‘জুলাই অভ্যুত্থান’ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের পর গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ইতিহাসের বাঁকে নানা আন্দোলন হয়েছে। হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক শক্তিগুলো একসঙ্গে আন্দোলন করেছে। দীর্ঘ দেড় দশকের এ আন্দোলনে হাজারো মানুষ গুম, খুন, অত্যাচার ও মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন। এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি পায় জুলাই-আগস্টে—যখন সব শ্রেণি–পেশা, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও লিঙ্গের মানুষ রাজপথে নেমে আসেন।
এ আন্দোলনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সর্বজনীনতা। যেখানে ভেদাভেদ ভুলে মানুষ একত্র হয়েছিল ও প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজের তরুণ-তরুণী, ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া থেকে শুরু করে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছিলেন এই অভ্যুত্থানে।
বোরকা আবৃতের পাশে জিনস-টি-শার্ট পরা তরুণী একসঙ্গে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন, রাজপথের কিশোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বনানী-গুলশানের তরুণের সঙ্গে, একযোগে। বিশেষ করে বিভিন্ন বয়সের নারীদের উপস্থিতি এই আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতির কারণেই কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারের বহুল ব্যবহৃত ‘সন্ত্রাসবাদী’ বয়ান কাজে আসেনি। মানুষ ‘সন্ত্রাসবাদ জুজুর ভয়ে’ বিশ্বাস করেনি। কারণ, জনমানুষ নিজেই ছিল এই অভ্যুত্থানের অংশীদার।
জুলাইয়ের শক্তি এর সর্বজনীন ঐক্যে। গণতন্ত্রের পক্ষে, নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে, লুটপাটের বিপরীতে নিজেদের কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নিজেদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের মানুষ ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী জুলাইয়ে রাজপথে নেমেছিল। যেকোনো আইডেনটিটি বা পরিচয় তৈরির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ‘কমন এনিমি’ সর্বজনীন শত্রু।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় ‘কমন এনিমি’ কলোনিয়াল শাসকদের সামনে রেখেই জাতীয়তাবাদ তৈরি হয়েছিল এই ভূখণ্ডে। তার আগে বড় ধরনের জাতিগত পরিচয়ের অনুপস্থিতি ছিল। তেমনি কমন এনিমি শেখ হাসিনাকে সামনে রেখে জুলাইয়ের পরিচয় তৈরি হয়। হাসিনা সরকারের পতনের পর এই পরিচয় টিকিয়ে রাখতে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার দরকার ছিল। কিন্তু সেই বোঝাপড়া তো হয়ইনি, বরং ক্ষমতার ভাগ নিয়ে দৃষ্টিকটু কাড়াকাড়ি পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে তা হাসিনাবিরোধী সর্বজনীন ঐক্যকেও বাধাগ্রস্ত করে তুলতে পারে।
হাসিনা সরকারের পতনের এক বছরের মাথায় কীভাবে আমরা এ ধরনের আশঙ্কার মুখোমুখি দাঁড়ালাম, তা বিশ্লেষণ করা জরুরি। এই সর্বজনীন ঐক্য বিনষ্ট হলে কার লাভ ও কার ক্ষতি, তার হিসাব-নিকাশও দরকার। গত ৫ আগস্টের পর নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে পুলিশের অনুপস্থিতির পরও সাধারণ জনগণের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্যের কারণে বড় ধরনের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেনি। কিন্তু সরকার গঠনের কয়েক মাস পরেও আমরা দেখি, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে গাফিলতি অথবা অনিচ্ছা।
যে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষায় জুলাই অভ্যুত্থান গড়ে উঠেছিল, সন্ত্রাসবাদীরা সেই গণতন্ত্রকেই ‘অকার্যকর শাসনব্যবস্থা’ হিসেবে প্রচার করছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দিয়ে র্যালি ও মিছিল বের করা হচ্ছে, যেখানে প্রকাশ্যেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড দেখা যাচ্ছে। অতীত বাংলাদেশে কোনো শাসনেই এমন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান দেখা যায়নি।
সরকারের নাকের ডগায় মাজারে হামলা হয়, নারীদের ফুটবল টুর্নামেন্টে হামলা হয় বা বন্ধ করে দেওয়া হয়, ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটে। অভ্যুত্থানের মতো বিশেষ পরিস্থিতিতে জনগণ নিজের হাতে ক্ষমতা তুলে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হয়েছে, সেই সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও যদি ‘মব ভায়োলেন্সের’ ঘটনা ঘটে এবং সরকার সেটা দমন করতে অনিচ্ছুক হয়, তবে তা একটি বড় ধরনের ব্যর্থতা ও অপরাধও বটে। সরকারের এই অনিচ্ছুক ও দুর্বল অবস্থানের সুযোগ নিয়ে কিছু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কারাগার থেকেও এই গোষ্ঠীগুলোর অনেকে মুক্তি পান।
যে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষায় জুলাই অভ্যুত্থান গড়ে উঠেছিল, সন্ত্রাসবাদীরা সেই গণতন্ত্রকেই ‘অকার্যকর শাসনব্যবস্থা’ হিসেবে প্রচার করছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দিয়ে র্যালি ও মিছিল বের করা হচ্ছে, যেখানে প্রকাশ্যেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড দেখা যাচ্ছে। অতীত বাংলাদেশে কোনো শাসনেই এমন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান দেখা যায়নি। যে অসীম সম্ভাবনা জুলাই অভ্যুত্থান বয়ে নিয়ে এসেছিল, তা সফল না হওয়ার পেছনে অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বল ও অকার্যকর অবস্থানকে অনেকে দায়ী করতে পারেন।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সময়কে দীর্ঘায়িত করা ও বিরাজনৈতিকীকরণকে নানাভাবে উৎসাহিত করাও জুলাই অভ্যুত্থানের ঐক্য বিনষ্ট করার পেছনে কাজ করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই সরকারকে পাঁচ বছর রাখা এবং প্রচলিত রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে যে প্রচারণা, তা বিরাজনৈতিকীকরণের পক্ষে জনমত তৈরি করতে সহায়তা করে।
কিন্তু দিন শেষে একটি রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের। তাঁদের সমীকরণের বাইরে রেখে বিরাজনৈতিকীকরণের উদ্যোগ একদিকে যেমন রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা ডেকে আনে, তেমনি আরেক দিকে ক্ষোভ, অসন্তোষ ও ক্ষমতার দখল নিয়ে বিরোধকে ত্বরান্বিত করে।
লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠক এই অনিশ্চয়তা অনেকটাই কমিয়ে আনে। কিন্তু একটি গোষ্ঠী জনগণের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ভালো চোখে দেখেনি। তাই স্থিতিশীলতার বদলে জুলাইয়ের পক্ষ শক্তিগুলোর মধ্যে ফাটল ধরানো ও অনৈক্যের বীজ বপন করার চেষ্টা চলতে থাকে।
যখন নির্বাচনের সময় নিয়ে একটি ঐকমত্য তৈরি হয়েছে এবং ঐকমত্য কমিশন মাসখানেকের মধ্যেই একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থানে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে, তখনই আবার দেশব্যাপী অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা করা হচ্ছে। মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে নৃশংস হত্যাকাণ্ড, খুলনায় যুবককে গুলি ও রগ কেটে হত্যা এবং একজন ইমামের ওপর হত্যাচেষ্টা করা হয় সম্প্রতি। বিএনপির পক্ষ থেকে সব শীর্ষ নেতাই এ হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচারও চান।
সাধারণত হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে ক্ষমতাসীন সরকারকে দায়ী করেই আন্দোলন হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা খেয়াল করি খুলনার হত্যাকাণ্ড ও ইমাম হত্যাচেষ্টাকে এড়িয়ে মিটফোর্ডের সামনের হত্যাকাণ্ডকে সামনে এনে সরকারকে দায়ী না করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দায়ী করে মিছিল করা হলো। এসব মিছিল থেকে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও অশ্রাব্য গালি দিয়ে স্লোগানও দেওয়া হয়।
একটি হত্যাকাণ্ডকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সামনে এনে বিচারের দাবিকে মুখ্য না করে বরং তারেক রহমানকে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের ঘটনায় খুনের সঙ্গে জড়িয়ে গালি দেওয়ার ফলে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যেও ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
অনেকেই মনে করেন, হত্যাকাণ্ডের ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে বড় ধরনের বিএনপিবিরোধী জনমত ও ব্যক্তিগতভাবে তারেক রহমানের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করার চেষ্টা থেকেই একটি পক্ষ থেকে এই কুৎসামূলক প্রচারণা চালানো হয়েছে। মনে রাখা দরকার, এ ধরনের অপরাধ ঠেকাতে যেমন রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক ব্যবস্থা ও সদিচ্ছা লাগবে, তেমনি সরকারেরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার মতো সক্ষমতা এবং সাহস থাকতে হবে। রাজনৈতিক দল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বা বিচারিক দায়িত্বে নেই, তাই রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে বেশি কিছু করার সামর্থ্যও নেই।
সম্প্রতি এনসিপি দেশের বিভিন্ন জায়গায় জনঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে। জনগণের কাছে যাওয়া ও তাদের দাবি বোঝার চেষ্টা করার এই প্রচেষ্টাকে আমাদের স্বাগত জানানো উচিত।
তবে জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী এনসিপির কার্যক্রম বিশ্লেষণ করলে, তাদের পপুলিস্ট বা জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই ধারার অংশ হিসেবেই ‘মব ভায়োলেন্স’, বিরাজনৈতিকীকরণ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি তাদের ঝুঁকে পড়া খেয়াল করা যায়। মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরও এই পপুলিস্ট ধারা তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও পথসভার বক্তৃতায় স্পষ্ট।
রাষ্ট্র গঠন নিয়ে এনসিপির যে সংস্কারের দাবিগুলো আছে, তা তাদের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে নেওয়া উচিত। রাষ্ট্রকাঠামো হঠাৎ করে জাদুর কাঠি ছুঁইয়ে পাল্টিয়ে ফেলা যায় না; বরং অবিবেচনাপ্রসূত দ্রুত সংস্কার রাষ্ট্রকে আরও পিছিয়ে দিতে পারে। একটি মধ্যপন্থী দল হিসেবে গড়ে ওঠার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এনসিপির উচিত সঠিক মিত্র খুঁজে নেওয়া এবং জুলাই ঐক্যকে বিনষ্ট না হতে দেওয়া। এই ঐক্য বিনষ্ট হলে একদিকে পতিত স্বৈরাচারের আসার পথ সুগম হবে এবং অন্যদিকে উগ্র গোষ্ঠীগুলো তাদের অবস্থান শক্তিশালী করবে।
ড. সাইমুম পারভেজ অসলোর নরওয়েজিয়ান স্কুল অব থিওলজি, রিলিজিয়ন ও সোসাইটির জ্যেষ্ঠ গবেষক (সহযোগী অধ্যাপক) এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশেষ সহকারী
মতামত লেখকের নিজস্ব
