্বংসাত্মক সংঘাত আর অন্তহীন সংলাপের অসাড়তার বিরুদ্ধে এই মডেল কার্যকর হতে পারে। এই মডেল এখনো পরিপূর্ণ রূপ না পেলেও, ফিলিস্তিনিরা এর সম্ভাবনাকে অন্বেষণ করার আহ্বান জানিয়েছে।
যুদ্ধ শেষ হলে ইসরায়েল হয়তো বিজয়ীর চেহারা নিয়ে হাজির হতে চাইবে; কিন্তু কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে ইসরায়েল বিজয়ী হবে না।
আউনি আলমাশনি ফাতাহ আন্দোলনের পরামর্শক পরিষদের সদস্য
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত