জামায়াতকে মাঠে নামাল কে?

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে গত শনিবার রমনাসংলগ্ন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সমাবেশ করেছে
ছবি : প্রথম আলো

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো দল বা সংগঠনের সভাসমাবেশ করার অধিকার আছে। আমাদের সংবিধানেও সেটি স্বীকৃত। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি তো ব্যাকরণমতো চলে না। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেদের সুবিধামতো রাজনীতির ব্যাকরণ তৈরি করেন। আবার সেটি সুবিধামতো বদল করতেও দ্বিধা করেন না।

প্রায় সব পত্রিকাতেই অভিন্ন শিরোনাম এসেছে। জামায়াতে ইসলামী ১০ বছর পর সমাবেশ করার অনুমতি পেল। তারা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে গত শনিবার রমনাসংলগ্ন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সমাবেশ করেছে। বলা হয়েছিল, ঘরের ভেতরে সমাবেশ করতে হবে। কিন্তু জামায়াতের কর্মী-সমর্থকেরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন পাশের সড়ক হয়ে মৎস্য ভবন পর্যন্ত।

এ সমাবেশে জামায়াতের নেতারা কী বলেছেন, কত লোক জড় করেছেন, তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ হলো সরকারের অনুমতি পাওয়া। নতুন মার্কিন ভিসা নীতির তাৎক্ষণিক সুফল যদি কেউ পেয়ে থাকে, সেটি জামায়াতে ইসলামী। ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। সেই সময় থেকে জামায়াত আন্দোলন ও ভোটের মাঠে বিএনপির প্রযত্নেই থাকত।

শনিবারের সমাবেশ দেখে মনে হয়, তাদের প্রযত্নের খুঁটিটি সম্ভবত বদলে গেছে। যেমন ফুটবল খেলায় প্রতিযোগী দলগুলো বিরতির পর স্থান বদল করে। ফুটবল মাঠে দলের জায়গা বদলে ফলাফলে তেমন হেরফের হয় না। রাজনীতিতে হয়।

আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত বন্ধু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের সাম্প্রতিক উক্তিও রাজনীতির নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দেয়। বিএনপি থেকে জামায়াতকে আলাদা করতে পারলে ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ সুবিধা পাবে। যেমনটি তারা হেফাজতের ক্ষেত্রেও করেছে। এখন আর বিএনপির সঙ্গে কেউ হেফাজতে ব্রাকেটবন্দী করে না। বরং আওয়ামী লীগেরই বন্ধু ভাবে। ভবিষ্যতে জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির রাজনীতি বলে আলাদা কিছু থাকবে কি?

শনিবার জামায়াত সমাবেশের অনুমতি পাওয়া নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা রকম গুঞ্জন দেখা দিয়েছে। এটি কি সরকারের গণতান্ত্রিক রীতির মেনে চলার দৃষ্টান্ত না অন্য কিছু? এর আগে জামায়াত ঢাকা শহরে  সমাবেশ করেছিল ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধের দায়ে আবদুল কাদের মোল্লার বিচারের রায়ের আগের দিন। সেই সময় জামায়াতের নেতারা পুলিশ সদস্যদের হাত ফুল তুলে দেওয়ার পাশাপাশি সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল। তাঁদের সেই হুঁশিয়ারি কাজে লাগেনি। এবার তারা পুলিশকে অনুমতির জন্য ধন্যবাদ দিয়েছেন। এই ধন্যবাদের পেছনে অন্য কোনো রহস্য আছে কি না, সেটাই ভেবে দেখার বিষয়।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যিনি সরকারেরও একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী—বলেছেন, জামায়াতকে বিএনপিই মাঠে নামিয়েছে। জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দিল সরকার। তাহলে বিএনপি কীভাবে মাঠে নামাল? কিছুদিন আগে জামায়াতের কয়েক নেতাকে পুলিশ ধরে আবার ছেড়ে দিয়েছে। পুলিশের সন্দেহ ছিল, জামায়াতের ওই নেতারা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিলেন। পরে সরকার জানতে পারে, ষড়যন্ত্র নয়, পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমাবেশের বিষয়ে কথা বলতে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে তাঁরা এক জায়গায় বসছিলেন।

এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী অনিবন্ধিত দল হলেও পুলিশের অনুমতি নিয়ে সমাবেশ করতে পারবে। গণতান্ত্রিক দেশে অনুমতি নিয়ে সমাবেশ করতে হবে কেন? বরং রাজনৈতিক দলগুলো সমাবেশের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিষয়টি অবহিত করতে পারে, যাতে তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।

বিএনপি বা বাম দলগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, নির্দিষ্ট সময় ও স্থানের বাইরে নেতা-কর্মীরা গেলে পুলিশ লাঠিপেটা করে (কাজটি অবশ্যই নিন্দনীয়) জামায়াতের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। ৮ জুন বিএনপির সমাবেশের পর নেতা-কর্মীরা মিছিল করতে গেলে একপর্যায়ে পুলিশ বাধা দেয়। আবার কোথাও কোথাও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ‘শান্তিরক্ষা’ করতে গিয়ে আচ্ছামতো পিটিয়েও দিয়েছে। এটাই আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। বিরোধী দলে থাকলে পিটুনি খাও। সরকারি দলে থাকলে পিটুনি দাও।

এত দিন আওয়ামী লীগের নেতারা বলতেন, জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধীদের দল। জঙ্গিদের দল। বিএনপির সঙ্গে মিলে তারা অগ্নিসন্ত্রাস করেছে। জনগণের জানমালের ক্ষতি করেছে। সেই জামায়াতের প্রতি সরকারে হঠাৎ সদয় হওয়ার কারণ কী! তাঁরা কথায় কথায়  বিএনপি ও জামায়াতকে ব্রাকেটবন্দী করতেন। বিএনপি সেই অপবাদ থেকে মুক্তি পেতে ২০-দলীয় জোট আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দিয়েছে। জামায়াত এখন কোনো জোটে নেই। আওয়ামী লীগের সহৃদয় আচরণের পেছনে কি এটা কাজ করছে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনে করেন, জামায়াতকে সমাবেশ করার অনুমতির পেছনে সরকারের নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ কাজ করেছে। যদি বিএনপি নির্বাচনে না যায়, তাহলে জামায়াতকে নামে-বেনামে নির্বাচনে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে সরকার।  জামায়াতের নেতারা ভিন্ন নামে নিবন্ধনের জন্য ইসিতে আবেদন করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, তাঁরা নিবন্ধন পেয়েও যাবেন।

আরও পড়ুন

সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সাম্প্রতিক বক্তব্যেও এর ইঙ্গিত আছে। গত সোমবার রাজধানীর নবাবগঞ্জে দলের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘রাজনীতির মাঠে কথা আছে, আওয়ামী লীগ জামায়াতকে বিভিন্ন নামে কিছু সিট (আসন) দেবে। আমাদেরও কিছু সিট দেবে। আমাদের বলা হয়, আপনারা আরও সংগঠিত হোন, আরও বেশি সিট দেব।’

নির্বাচনে সিট দেওয়া নেওয়া ঠিক করে জনগণ। কোনো দল নয়। কোনো বড় দল নির্বাচনে অংশ না নিলে সেটি আইনত বৈধ হলেও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। আওয়ামী লীগের দাবি, ২০১৪ ও ২০১৮-এর মতো নির্বাচন চায় না। তাহলে ২০২৪ সালের নির্বাচনটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতেই কি জামায়াতে ইসলামীকে মাঠে নামার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার?

দলটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সখ্য নতুন নয়। এরশাদের আমলে ১৯৮৬ সালের নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অংশ নিয়েছিল। ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপির সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন করেছিল, তাতে অন্যদের সঙ্গে জামায়াতও ছিল। সেই সময়ের জামায়াতের ভূমিকা যদি গণতন্ত্রের পক্ষে গিয়ে থাকে, বিএনপির সঙ্গে গিয়ে একই আন্দোলন করলে গণতন্ত্রবিরোধী হয় কীভাবে?  দলটির কয়েকজন শীর্ষ নেতার ফাঁসি বা যাবজ্জীবন হয়েছে, একাত্তরে তাদের মানবতাবিরোধী ভূমিকার জন্য। গণতন্ত্র ও দেশপ্রেমের সংজ্ঞা নিজেদের সুবিধামতো বদলে দেওয়ার সুযোগ আছে কি?

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, জামায়াতকে বিএনপি মাঠে নামিয়েছে। কিন্তু মাঠের মালিক তো সরকার। সরকার অনুমতি দিয়েছে বলে তারা সমাবেশ করতে পেরেছে। এত দিন অনুমতি দেয়নি, সমাবেশও করতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে ‘বিএনপি জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে’— এমন বক্তব্য হাস্যকর নয় কি?

আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত বন্ধু জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের সাম্প্রতিক উক্তিও রাজনীতির নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দেয়। বিএনপি থেকে জামায়াতকে আলাদা করতে পারলে ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগ সুবিধা পাবে। যেমনটি তারা হেফাজতের ক্ষেত্রেও করেছে। এখন আর বিএনপির সঙ্গে কেউ হেফাজতে ব্রাকেটবন্দী করে না। বরং আওয়ামী লীগেরই বন্ধু ভাবে। ভবিষ্যতে জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির রাজনীতি বলে আলাদা কিছু থাকবে কি? বাংলাদেশ ক্ষমতার রাজনীতি হলো রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ন্যায় অন্যায় জানিনে জানিনে.....।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]