চরবিষয়ক মন্ত্রণালয় কেন প্রয়োজন

সামাজিক নিরাপত্তায় চরাঞ্চলের মানুষের জন্য চরের সংকটকে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।ছবি : লেখক

দেশে বড় বড় নদীতে অসংখ্য চরে বসবাস করা লাখ লাখ মানুষের সঙ্গে সরকার সারা জীবন বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছে। চরের কৃষি, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সব ক্ষেত্রে চরের জীবনমান অনেক নিচে। চরের সঙ্গে জীবনমানের বৈষম্য দূরীকরণে প্রধানত একটি মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। মন্ত্রণালয় না হলেও চর উন্নয়ন বোর্ড কিংবা চর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা হলে বৈষম্য দূরীকরণ সহজ হতে পারে।

সড়ক-রেলপথের ব্যবস্থা না থাকার কারণে অনেক চর মূল জনপদ থেকে বিচ্ছিন্ন। অসংখ্য দ্বীপচর রয়েছে, যার চারদিকে পানিবেষ্টিত। এসব চরের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। প্রতিবছর চর ভাঙে, সৃষ্টি হয় নতুন চর। কোনো কোনো জেলায় শত শত চর রয়েছে। সমতলের সঙ্গে পাহাড়ি জীবন যেমন এক নয়, তেমনি মূল জনপদের সঙ্গে চরের জীবন মেলানো যাবে না। উল্লেখ্য, সব চরে মানুষ বাস করে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় এবং ব্যবস্থাপনায় চরের জন্য স্বতন্ত্র নিয়ম করা প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে চরের ছেলেমেয়েরা লেখপড়ায় পিছিয়ে। বাল্যবিবাহসহ অনেক সমস্যার মূলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকা। কয়েকটি চর মিলে হয়তো একটি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে খুব কমসংখ্যক চরে। চরে চাহিদার তুলনায় কলেজ নেই বললেই চলে। বেশ কয়েক ঘর মানুষের বাস আছে, এমন অনেক চরে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই।

সারা দেশে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমরা দেখতে পাই, সেগুলো প্রথমত স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেগুলো এমপিওভুক্ত হয়েছে কিংবা সরকারি হয়েছে। চরে মানুষের আর্থিক সক্ষমতা কম। তা ছাড়া পড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষকও একসময় ছিল না। চরে যেহেতু শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা খুব কম, তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থানীয় উদ্যোগে গড়ে ওঠেনি।

নদীমাতৃক দেশে নদীর জন্য যেমন মন্ত্রণালয় আছে, তেমনি চরের জন্যও মন্ত্রণালয় থাকা প্রয়োজন। একটি মন্ত্রণালয় থাকলে চর সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব বেড়ে যায়

চরের জন্য সরকারিভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়া প্রয়োজন। স্বাভাবিকভাবে যত শিক্ষার্থী বিবেচনায় স্কুল প্রতিষ্ঠার শর্ত আছে, চরের ক্ষেত্রে সেই নিয়ম রাখা যাবে না। অবশ্যই শর্ত শিথিল হওয়া বাঞ্ছনীয়। নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অনেকের হয়তো ধারণা নেই, কত দুর্গম এলাকায় চর আছে। দুর্গম চরে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেই ভালো চলবে, এমন আশা করা যায় না। চরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ বরাদ্দ বেশি রাখতে হবে। শিক্ষকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা না করলে শিক্ষকেরা চরে থাকতে চাইবেন না। যেসব চরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকবে, সেসব চরে অবশ্যই শিক্ষকদের আবাসনব্যবস্থাও রাখতে হবে। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের জন্য আবাসনব্যবস্থা থাকলে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা সহজ হবে।

এক চর থেকে আরেক চরে বর্ষা মৌসুমে সহজে যাওয়া সম্ভব হলেও নৌকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। শুষ্ক মৌসুমে চর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। চরে হেঁটে যাওয়াও কঠিন। কখনো নৌকা এবং হেঁটে স্কুলে যেতে হয়। চরের সড়ক নির্মাণেও স্বতন্ত্র নিয়মনীতি-পদ্ধতি থাকতে হবে। চরে একটি পাকা সড়ক নির্মাণ করতে হলে বিদ্যমান সড়কের মতো করার সুযোগ নেই। ফলে সেখানে সড়ক নির্মাণের ব্যবস্থাপনাও আলাদা হতে হবে।

সামাজিক নিরাপত্তায় চরাঞ্চলের মানুষের জন্য চরের সংকটকে বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। চরে বিয়ে মাত্রই বাল্যবিবাহ। এটি রোধ করতে শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে। চরে শিক্ষার্থী ভাতা এমনভাবে দেওয়া প্রয়োজন, যাতে অভিভাবকেরা শিশুদের বিয়ে না দিয়ে তাদের লেখাপড়া চালু রাখে।

চরের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। মাঝেমধ্যেই এমন কিছু ছবি চোখে পড়ে, যা দেখে খুব কষ্ট লাগে। চেয়ারে রোগীকে বসিয়ে বাঁশে করে দুদিকে দুজন ধরে চর পাড়ি দেয়। চরের মানুষের জীবনের মূল্য কি খুব কম? যথাসময়ে রোগীকে ডাক্তারের কাছে নিতে না পারার কারণ অসংখ্য রোগী মারা যান। চরের রোগীদের জন্য বিশেষায়িত নৌকা প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে।

চরের অর্থনীতি নিয়ে উপযুক্ত উদ্যোগ চাই। চরের কৃষিকে আরও উন্নত করা প্রয়োজন। চরের পণ্য বাজারজাতকরণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বন্যা মৌসুমে চরাঞ্চলে কোনো কোনো বছর ভয়াবহ বন্যায় ভীষণ ক্ষতি হয়। সেই ক্ষতি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব।

বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড আছে, বিশেষ উদ্দেশ্যে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। চরের কৃষি, অর্থনীতি, যোাগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য বিশেষায়িত কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। চরের সমন্বিত উন্নয়নের জন্য একটি মন্ত্রণালয় গড়ে তোলা প্রয়োজন।

চরবিষয়ক মন্ত্রণালয় গড়ে তোলার জন্য কুড়িগ্রামে একটি বড় আন্দোলন গড়ে উঠেছে। অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক শফিকুল ইসলাম বেবুর নেতৃত্বে চরবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দাবিতে প্রচুর সভা-সেমিনার হচ্ছে। এসবের জন্য সরকারের আন্তরিকতা থাকা চাই। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ আছে খুব অল্প সময়। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তারিখ হয়েছে। দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করবে। ইশতেহারে দলগুলো চরবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে।

চরের উন্নয়ন মানে সারা দেশের উন্নয়ন। চরের লাখ লাখ মানুষকে পশ্চাৎপদ রেখে দেশের সামষ্টিক উন্নয়ন হবে না। পিছিয়ে পড়া জনগণের বিশেষ সুবিধা পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার হলেও তা কাগজেই সীমাবদ্ধ। চরের মানুষ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হলেও কোনো সরকার তাদের জন্য বিশেষ কিছুই করেনি।

প্রশ্ন উঠতে পারে চরের উন্নয়নের জন্য মন্ত্রণালয় কেন গঠন করতে হবে? বোর্ড কিংবা অথরিটিও হতে পারে। বোর্ড কিংবা অথরিটির চেয়ে মন্ত্রণালয় হলে চরগুলো

বেশি গুরুত্ব লাভ করবে। তবে বোর্ড কিংবা অথরিটিও চরের অধিকার নিশ্চিতকরণে অনেকটাই কাজ করতে পারবে। আসলে চরের সংখ্যা, চরের জমির পরিমাণ, চরের বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে এর পরিসর অনেক বড়। নদীমাতৃক দেশে নদীর জন্য যেমন মন্ত্রণালয় আছে, তেমনি চরের জন্যও মন্ত্রণালয় থাকা প্রয়োজন। একটি মন্ত্রণালয় থাকলে চর সুরক্ষায় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব বেড়ে যায়।

পিছিয়ে পড়া চরজীবনের বিষয়টি সব সময় সরকারের চোখ এড়িয়ে গেছে। এবার অন্তত চরের মানুষের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হোক।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক