এত খরচ করে ছেলেমেয়েরা বিজ্ঞানে পড়বে কীভাবে

সুমাইয়া খাতুন (ছদ্মনাম)। একাদশে বিজ্ঞানের ছাত্রী। খুলনা বিভাগের একটি সরকারি কলেজে পড়ছে। ঢাকার বাইরে মাধ্যমিকে ভালো ফল যারা করে, সেসব শিক্ষার্থীর জন্য জেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজগুলো এখনো ভরসার জায়গা। ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর গত বছরের আগস্ট মাসে সুমাইয়ার ক্লাস শুরু হয়েছে। কিন্তু এই সাড়ে চার মাসে ক্লাস করেছে হাতে গোনা কয়েক দিন।

একাদশ ও দ্বাদশে বিজ্ঞানের পাঠ্যবই নবম-দশমের তুলনায় অনেকটাই ওজনদার। কিন্তু সে তুলনায় পড়াশোনার সময়টা কম। ভর্তি থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত সময়কালটা ২০ মাসের মতো। একজন শিক্ষার্থী যদি ক্লাসে না যায়, তাহলে এত ওজনদার সিলেবাস আয়ত্ত করা তার পক্ষে কী করে সম্ভব?

সুমাইয়ার দিন শুরু হয় সকাল ছয়টায়। সকাল সাতটায় পড়তে যেতে হয় রসায়ন শিক্ষকের কাছে। সকাল সোয়া আটটায় গণিত শিক্ষকের কাছে। সেখান থেকে ইংরেজি শিক্ষকের কাছে যেতে হয় সকাল সাড়ে নয়টায়। কয়েক ঘণ্টার বিরতির পর বেলা আড়াইটায় আবার পদার্থবিদ্যার শিক্ষকের কাছে। সেখান থেকে বেরিয়ে জীববিজ্ঞান।

খুব একটা ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের বেশির ভাগ জেলা পর্যায়ের সরকারি কলেজগুলোর একাদশ–দ্বাদশের শিক্ষার্থীদের রোজকার রুটিনের এই চিত্রের ভিন্নতা নেই। উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞানের বিষয় সাতটি।

শিক্ষাকে শ্রেণিকক্ষের বাইরে নিয়ে যাওয়ায় একজন শিক্ষার্থীর জন্য পরিবারের খরচ বেড়ে চলেছে অসহনীয়ভাবে। উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষার্থীকে পাঁচটি বিষয়ে সারা বছরই নিয়মিতভাবে প্রাইভেটে অথবা কোচিংয়ে পড়তে হয়। আইসিটি ও বাংলার ক্ষেত্রে চার মাসের কোর্স হিসাবে।

আমার মনে বহুবার প্রশ্ন এসেছে, সরকারি কলেজগুলোতে যাঁরা শিক্ষক হন, তাঁরা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের। হাতে গোনা দু-একজন বাদে এসব শিক্ষকের বেশির ভাগই পড়েছেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সেখানে কি শিক্ষকেরা ক্লাস না করিয়ে তাঁদের প্রাইভেট পড়িয়েছেন? অনেক শিক্ষক একেকটি ব্যাচে ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থী পড়ান। দিনে এ রকম ব্যাচের সংখ্যা তিন থেকে চার। তাঁর পক্ষে কি ক্লাসরুমে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ দিয়ে পড়ানো সম্ভব?

এখন আসা যাক খরচের হিসাবে। পদার্থ, গণিত, রসায়ন, জীববিজ্ঞান (উদ্ভিদবিজ্ঞান ও প্রাণিবিজ্ঞান) ও ইংরেজির শিক্ষকেরা একেকজন মাসে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা করে নেন। সমপরিমাণ টাকা একেকটি ব্যাচে ভর্তির জন্যও নেন তাঁরা। শুধু প্রাইভেট পড়া কিংবা কোচিং বাবদ একাদশের বিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থীর জন্য অভিভাবকদের মাসে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়।

জেলা শহরের এসব কলেজে পড়তে আসে উপজেলার ছেলেমেয়েরা। ফলে তাদের জেলা শহরে গিয়ে মেসে বা হোস্টেলে থাকতে হয়। থাকা, খাওয়া, বই-খাতা কেনাসহ অন্যান্য খরচ বাবদ সেখানেই ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়।

প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের কত শতাংশ পরিবারের পক্ষে তার একাদশে পড়া শিক্ষার্থীর পেছনে এতটা ব্যয় করা সম্ভব? একজন পোশাকশ্রমিকের নিম্নতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার হাজার টাকা। চা-শিল্পের শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা। মাসে যদি ৩০ দিনই কাজ করেন, তাহলে একজন শ্রমিক আয় করেন ৫ হাজার ১০০ টাকা।

সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত আর বেসরকারি খাতের ওপরের দিকের কিছু চাকরি ছাড়া বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের জীবিকা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভরশীল। কম মজুরি, কম বেতন, কম সুবিধা এবং আজ আছে কাল নেই—এ রকম অনিশ্চয়তায় ভরা তাঁদের জীবিকা। প্রায় ৮৯ শতাংশ কর্মসংস্থানই এমন। বলতে পারেন, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের কত শতাংশ মানুষের পক্ষে তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই অন্যায্য ও অযৌক্তিক ব্যয় করে সন্তানদের বিজ্ঞানে পড়ানোর সামর্থ্য আছে?

খুব খোলাখুলিভাবে বললে, ধীরে ধীরে এমন এক ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, যেখানে টাকা নেই যার, তার জন্য শিক্ষাও নয়। দুঃখজনক সত্য যে সেটা ঘটছে বনিয়াদি শিক্ষায়। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাটা বনিয়াদি। রাষ্ট্র সেই শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। জনগণ কর দেয়, সেই টাকায় চলে শিক্ষা। সেই টাকায় বেতন হয় শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের।

আমার মনে বহুবার প্রশ্ন এসেছে, সরকারি কলেজগুলোতে যাঁরা শিক্ষক হন, তাঁরা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের। হাতে গোনা দু-একজন বাদে এসব শিক্ষকের বেশির ভাগই পড়েছেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সেখানে কি শিক্ষকেরা ক্লাস না করিয়ে তাঁদের প্রাইভেট পড়িয়েছেন? অনেক শিক্ষক একেকটি ব্যাচে ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থী পড়ান। দিনে এ রকম ব্যাচের সংখ্যা তিন থেকে চার। তাঁর পক্ষে কি ক্লাসরুমে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ দিয়ে পড়ানো সম্ভব?

সুমাইয়ার বাবা আবদুর রশীদ (ছদ্মনাম) একটি ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ প্রতিষ্ঠানের মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করেন। প্রথম শ্রেণি থেকেই তাঁর মেয়ে ভালো ফল করে আসছে। মাস শেষে তিনি যা বেতন পান, তার অর্ধেকটাই তাঁকে ব্যয় করতে হয় মেয়ের পড়াশোনার পেছনে। দুই বছর ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের ৯৩ শতাংশ মানুষ যখন নিছক খাবারের দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন, সে সময়ে এই অন্যায্য ব্যবস্থার মধ্যে কীভাবে টিকে আছে, সেটা অনেক বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশের মানুষের সহ্যশক্তি আর কাটছাঁট করে জীবন চালানোর কৌশলে বিস্ময় মানতেই হবে।

আমরা কেউই জানি না, এই দুষ্ট চক্র থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ আছে কি না। এটা কেবল শিক্ষকদের নৈতিক প্রশ্নের ব্যাপার নয়। রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে স্বীকৃতি এমন একটি ব্যবস্থা চালু রয়েছে, যেখানে শিক্ষাকে জিম্মি করে প্রচুর মুনাফা করার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। শুধু কলেজ নয়, বনিয়াদি শিক্ষার প্রতিটি স্তরে (প্রাথমিক ও মাধ্যমিকেও) প্রাইভেট ও কোচিংয়ের নির্ভরতা সুনামির মতো বেড়ে গেছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযান এবং জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর দুটি গবেষণা প্রতিবেদন পাশাপাশি রেখে পড়লে এর ভয়াবহতা আঁচ করা যায়।

২০২৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, প্রাথমিকের ৮০ শতাংশ, অষ্টম ও নবম শ্রেণির ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটর বা কোচিংয়ের ওপর নির্ভরশীল। শহর ও গ্রামাঞ্চল—সব পর্যায়েই এ চিত্র দেখা গেছে। অভিভাবকদের তথ্য অনুযায়ী, অষ্টম শ্রেণির প্রায় ৬৪ শতাংশ এবং নবম শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়ার জন্য প্রতি মাসে ১ হাজার ১০০ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসে, বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যয়ের ৭১ শতাংশ পরিবারগুলো বহন করে।

বনিয়াদি শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে না দেখে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে দেখার যে নীতি, তার ফলেই আজকের এ পরিস্থিতি। সমাজের সবখানেই বৈষম্য যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গেড়ে বসেছে, তার প্রতিফলন আমরা শিক্ষাতেও দেখছি। স্রেফ সামর্থ্য নেই বলে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাঁদের সন্তানদের বিজ্ঞানে পড়াতে পারেন না।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেকে আশাবাদী যে এতে প্রাইভেট পড়ানো, কোচিং ও গাইড ব্যবসার অবসান হবে। শিক্ষা ফিরবে শ্রেণিকক্ষে। কিন্তু বাস্তবে আশাবাদী হওয়ার খুব একটা কারণ দেখা যাচ্ছে না। এর মাঝে কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তাঁরা নিঃসংশয়ে বলেছেন, শিক্ষকদের হাতে ৪০ শতাংশ নম্বর। শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের তাঁদের কাছে আসতেই হবে।

  • মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী