চোখে দেখে নয়, দুর্গন্ধ দিয়েই চেনা যায় শ্যামাসুন্দরী

রংপুরের ধাপ সিটি বাজারসংলগ্ন শ্যামাসুন্দরীর অবস্থা দেখে মনে হবে, এটা একটা ভাগাড়ছবি: লেখক

আমার পুরোনো ফাইলপত্র খুঁজলে শ্যামাসুন্দরী নদী বা খালবিষয়ক অন্তত অর্ধশত সভার নোটিশ আর রেজল্যুশন পাওয়া যাবে। জেলা নদী রক্ষা কমিটি, বিভাগীয় নদী রক্ষা কমিটি এবং সিটি করপোরেশনের সভার নোটিশ আর রেজল্যুশন। প্রতিটি সভায় শ্যামাসুন্দরীর সুরক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বাস্তবে শ্যামাসুন্দরী হয়ে উঠেছে টেবিলের আলোচনার বিষয়। নানা কল্পনা আর উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের স্বপ্নে যখন বিভোর দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিগণ, তখন সবার চোখের সামনে দখল-দূষণে বিলুপ্ত হওয়ার পথে শ্যামাসুন্দরী।

শেষ ৪ ফেব্রুয়ারি রংপুরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ‘শ্যামাসুন্দরী খালের দূষণ-অবৈধ দখলরোধে এবং পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখা’র জন্য একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পরিচালক দেলোয়ার হোসেন উপস্থিত ছিলেন।

রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আনিচুজ্জামান জানান, ‘শ্যামাসুন্দরী খাল পুনঃখনন ও সৌন্দর্যবর্ধন’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা প্রস্তুত করার কাজ চলছে। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে প্রকল্পটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন তিনি। সম্ভাব্য ব্যয় দেখান ৯৬৬ কোটি টাকা।

শ্যামাসুন্দরীর দৈর্ঘ্য মাত্র ১০ কিলোমিটার। এই প্রবাহের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে আর খনন করতে তিন কোটি টাকার বেশি প্রয়োজন হবে না। তিন কোটি টাকা হলে যে শ্যামাসুন্দরীর প্রাণ ফেরানো সম্ভব, সেই শ্যামাসুন্দরীর জন্য কেন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প, সেটি বোধগম্য নয়! যদি খননের সঙ্গে পাড় সংরক্ষণের কাজ করা হয়, তাহলে কিছু টাকা বেশি লাগবে।

সাধারণত একটি ধারণা জনমনে বদ্ধমূল হয়েছে যে প্রকল্প মানেই শত শত কোটি টাকা! যত বড় প্রকল্প, তত বেশি টাকা তছরুফের সুযোগ থাকে। শ্যামাসুন্দরীকে নিয়ে যে প্রকল্প দাঁড় করানো হচ্ছে, সেটি অব্যাহত থাকুক। তাতে কোনো অসুবিধাও নেই। কিন্তু সামান্য টাকা ব্যয় করলে যে শ্যামাসুন্দরীর প্রাণ ফিরতে পারে, সে কাজ কেন বন্ধ থাকবে?

শ্যামাসুন্দরীতে পানির প্রবাহ ফেরানো গেলে তলদেশ সহজে ভরাটও হতো না। নদীর তলদেশের গভীরতা ঠিক থাকত। একটি হচ্ছে শ্যামাসুন্দরীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখা, আরেকটি তার সৌন্দর্যের দিক। শ্যামাসুন্দরীর অবৈধ দখল উচ্ছেদপূর্বক দূষণমুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

রংপুর শহরের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ এই শ্যামাসুন্দরী। সবাই মিলে দুর্গন্ধ আর মশা উৎপাদনের কারখানায় পরিণত করা হয়েছে। কারও চোখ বন্ধ করে যদি এই শহরে ঘোরানো হয়, তবু তিনি শ্যামাসুন্দরী পার হওয়ার কথা বলতে পারবেন। চোখ দিয়ে দেখা ছাড়া দুর্গন্ধ দিয়েই চেনা যায় শ্যামাসুন্দরী।

২০০৬-০৭ সালে একবার অবৈধ দখলদারদের তালিকা করা হয়েছিল। কিছু উচ্ছেদও করা হয়েছিল। ১০-১২ বছর আগে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে শ্যামাসুন্দরীর পাড় সংস্কার করা হয়েছিল। সেই কাজও ছিল কার্যত লোকদেখানো।

২০১৯ সালের দিকে শ্যামাসুন্দরীর সুরক্ষার জন্য একটি কোর কমিটি গঠন করা হয়। আমি সেই কোর কমিটির সদস্য। ওই কমিটির নেতৃত্বে কোভিড শুরু হওয়ার আগে আবারও অবৈধ দখলদারদের তালিকা করা হয়। সেই তালিকা মোতাবেক কিছু অবৈধ দখল উচ্ছেদও করা হয়। কেবল তা–ই নয়, সীমানা চিহ্নিতকরণ পিলারও দেওয়া হয়েছিল। তখন জেলা প্রশাসক ছিলেন আসিব আহসান। অবশিষ্ট অবৈধ দখল আর উচ্ছেদ করা হয়নি। বরং এখন নতুন করে দখলপ্রক্রিয়া দ্রুতগতিতে বেড়েছে।

ছয় বছর ধরে প্রকল্পের প্রস্তাবনা তৈরির কাজ চলছে। এর মধ্যে দুজন জেলা প্রশাসক, তিনজন বিভাগীয় কমিশনার বদলি হয়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট আরও অনেক কর্মকর্তা বদলি হয়েছেন। যখনই কর্মকর্তা বদলি হন, তখনই শ্যামাসুন্দরীর কাজে গতিও কমে আসে।

আরও পড়ুন

পানি উন্নয়ন বোর্ড শ্যামাসুন্দরীতে কয়েকটি স্থানে সাইনবোর্ড দিয়েছে। সাইনবোর্ডে শ্যামাসুন্দরীর পরিচয়ে লেখা আছে নদী/খাল। পুরোনো তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, শ্যামাসুন্দরী হলো মূলত পুরোনো ঘাঘট নদ। ১৮৯০ সালে রাজা জানকী বল্লভ সেন এটি পুনঃখনন করেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল শ্যামাসুন্দরী।

শহরের ধাপ সিটি বাজারের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হবে, এটি সিটি করপোরেশনের একটি ভাগাড়। কোথাও মনে হবে যে এটি একটি নর্দমা। কখনো কখনো বিস্ময় জাগবে, একটি প্রাকৃতিক প্রবাহ কীভাবে এত কালো আর দুর্গন্ধযুক্ত হতে পারে?

রংপুর শহরের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ এই শ্যামাসুন্দরী। সবাই মিলে দুর্গন্ধ আর মশা উৎপাদনের কারখানায় পরিণত করা হয়েছে। কারও চোখ বন্ধ করে যদি এই শহরে ঘোরানো হয়, তবু তিনি শ্যামাসুন্দরী পার হওয়ার কথা বলতে পারবেন। চোখ দিয়ে দেখা ছাড়া দুর্গন্ধ দিয়েই চেনা যায় শ্যামাসুন্দরী।

শ্যামাসুন্দরীর ওপরে সেতু আছে ৩৫টি। সব কটি নদীর প্রকৃত মাপের চেয়ে ছোট। এ নদীর ভেতর একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হয়েছে। নির্মাণের সময়ে জেলা প্রশাসককে জানিয়েছিলাম। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

যখন কেউ জেলা প্রশাসক হয়ে রংপুরে আসেন, তাঁর অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজের তালিকায় থাকে শ্যামাসুন্দরী নদী/খাল রক্ষা করা। সংসদ সদস্য কিংবা মেয়র পদে নির্বাচনে প্রার্থীরা যেসব প্রতিশ্রুতি দেন, তার অন্যতম শ্যামাসুন্দরীর সুরক্ষা। কোনো কোনো বিভাগীয় কমিশনারও শ্যামাসুন্দরীর প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন।

শ্যামাসুন্দরীকে নদী নামে ডাকি আর খাল নামে ডাকি, এটি এখন ঘাঘট নদের শাখা। ফলে শ্যামাসুন্দরীকে বাঁচাতে হলে ঘাঘটের কথাও মনে রাখতে হবে। নীলফামারী জেলায় কৃত্রিমভাবে ঘাঘটকে তিস্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আমরা চাই, শ্যামাসুন্দরী বাঁচুক।

শ্যামাসুন্দরীকে বাঁচানো না গেলে রংপুরের জলাবদ্ধতার ভোগান্তি শেষ হবে না। শ্যামাসুন্দরীতে আবার স্বচ্ছ জলের ধারা প্রবাহিত হোক। আগের মতো শিশুরা সাঁতার কাটুক এ জলে। মন খারাপ হলে নগরবাসী যেন শ্যামাসুন্দরীর পাশে যান মন ভালো করতে।

● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক