এরশাদবিরোধী আন্দোলনে আপসহীন ভূমিকা খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয় এবং ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে তিনি সরকার গঠন করেন। পঞ্চম থেকে নবম—এই চার সংসদের মেয়াদে খালেদা জিয়া পালা করে প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপি ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। আর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর যখন একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়, তখন তিনি কারাগারে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ওই বছর ৮ ফেব্রুয়ারি জেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। জেলে যাওয়ার আগে তিনি দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে যান। এই মামলায় তাঁর পাঁচ বছর কারাদণ্ড হয়। একই বছর ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় তাঁর সাত বছর জেল হয়। সেই হিসাবে খালেদা জিয়ার কারাবাসের মেয়াদ পাঁচ বছর হলো ৮ ফেব্রুয়ারি। বিএনপির দাবি, দুটি মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। খালেদা জিয়া কোনো দুর্নীতি করেননি।
দুটি মামলায় হাইকোর্ট রায়ের পর বিএনপি লিভ টু আপিল দায়ের করলেও তিন বছরের বেশি সময় ধরে তা ঝুলে আছে। বিএনপি নিষ্পত্তির জন্য চেষ্টা করছে না। তাদের ভয়, আপিল বিভাগে নাকচ হলে আইনি লড়াইয়ের শেষ সুযোগটিও থাকবে না। আওয়ামী লীগের অভিযোগ, বিএনপিই খালেদা জিয়ার মুক্তি চায় না বলে লিভ টু আপিলের নিষ্পত্তি করছে না।
সরকারি দলের নেতাদের এই বক্তৃতা–বিবৃতির জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাঁর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না-করার বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ নাটক শুরু করেছে। ক্ষমতাসীন দলের উদ্দেশ্য খারাপ। সরকারি দলের নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে হঠাৎ করে আপনাদের এত দরদ উথলে উঠল কেন? উদ্দেশ্য একেবারেই ভালো না, খারাপ। তাঁরা দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চান। দেশের মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে চান। আমাদের সামনে দৃষ্টি একটাই—ভোটের অধিকার ফেরত চাই।’
উল্লেখ্য, করোনা মহামারির মধ্যে তাঁর পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নির্বাহী আদেশে দণ্ড স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয় ২০২০ সালের ২৫ মার্চ। এর পর থেকে পরিবারের আবেদনে ছয় মাস অন্তর তাঁর মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। মুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আরেক দফা তাঁকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বাহাস চলে। ‘এ’ পক্ষ সরকারের মহানুভবতার জন্য ‘বি’ পক্ষকে কৃতজ্ঞ থাকতে বলে। আবার ‘বি’ পক্ষ খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য ‘এ’ পক্ষের সমালোচনা করে।
বাংলাদেশে অনেক উদাহরণ আছে, বিচারিক আদালতে দণ্ড হওয়ার পরও বহু নেতা রাজনীতি করেছেন। জামিন পেয়েছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া জামিন পাননি। ফলে তিনি রাজনীতিও করতে পারছেন না। বর্তমানে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার শাস্তি স্থগিত আছে এবং তিনি নিজের বাড়িতে অবস্থান করছেন। শাস্তি স্থগিত করা হয়েছে দুটি শর্তে। তিনি নিজের বাড়িতে থেকে চিকিৎসা করাবেন এবং বিদেশে যেতে পারবেন না।
খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ বাড়াতে তাঁর ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার ৬ মার্চ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। বরাবরের মতো এবারও তাঁদের আবেদনে খালেদা জিয়ার সাজা মওকুফ চাওয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে কোনো কোনো গণমাধ্যম খবর প্রচার করে যে খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। এর সূত্র কী? বরাবরের মতো এবারও খালেদা জিয়ার পরিবার থেকে শাস্তি স্থগিত করার আবেদন জানানো হয়েছে। আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে গেছে। খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার বিষয়ে ‘উদার’ আইনমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এবার সত্যি সত্যি তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারবেন কি না। আইনমন্ত্রী বলেছেন, সেই সম্ভাবনা নেই। শাস্তি স্থগিত হলে আগের শর্তেই হবে। অর্থাৎ তাঁকে দেশে থেকেই চিকিৎসা নিতে হবে।
এর আগে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে কোনো বাধা নেই। তবে দণ্ডিত বিধায় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।’ কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকও তাঁকে সমর্থন করেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না। দুই মন্ত্রী বলেছেন, পারবেন। দুই মন্ত্রী বলেছেন পারবেন না। জনগণ কোনটা বিশ্বাস করবেন?
বিএনপির নেতারা মনে করেন, খালেদা জিয়াকে নিয়ে এসব কথাবার্তার পেছনে সরকারের ভিন্ন উদ্দেশ্য আছ। প্রথমত, বিএনপি যে নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে, তা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের যে আবেগ আছে, সেটি কাজে লাগানো। তৃতীয়ত, খালেদা জিয়া সত্যি সত্যি রাজনীতিতে সক্রিয় হলে বলা হবে, সুস্থ ব্যক্তি তো সরকারের বিশেষ অনুকম্পা পেতে পারেন না এবং তাঁকে ফের জেলে যেতে হবে।
বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী মনে করেন, সরকারের উদ্দেশ্য যা–ই থাকুক না কেন, খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় হলে দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা উজ্জীবিত হবেন। বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে দলাদলি আছে, তা–ও বন্ধ হবে। এখন রিমোট কন্ট্রোলে যে দল চলছে, তা–ও অনেকের পছন্দ নয়। বিএনপির একজন নেতা খেদের সঙ্গে বললেন, ‘আমরা সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের কথা বলি। কিন্তু দলেও স্বৈরতন্ত্র আছে। ইউনিয়ন পরিষদের কমিটি কাদের নিয়ে হবে, তা–ও ঠিক করে দেন অদৃশ্য নেতা। এ অবস্থায় দলকে ঠিক রাখতে হলে খালেদা জিয়ার সক্রিয়তার বিকল্প নেই।’
সরকারি দলের নেতাদের এই বক্তৃতা–বিবৃতির জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাঁর দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না-করার বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ নাটক শুরু করেছে। ক্ষমতাসীন দলের উদ্দেশ্য খারাপ। সরকারি দলের নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে হঠাৎ করে আপনাদের এত দরদ উথলে উঠল কেন? উদ্দেশ্য একেবারেই ভালো না, খারাপ। তাঁরা দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চান। দেশের মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে চান। আমাদের সামনে দৃষ্টি একটাই—ভোটের অধিকার ফেরত চাই।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারুন আর না–ই পারুন, জনগণের ভোটের অধিকার ফেরত পাওয়ার লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি