এ কোন হাইজ্যাকারের কবলে কেভিন ম্যাকার্থি!

কেভিন ম্যাকার্থি

মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন কেভিন ম্যাকার্থি। এ জন্য দলের কট্টরপন্থী ক্ষুদ্র একটি গ্রুপের কাছে তাঁকে এত ছাড় দিতে হয়েছে যে দায়িত্ব পালনে তাঁর সাফল্য নিয়ে এখনই সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
ভরদুপুরে, আলো ঝকমকে দিনে হাইজ্যাকারের কবলে পড়েন কেভিন ম্যাকার্থি। বুদ্ধিমান লোক তিনি, বন্দুক উঁচিয়ে ধরার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পকেট থেকে মানিব্যাগ হাইজ্যাকারদের হাতে তুলে দেন। কিন্তু তারাতো অত সহজে খুশি হওয়ার লোক নয়। তারা বলল, ‘তোমার গায়ের জামাটাও চাই।’ ঠিক আছে, বিনা বাক্যব্যয়ে জামাটি তুলে দিলেন। কিন্তু হাইজ্যাকাররা তাতেও খুশি নয়, তারা বলল, তোমার পরনের প্যান্টটিও চাই। ম্যাকার্থি সবার সামনে সেই প্যান্ট খুলে দিয়ে দুই হাত এক করে বললেন, ‘ভাই এবার যাই?’

একদম বাড়িয়ে বলছি না। নিজের ওই অন্তর্বাসটি ছাড়া বাকি সব বসন ছাড়াই মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের ১১৮তম অধিবেশনের স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন কেভিন ম্যাকার্থি। সারা জীবনের স্বপ্ন, সেই ২০১৫ থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন স্পিকারের হাতুড়ি খানা হস্তগত করবেন। প্রয়োজন হলে সবশেষ ‘ল্যাংগোটখানা’ দিয়ে হলেও তিনি স্পিকার হতেন।

গণতন্ত্রের উল্লাস নাকি হাটে গরু কেনাবেচা

শুক্রবার মোট ১৫ বার ভোটের পর সর্বনিম্ন নির্বাচন যোগ্য ভোট পেয়ে তিনি স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন। ১৮৫৬ সালের পর কাউকে এতবার ভোটের প্রতিযোগিতা সহ্য করে নির্বাচন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়নি। এতে বেআইনি কিছু নেই, বস্তুত রিপাবলিকান নেতৃত্ব এতে গণতন্ত্রের সাফল্য দেখছেন। একজন মান্যবর রিপাবলিকান নেতা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, তাঁরা ডেমোক্র্যাটদের মতো নন যে (স্পিকার) ন্যান্সি পেলোসি নির্দেশ দিলেন আর সবাই সুড়সুড় করে হাত তুলে তাঁর কথা সমর্থন করবেন। তিনি বলেন, তাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব মত আছে, তাঁদের প্রত্যেকের আসল আনুগত্য নিজ নিজ এলাকার ভোটারদের কাছে, দলনেতাদের কাছে নয়।

খুবই ন্যায্য কথা। ব্যাপারটা যদি সত্যি সত্যি নীতিগত মত পার্থক্যের কারণে ঘটত, তাহলে বাহবা জানানো যেত বৈকি। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, মাত্র জনা–বিশেক অতি রক্ষণশীল কংগ্রেস সদস্য, যাঁরা নিজেদের জন্য অতিরিক্ত সুবিধা আদায়ের জন্য কেভিন ম্যাকার্থিকে রীতিমতো জিম্মি করে রেখেছিলেন। তাঁদের ভাবটি এমন ছিল, হয় আমাদের দাবি মেনে নাও, নয়তো আমরা তোমার বিরুদ্ধে ভোট দেব। তাঁদের নিজ পক্ষে টানতে কেভিন ম্যাকার্থিকে গরুর হাটে গরু কেনাবেচার মতো নিজেকে বেচতে নামতে হয়েছে।

আরও পড়ুন

গত নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান দল স্বল্প কয়েক আসনের ব্যবধানে কংগ্রেসে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে। নিয়মমাফিক কংগ্রেসের মোট ৪৩৫ জন সদস্যের অন্তত ২১৮ জনের ভোট পেলে স্পিকার নির্বাচিত হওয়া সম্ভব। তাদের হাতে রয়েছে ২২২ ভোট ও মাত্র ৫ জন সদস্য ‘না’ বললে ম্যাকার্থির আর স্পিকার হওয়া হয় না। কিন্তু তিনি তো স্পিকার হবেনই, এ জন্য যে মূল্যই তাঁকে দিতে হোক না কেন। ফলে প্রথমে ওই ২০ জনের সঙ্গে আপসরফার চেষ্টা হলো। উৎকোচ পেয়ে ‘না’ বলা সদস্যের সংখ্যা কমে ১০ থেকে ১২-তে নামল। ম্যাকার্থি আরও ছাড় দিলেন, আপত্তিকারী ব্যক্তিদের সংখ্যা তখন কমে পাঁচ-এ নামল। দরকার আরও একজন, তার সঙ্গে আড়ালে একটারফা হলো, কিন্তু ভোটের সময় দেখা গেল সে কথার বরখেলাপ করে ম্যাকার্থির পক্ষে ভোট দেওয়ার বদলে ‘উপস্থিত’ বলে ‘গ্যাট হয়ে’ নিজের আসনে বসে থাকল। ক্ষিপ্ত ম্যাকার্থি দ্রুত নিজের আসন ছেড়ে ছুটে এলেন। তাঁর সমর্থক আরও জনা–দুই তেড়ে এলেন, একজন ঘুষি পাকিয়ে প্রায় হামলে পড়েন আরকি। তবে ঠান্ডা মাথার দু-চারজনের হস্তক্ষেপে আরও কিছু ছাড় দিয়ে শেষ ভোটটিও আদায় করে নিলেন ম্যাকার্থি।

কী ও কত ছাড় দিতে হয়েছে

লিখিতভাবে যে নীতিমালা গৃহীত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, খুব বেশি কিছু নয়। একমাত্র উল্লেখযোগ্য ছাড় হলো, যেকোনো একজন সদস্যের দাবিতেই স্পিকার পরিবর্তনের প্রশ্নে ভোট হবে। আপাতভাবে মনে হয়, এর ফলে ভয়ানক রকম অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হবে। কিন্তু ২০১৯ সালের আগপর্যন্ত এই নিয়মই চালু ছিল। সে বছর প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণভার ফিরে পেয়ে ন্যান্সি পেলোসি একজনের সংখ্যা বাড়িয়ে ৫০ জনে উন্নীত করেন। এই বিষয়ের দুটি দিক রয়েছে। এ কথা ঠিক স্পিকারকে যদি নিজের চাকরি হারানোর ভয়ে সারাক্ষণ আতঙ্কিত হয়ে থাকতে হয়, তাহলে একধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে। কিন্তু পাশাপাশি এও ঠিক, এই বিপদ রয়েছে জেনে স্পিকার বা দলের নেতারা জোর করে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। তাতে কংগ্রেসের কাজ অধিক গণতান্ত্রিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আসল ভয় অন্যত্র। জানা গেছে, অলিখিত ও অপ্রকাশিত এক নথিতে কেভিন ম্যাকার্থি যে ২০ জনের মতো অতি রক্ষণশীল তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে তাঁদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটির নেতৃত্ব পদে গ্রহণে সম্মত হয়েছেন। এর ফলে যেসব সিনিয়র নেতা কমিটি পদে দায়িত্বের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন, তাঁরা বিলক্ষণ ক্ষিপ্ত হবেন। এই দুই পক্ষকে বাগে এনে কংগ্রেসের কাজকর্ম চালানো তাঁর জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে।  
অন্য ভয়, ম্যাকার্থি চরমপন্থীদের দাবির মুখে কংগ্রেসের কাজকর্মে পরিবর্তন আনতে রাজি হয়েছেন। এখন থেকে যেকোনো একজন সদস্য কংগ্রেসের ‘ফ্লোর’ থেকে যেকোনো প্রস্তাবিত আইনে ভোটের আগে সংশোধনী আনতে পারবেন। এর ফলে একের পর এক সংশোধনী আনা হলে কোনো প্রস্তাব পাস হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুন

বাজেট প্রস্তাবেও কিছু কিছু আগাম দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে, যার ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে বিবাদ অনিবার্য। যেমন যেকোনো অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দ অনুমোদনের সময় সমপরিমাণ ব্যয় সংকোচ নিশ্চিত করার দাবি তুলেছেন কটরপন্থীরা। মনে হয় না সিনেটে, যেখানে পরিচালকের আসনে ডেমোক্র্যাটরা, তারা সোশ্যাল সিকিউরিটিসহ সামাজিক নিরাপত্তা জালে কোনো রকম কাটছাঁট মেনে নেবে। অনেকে ভয় পাচ্ছে, যার যার অগ্রাধিকার নিয়ে দুই দলের দড়ি টানাটানির ফলে সময়মতো পরবর্তী বাজেট পাস না-ও হতে পারে। ব্যয় বরাদ্দ অনুমোদিত না হওয়ায় অল্প সময়ের জন্য হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এটি আগেও হয়েছে। খোলাবাজার থেকে সরকারি ঋণ গ্রহণের মাত্রা প্রশ্নে রিপাবলিকান কট্টরপন্থীদের আপত্তি রয়েছে, তাদের বাগে আনা না গেলে এই প্রশ্নে বড় ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

ইউক্রেনকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রশ্নে রিপাবলিকানদের মধ্যে মত বিরোধ রয়েছে। অধিকাংশ রিপাবলিকান বর্তমান যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সমর্থক, কিন্তু ট্রাম্পের সমর্থক হিসেবে পরিচিত কটরপন্থীরা আগাম জানিয়ে দিয়েছে ইউক্রেনকে সাহায্যের নামে ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ দিতে তারা গররাজি।

বাগড়া দেওয়ার আনন্দ

বস্তুত এসব কট্টরপন্থীরা কতটা নীতিগত কারণে, কতটা শুধু বাধা সৃষ্টির ফুর্তিতেই ঝামেলা পাকাবে, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কোনো কোনো রিপাবলিকান সদস্য নিজেরাই এসব কট্টরপন্থীদের ‘ক্রেজি’ বা উন্মাদ হিসেবে অভিহিত করেছেন। নতুন কংগ্রেসের কাজ শুরু হওয়ার আগেই এসব সদস্যরা জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ক্ষমতাসীন বাইডেন প্রশাসনের বিভিন্ন কাজের তদন্ত শুরু করবে। এসব তদন্তের অন্যতম হলো প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পুত্র হান্টার বাইডেনের সঙ্গে চীন ও ইউক্রেনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক। বিচার বিভাগও তাদের তদন্ত তালিকায় রয়েছে। গত চার বছর ডেমোক্র্যাটরা যেভাবে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাজ নিয়ে একের পর তদন্ত চালিয়েছে, এবার তারা সে কাজের প্রতিশোধ নেবে।

দেখা যাচ্ছে, কাজ শুরু হতে না হতেই এই কংগ্রেসের আকাশে কালোমেঘ জড়ো হতে শুরু করেছে। তবে ঘন মেঘের ফাঁকেও তো আলোর ঝিলিক দেখা যায়। সদ্য ক্ষমতা ফিরে পাওয়া রিপাবলিকানরা যদি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তাহলে দুই বছর পর পরবর্তী নির্বাচনে তাদের আবার হারার আশঙ্কা রয়েছে। সেটিই হবে আঁধারে আলো।

  • হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক