দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ছয় মাসে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশে-বিদেশে অনেক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। দেশের সাক্ষাৎকারগুলো মোটের ওপর একই রকমের। প্রশ্নগুলো এক, উত্তরও এক। সাম্প্রতিক দু-একটি সাক্ষাৎকারে তাঁকে কিছুটা ক্লান্ত, এমনকি বিরক্তও মনে হয়েছে।
অথচ বিদেশিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় তাঁর গলার স্বর ভিন্ন, এমনকি শরীরের ভাষাও। সেখানে তিনি শুধু আশাবাদী নন, বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ব্যাপারে তিনি রীতিমতো নিশ্চিত।
আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি যার অভাব, সেটি হলো আশা। বিদেশি বন্ধুদের তিনি জানিয়েছেন, এক নতুন, এক ভিন্ন বাংলাদেশ গড়ার কঠিন কাজে তিনি হাত দিয়েছেন। এই কাজের পেছনের চালিকা শক্তি দেশের ছাত্র ও তরুণ নাগরিকেরা। তাঁদের অনুরোধেই তিনি এই দায়িত্বভার নিয়েছেন।
দুই সপ্তাহ আগে অধ্যাপক ইউনূস দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে এসেছিলেন অতিথি হয়ে। সেখানে তাঁকে ঘিরে একাধিক প্রশ্নোত্তর সেশন হয়েছে। মুখোমুখি সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন, যার একটি ছিল ফিন্যান্সিয়াল টাইমস–এর আন্তর্জাতিকবিষয়ক প্রধান ভাষ্যকার গিডিয়ন রাখমানের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি, যা পডকাস্ট হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। ঢাকার পত্রপত্রিকায় তার মোদ্দাকথাটি প্রচার পেয়েছে।
কিন্তু এসব প্রতিবেদনে যা নেই, তা হলো অধ্যাপক ইউনূসের আশাবাদী কণ্ঠস্বরটি। তিনি প্রকৃতই বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের সামনে এক ঐতিহাসিক সুযোগ এসেছে নতুন এক সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ার। ‘শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্যও এটি একটি ঐতিহাসিক সম্ভাবনা।’
যাঁরা সাক্ষাৎকারটি পড়েছেন কিন্তু তা শোনার সুযোগ পাননি, তাঁদের বলব, শুনুন। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের গল্পটি তাঁর চেয়ে ভালোভাবে আর কেউ বলেছে বলে মনে হয় না। দেড় দশকের একনায়ক এই প্রবল ক্ষমতাধর শক্তিকে কীভাবে নতুন প্রজন্মের সদস্যরা অদম্য সাহস ও বুদ্ধিমত্তায় পরাস্ত করল, অধ্যাপক ইউনূসের জবানিতে তা রীতিমতো শিহরণ জাগায়।
এই অভাবিত গণজাগরণের বিবরণের প্রায় পুরোটাই ধরা আছে দেশের দেয়ালচিত্রে। ‘এমন ঘটনা পৃথিবীতে আর কখনো কোথাও ঘটেনি।’ তার মানে এটা একটা ‘গ্রাফিতি রেভল্যুশন’? গিডিয়নের প্রশ্ন। ‘তাদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, এসব ছেলেমেয়ে একের পর এক দেয়ালচিত্র এঁকে গেছে।...অদ্ভুত সেসব দেয়ালচিত্রে ফুটে উঠেছে তাদের স্বপ্নের বিবরণ।’
অধ্যাপক ইউনূস ১২ বছরের এক বালকের মায়ের কাছে লেখা তার শেষ চিঠির কথা উল্লেখ করেছেন। ‘মা, আমি জানি তুমি চাও না আমি মিছিলে যাই। কিন্তু দেখো, আমার সব বন্ধুরা মিছিলে। তাদের কেউ কেউ মারাও গেছে।...আমি ভিতু নই। আমিও তাদের জন্য দেশের জন্য লড়তে চাই। আমি যাচ্ছি, মা, আমাকে দোয়া কোরো। যদি আর ফিরে না আসি, যদি আমার মৃত্যু হয়, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।’
সেই ছেলে মিছিলে গিয়েছিল, আর ফিরে আসেনি।
অধ্যাপক ইউনূসের মুখে এই গল্প আবার শুনে আমি চোখের জল আটকাতে পারিনি। তিনি বিদেশি সাংবাদিককে সাহসের গল্প বলছিলেন, বীরত্বের গল্প বলছিলেন, তার চেয়েও বড় কথা এক স্বপ্নগাথার বিবরণ দিচ্ছিলেন।
ছোট–বড় সব বিপ্লবের এক বা একাধিক বয়ানকারী থাকে। গিডিয়নের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের সাক্ষাৎকারটি শুনে আমার কাছে মনে হয়েছে, জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের যে অভূতপূর্ব গণজাগরণ, তার সেরা ত্রুবাদুর তিনি। সেই গণজাগরণের গল্পটি এখনো পুরোপুরি লেখা হয়নি। যখন লেখা হবে, অধ্যাপক ইউনূসের কণ্ঠস্বরটি তাতে নির্ঘাত স্থান পাবে।
দেশের ভেতরে ও বাইরে অনেকে এই বিপ্লবের সম্ভাবনা ও সাফল্য নিয়ে এখনো সন্দিহান। এমন লোকেরও অভাব নেই, যাঁরা বিগত স্বৈরাচারী সরকারের প্রত্যাবর্তনের জন্য দিন গুনছেন। সেই সব লোকের কাছে এই কথা পৌঁছে দেওয়া খুব জরুরি যে ঠিক কেমন বাংলাদেশ আমরা চাই। আর তা বিনির্মাণের দায়িত্ব আমাদের। অন্য কেউ তা আমাদের জন্য নির্মাণ করে দেবে না। স্বৈরাচারের প্রস্থান আমাদের তেমন একটি পরিবর্তিত বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ তুলে দিয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য, অধ্যাপক ইউনূস সেই নির্মাণকাজে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছেন।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সব দিক তুলে ধরা বা ব্যাখ্যা এই সাক্ষাৎকারের লক্ষ্য ছিল না। আমার মনে হয়েছে অধ্যাপক ইউনূস বিদেশে বাংলাদেশের সুহৃদদের আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে স্বৈরাচারের কঠোর শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে একটি বহুপক্ষীয় গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণ বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব। শুধু সম্ভবই নয়, তাঁর নেতৃত্বে তেমন একটি বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায়।
মানছি, কাজটা সহজ নয়। অধ্যাপক ইউনূস নিজেও সে কথা বারবার বলেছেন। সে চ্যালেঞ্জের বিবরণ অধ্যাপক ইউনূস নিজেই দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কাজ অর্থনীতির পুনর্নির্মাণ। যাঁরা দেশের কান্ডারি, গত ১৫ বছর তাঁরাই এই অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছেন। জাতীয় কোষাগার এখন কার্যত শূন্য। প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার হয়েছে। ফলে সংকট দেখা দিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার। বিদেশি ঋণ শোধের জন্য পর্যাপ্ত রিজার্ভ নেই। কিন্তু এমন ঘন আঁধারেও থাকে আলো। অধ্যাপক ইউনূস গিডিয়নকে জানালেন, যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার রিজার্ভ নিয়ে চরম দুর্বিপাকে, হঠাৎ ভোজবাজির মতো, বিদেশ থেকে কর্মরত বাংলাদেশিদের বর্ধিত পরিমাণে রেমিট্যান্স আসা শুরু হলো। বেঁচে গেল বাংলাদেশ।
অর্থনীতি ছাড়া বড় প্রশ্ন নির্বাচন ও সংস্কারের চ্যালেঞ্জ। রাজনীতিবিদের মতানৈক্যের ভিত্তিতেই ঠিক হবে কতটা সংস্কার আমরা চাই, তারাই ঠিক করবেন নির্বাচনের তারিখ। কিন্তু সবার আগে যা প্রয়োজন, তা হলো মৌল প্রশ্নগুলোতে জাতীয় ঐক্য। জুলাই সনদ নামে যে ঘোষণার দাবি ছাত্রদের কাছ থেকে এসেছে, অধ্যাপক ইউনূস মনে করেন, তাতেই প্রতিফলিত হবে নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা। ‘এটি হবে এমন এক ঐতিহাসিক নথি, যার আলোকে চালিত হবে বাংলাদেশ।’
একই সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ইউনূস ছাত্রদের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের কথা উল্লেখ করেছেন। ‘তারা হয় কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দেবে, অথবা নিজেদের দল গঠন করবে।’ নিজেদের রক্তের বদলে যে অর্জন তারা করেছে, তাকে রক্ষার জন্যই এই রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন। অধ্যাপক ইউনূসের এ কথায় এমন একটা ধারণা হয়, ছাত্রদের এই রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগটি তিনি সমর্থন করেন। ছাত্রনেতাদের একাংশ এই মুহূর্তে তাঁর সরকারের সদস্য। সরকারের ভেতর থেকেই যদি তারা সরকার গঠন করে, তাহলে কি এই নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? এমন প্রশ্ন গিডিয়ন করেননি। তবে বাংলাদেশের ভেতরে তেমন আশঙ্কা অনেকেই ব্যক্ত করেছেন।
ভারতীয় ও পশ্চিমা তথ্যমাধ্যমে পরিবর্তিত বাংলাদেশে উগ্র ইসলামপন্থী রাজনীতির ব্যাপারে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। গিডিয়নের একটি প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস সেই আশঙ্কা বাতিল করে দেন। ‘না, ইসলামপন্থীদের ক্ষমতা দখলের কোনো লক্ষণ নেই। নিদেনপক্ষে আমি তেমন কোনো লক্ষণ দেখি না।’ তবে ধর্মভিত্তিক একাধিক রাজনৈতিক দল এখন সুসংগঠিত, সে কথা বোধ হয় অস্বীকার করা যাবে না। তাদের প্রভাবে সামাজিক ক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ সংকুচিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা, দেশের সাংস্কৃতিক চরিত্র আক্রান্ত হওয়ার কথা আলোচনায় আসছে। অধ্যাপক ইউনূসের ভাষ্যে কিন্তু এর কোনো স্বীকৃতি নেই।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সব দিক তুলে ধরা বা ব্যাখ্যা এই সাক্ষাৎকারের লক্ষ্য ছিল না। আমার মনে হয়েছে অধ্যাপক ইউনূস বিদেশে বাংলাদেশের সুহৃদদের আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে স্বৈরাচারের কঠোর শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে একটি বহুপক্ষীয় গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণ বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব। শুধু সম্ভবই নয়, তাঁর নেতৃত্বে তেমন একটি বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায়।
‘বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আমি বলেছি, বাংলাদেশ এক ব্যতিক্রমী দেশ। জনসংখ্যায় বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশটির মানুষের গড় বয়স ২৭। আমাদের নবপ্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত, নানা নতুন আইডিয়া তাদের রয়েছে। প্রত্যেকের হাতে রয়েছে সেলফোন। বাংলাদেশে জন্ম হলেও চেতনায় তারা আন্তর্জাতিক। তোমরা শুধু এদের সামনে এগোনোর একটি সুযোগ দাও।’
অধ্যাপক ইউনূস এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন, আমাদেরও সেই স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। তাঁকে ধন্যবাদ।
● হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক