আর্থিক খাতে সংস্কার কখন ও কীভাবে

বাংলাদেশের আর্থিক খাতে সংস্কারের প্রসঙ্গ এলেই খাত-সংশ্লিষ্ট সুধীজনদের বলতে শুনি—‘লং ওভারডিউ’ অর্থাৎ অনেক দিনের বকেয়া। এই খাতে মূলত বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এখন পর্যন্ত যে সংস্কার হয়েছে, সেগুলো ব্যাংক ঋণ বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি উন্নতকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নির্দিষ্ট খাতটির উন্নতিকল্পে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগগুলো বেশির ভাগ ব্যাসেল-১, ২ বা ৩-এর আলোকে গৃহীত তথা ঝুঁকির বিপরীতে মূলধন ব্যবস্থাপনাভিত্তিক।

স্বাধীনতার ৫৩ বছরে আমাদের অর্থনৈতিক যাত্রা অনেকটা পাওয়া আর না-পাওয়ার বিষয়। আমাদের অর্থনীতির আকার অনেক বেড়েছে, আমরা আবার অনেক জ্ঞাত-সংকট দীর্ঘদিন ধরেই সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছি। ইতিহাস বলে—কোনো দেশ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ততক্ষণ পর্যন্ত টেকসই করতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আর্থিক খাতে গভীরতা আনে এবং রপ্তানিমুখী অর্থনীতি গড়ে তোলে। যেসব দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ক্রমাগত ৬ বা ৭ শতাংশ করে বাড়িয়েছে, তারা এ পথেই এগিয়েছে। বেসরকারি খাতকে চালকের আসনে বসিয়েছে।

আরও পড়ুন

আমরা যদি দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের মতো অর্থনীতির উত্থান পাঠ করি, তাহলে দেখব তাদের প্রতিটি দেশই এই দুই জিনিসের ওপর জোর দিয়েছে। ভারত অবশ্য স্থানীয় বর্ধিঞ্চু বাজারের ওপরও এখন জোর দিচ্ছে। বিশাল জনসংখ্যার দেশ হওয়ায় তাদের স্থানীয় বাজারও অনেক সম্ভাবনাময়।

১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ হিসেবে আমাদেরও স্থানীয় বাজারে সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তৈরি পোশাক খাতের মতো অনেক রপ্তানিমুখী খাত লাগবে আমাদের। আর্থিক খাতের গভীরতা ও প্রোডাক্ট বা পরিষেবা বিবেচনায় এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো থেকে আমরা পিছিয়ে আছি। যেমন খেলাপি ঋণে আমরা পাকিস্তানের কাছাকাছি হলেও ভারত-শ্রীলঙ্কা থেকে বেশি। এ বিষয়টির সঙ্গে সুশাসন বা গুড গভর্ন্যান্স জড়িত আছে বিধায় ভারত বাকি দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে।

কারা ব্যাংকের মালিক, কারা বেশি বেশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যাচ্ছেন, মন্দ ঋণ আদায়ে কারা অভিনবত্ব ও দক্ষতা দেখাচ্ছেন, প্রোডাক্ট-স্বল্পতা ও প্রযুক্তির ব্যবহার, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহনশীলতা, আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনায় কতটুকু মেধা লালন করতে পারছি, আর্থিক খাতের পরিচালকদের ভূমিকা ইত্যাদি বিষয় অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যাবে তা নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সুশাসনের ব্যাপারে যদি নজর দিই, তাহলে দেখব, এখানে এখনো মূলত পরিচালকেরাই ব্যাংকের মালিক এবং তাঁরা ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের কাজে হস্তক্ষেপ করেন।

আমরা মাঝে একবার তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর আল্লাহ মালিক কাজেমী, ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম, বেসরকারি খাতের প্রতিনিধি, জাপানি দূতাবাস ও আইএফসিকে নিয়ে বেটার বিজনেস ফোরাম করেছিলাম। পরবর্তী সময় রেগুলেটরি রিফর্মস কমিশন করেছিলাম। তখন রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, অপারেশন রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, ক্রেডিট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, মার্কেট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট, কান্ট্রি রিস্ক ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কাজ করেছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিস্ক ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন আধুনিকীকরণ আমরা কাজ করেছিলাম।

আমাদের রপ্তানি খাত এগিয়েছে, ব্যক্তি খাতে আর্থিক জোগান বেড়েছে, বিদেশ থেকে পড়ে এসে দেশে অনেকেই নতুন করে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ করছেন, মা-বাবার তথা পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিচ্ছেন, ব্যক্তি খাতে প্রযুক্তির ব্যবহারও বেড়েছে।

আমাদের এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অভাব রয়েছে, রয়েছে নতুন চিন্তা করার সময়েরও। প্রোডাক্টের বৈচিত্র্য নেই এবং রয়েছে সুশাসনের অভাব। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ব্যবস্থাপনারওপর অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায় পরিচালকমণ্ডলীর। শ্রীলঙ্কার অর্থ বাজারে যে প্রোডাক্ট রয়েছে, এমনকি পাকিস্তানের অর্থ বাজারেও যে প্রোডাক্ট রয়েছে, বাংলাদেশে তা নেহাতই নগণ্য।

তবে বিকাশমান রপ্তানি ও বেসরকারি খাতভিত্তিক অর্থনীতি হলেও আমাদের নিয়মকানুন সব মান্ধাতার আমলের। ফলে প্রচলিত নিয়মের খানিক পরিবর্তন আনতে হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। আবার ১৯৪৭ সালের বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইনে চলার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন যুগের সমস্যা সমাধানে হিমশিম খাচ্ছে।

আবার সবকিছুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অসীম ক্ষমতার কারণে সেখানকার শীর্ষ কর্তাদের মধ্যেও আমলাতান্ত্রিক চিন্তাধারার জন্ম নিয়েছে। ধরেন, আপনি চিকিৎসার জন্য বাইরে যাচ্ছেন, আপনার ডলার লাগবে? যেতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। বিদেশে সামান্য অর্থ বিনিয়োগ করবেন, অনুমোদন লাগবে বাংলাদেশ ব্যাংকের। ক্রেডিট কার্ডের সীমার বাইরে যাবেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যেতে হবে।

এ রকম বিভিন্ন কাজে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তদাতা হিসেবে নানা কাজে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। ফলে সেখানে নতুন চিন্তার প্রকাশ ও বিকাশ হচ্ছে না। অথচ অন্যান্য দেশ অনেক উদার হয়ে গেছে। এমনকি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও অনেক পরিবর্তন এনেছে। বেসরকারি খাত কিংবা বিদেশি ব্যাংক থেকে এনেও অনেককে সেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বানানো হয়েছে।

ভারত, শ্রীলঙ্কা—এমনকি পাকিস্তানের গভর্নররাও বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর বিতর্কে জড়িয়েছেন। সুদহার ও বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের সঙ্গে বিরোধ হয়েছে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের।

অন্যদিকে রঘুরাম রাজন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) দায়িত্ব নিয়েই দুটি থট পেপার উপস্থাপন করেছিলেন। প্রথমটি ছিল ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের ওপর এবং অন্যটি হয়তো অনেকেই জানেন না, ইসলামিক ফিন্যান্সের ওপর। পেমেন্ট গেটওয়ের ক্ষেত্রে উদারীকরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন রঘুরাম রাজন।

আমাদের এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতার অভাব রয়েছে, রয়েছে নতুন চিন্তা করার সময়েরও। প্রোডাক্টের বৈচিত্র্য নেই এবং রয়েছে সুশাসনের অভাব। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ব্যবস্থাপনারওপর অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায় পরিচালকমণ্ডলীর। শ্রীলঙ্কার অর্থ বাজারে যে প্রোডাক্ট রয়েছে, এমনকি পাকিস্তানের অর্থ বাজারেও যে প্রোডাক্ট রয়েছে, বাংলাদেশে তা নেহাতই নগণ্য।

আরও পড়ুন

আমরা যখন বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক ঋণ নিই, তখন দেখা যায় ওই প্রকল্প লাভজনক হতে তার পে-ব্যাক পিরিয়ড থাকে ১০ থেকে ১৫ বছরের। অথচ বাংলাদেশে তিন বছরের বেশি মেয়াদি কোনো ফিক্সড ডিপোজিট নেই। বেশির ভাগ ফিক্সড ডিপোজিটের মেয়াদ হচ্ছে এক বছরের। আমরা কীভাবে ১২ থেকে ১৫ বছরের পে-ব্যাক পিরিয়ডের কোম্পানিগুলোয় বিনিয়োগ করব, যেখানে আমাদের আমানতই হলো সর্বোচ্চ তিন বা চার বছরের? অন্যান্য দেশ কী করে? বাজারে বন্ড ছাড়ে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের উৎসাহ থাকার পরও আমরা দীর্ঘমেয়াদি বন্ড ছাড়তে পারিনি।

এ কারণে আমাদের মুদ্রাবাজারে তেমন গভীরতা নেই। শ্রীলঙ্কার মুদ্রাবাজারে গভীরতা থাকায় গত বছর সংকটে পড়লেও বেশ নজরকাড়াভাবে ফিরে এসেছে। সংকটকালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিলের সঙ্গে বৈঠককালে নন-রেসিডেন্ট শ্রীলঙ্কানদের কাজে লাগিয়েছে।

আমাদের ব্যাংক খাতে আরেকটি সংকটের জায়গা হলো, স্বাধীন পরিচালক নিয়োগে ভালো চর্চা নেই। ভারত ও শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে দেখা যায়, মূলত ব্যাংক খাতে প্রচুর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট যারা চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত, দেশে-বিদেশে কাজ করা ব্যাংকার কিংবা আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে কাজ করা গভর্ন্যান্স বিশেষজ্ঞদের স্বাধীন পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

আমাদের এখানে স্বাধীন পরিচালকদের বোর্ড ফি কত? মাত্র আট হাজার টাকা! এত অল্প টাকায় কেন আসবেন একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি, যিনি পরামর্শক হিসেবে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করতে পারেন? শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়ম করে দিয়েছে ব্যাংকে ন্যূনতম চারটি কমিটি সভায় উপস্থিত থাকা স্বতন্ত্র পরিচালকের সম্মানী হবে সভাপ্রতি দেড় লাখ রুপি। ভারতে আরবিআই ঠিক করেছে এক লাখ রুপি। সম্মানজনক সম্মানী হলে স্বতন্ত্র পরিচালক তখন ব্যাংকের মঙ্গলের জন্য ভাবতে পারবেন, কাজ করতে পারবেন। এ দেশে স্বতন্ত্র পরিচালকদের বোর্ড ফি একদম নগণ্য।

অডিট করার সময় আমরা একটা বিষয় শিখেছিলাম, আশপাশে যখন অনেক টাকা থাকে, তখন কারও বেতন অপেক্ষাকৃত কম হলে তাঁর দুর্নীতিতে জড়ানোর আশঙ্কা থাকে। এ জন্য বলা হয় ক্যাশ বা নগদ নির্ভরশীল সমাজে দুর্নীতি দমনের প্রধান অস্ত্র হলো ক্যাশলেস সোসাইটি, ক্যাশলেস ব্যাংকিং। আমাদেরও সেই পথে এগোতে হবে।

আর্থিক খাত ব্যবস্থাপনায় পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিযোগী দেশ আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। কেন পাকিস্তানি ও ভারতীয় ব্যাংকাররা দুবাইয়ে চাকরি পাচ্ছেন? সিঙ্গাপুর, হংকং—এমনকি উত্তর আমেরিকার ব্যাংকগুলোয় ভারতের পর পাকিস্তান, এমনকি শ্রীলঙ্কান ব্যাংকাররা চাকরি পেলেও আমাদের ব্যাংকাররা কেন পাচ্ছেন না, তাঁরা কেন পিছিয়ে আছেন? গ্রাহকদের নতুন নতুন চাহিদা মেটাতে প্রতিষ্ঠানগুলো কেন নতুন সেবা-পণ্য আনতে পারছে না? আমাদের পরিচালনা পর্ষদ কেন ব্যাংককে ঠিকভাবে চালাতে পারছে না, কেন এমডি-ডিএমডিদের কাজ করতে দেওয়া হয় না?

আমাদের সময় এসেছে এসব প্রশ্ন তোলার। এমনকি কার্যকর দিকনির্দেশনারও।

  • মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।