বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান ও পুলিশপ্রধানের দায়িত্বে থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ আলোচনা হচ্ছে। তাঁরা ব্যক্তিগত ও পারিবারিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাবেক বাহিনীপ্রধানদের বিভিন্ন কার্যক্রম এখনো নিরীক্ষাধীন কিংবা তদন্তাধীন। এসব নিঃসন্দেহে সময়সাপেক্ষ। তবে কোন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিন্যাসের কারণে তাঁরা তাঁদের ওপর অর্পিত ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা-ও সংশ্লিষ্ট তদন্তে বেরিয়ে আসা উচিত। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক।
প্রথমত, তাঁরা যখন বাহিনীপ্রধান থাকাকালে তাঁদের দুষ্কর্মগুলো সম্পন্ন করার জন্য নিজ নিজ বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা যায়, তারপরও কেন তাঁদের দুষ্কর্ম গোপন ছিল? আমাদের বাহিনীগুলো তাঁদের শৃঙ্খলা ও পেশাদারত্বের জন্য দেশে-বিদেশে প্রশংসিত। তবে শৃঙ্খলা বজায় রাখার নামে ঊর্ধ্বতনের আইনবহির্ভূত ও অন্যায় আদেশ পালন বাহিনীগুলোর সংস্কৃতি হতে শুরু করেছে কি না, সে বিষয়ে এ মুহূর্তেই সবার সচেতন হওয়া দরকার।
যা-ই হোক, বাহিনীপ্রধানের কৃতকর্ম অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ; তবে যে প্রশাসনিক শৃঙ্খলাকাঠামোর মধ্য দিয়ে তাঁরা বে-নজিরভাবে ক্ষমতার (অপ) ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছেন, তার নিবিড় নিরীক্ষা দরকার। কেননা, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অভ্যন্তরীণ জবাবদিহির অন্তত সনাতনী পদ্ধতিগুলো মোটাদাগে কার্যকর থাকলেও এমন ঘটনা ঘটত না বলে অনেকে এখনো বিশ্বাস করেন।
দ্বিতীয়ত জমিজমাসংক্রান্ত বিভিন্ন ঝামেলায় বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত সেগুলো স্থানীয়ভাবে সমাধান করার চেষ্টা করে। সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে মানুষ থানা-পুলিশ, আইন-আদালতের দ্বারস্থ হয়।
এ দুই প্রক্রিয়াতেই মানুষ স্থানীয় রাজনীতিবিদদের পাশে চায়। সংখ্যালঘুবান্ধব বলে দাবি করা সরকারের আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এত এত জমি জবরদস্তির মাধ্যমে একটি বাহিনীর কিছু সদস্য হাতিয়ে নিলেন, আর এ বিষয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা—যেমন উপজেলা, জেলা পরিষদ কিংবা সংসদ সদস্যরা—একেবারেই নিষ্ক্রিয় ছিলেন?
যদি তাঁরা এ বিষয়ে না জেনে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে, স্থানীয় রাজনীতি জনবিচ্ছিন্ন। আর যদি তাঁরা জেনেও নিষ্ক্রিয় থাকেন, তাহলে তাঁদের নিষ্ক্রিয়তার কারণ দুটি। এক, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে হীন স্বার্থের একটি অশুভ গাঁটবন্ধন তৈরি হয়েছে; দুই, বাহিনীর কাঠামোবদ্ধ ক্ষমতার কাছে জনপ্রতিনিধিদের হাতে পুঞ্জীভূত জনগণের ক্ষমতা সাময়িকভাবে মার খেয়ে গেছে।
স্মর্তব্য, গত সংসদের একাধিক সদস্য সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের আচরণের ব্যাপারে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। বর্তমান সংসদের একজন সদস্যও অভিযোগ করেছেন যে সাবেক একজন বাহিনীপ্রধান জোর করে তাঁর মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেলের শেয়ার হস্তগত করেছিলেন। জনপ্রতিনিধিরাই যদি প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামনে ক্ষমতাহীন বোধ করেন, তাহলে বুঝতে হবে, কোথাও বিরাট গন্ডগোল হচ্ছে; সাধু সাবধান!
আর রাজনীতিবিদ ও বাহিনীগুলোর মধ্যে যদি হীন স্বার্থে গাঁটবন্ধন তৈরি হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের সামষ্টিক ভোগান্তি কেবল শুরু হলো। আমাদের মনে রাখা দরকার, শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত ও চৌকস কর্মকর্তাদের খেয়ালখুশিমতো ‘দেশসেবা’র নাম গণতন্ত্র নয়; বরং প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্তব্যকর্মে জনগণের অভিপ্রায়ের কাছে নতিস্বীকারকারী জনপ্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহি করার চর্চার নামই হলো গণতন্ত্র।
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ নিগৃহীত হলে কোথাও গিয়ে যেন তাদের দুর্দশার কথা জানাতে পারে, সে জন্য স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোকে সচল রাখা জরুরি। রাজনীতিকে বাহিনীনির্ভর নয়, জননির্ভর রাখা দরকার। আর গণমাধ্যমকে বন্দী করে নয়, যতটা সম্ভব স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া দরকার। তাহলে ক্ষমতার ‘বেনজির’ অপব্যবহার নিশ্চিতভাবে হ্রাস পাবে।
তৃতীয়ত, সমাজ ও সংস্কৃতি কিংবা রাষ্ট্র-রাজনীতি-অর্থনীতির চলতি বিবরণ আমরা পাই গণমাধ্যম থেকে। প্রশ্ন জাগে, বাহিনীপ্রধানদের ক্ষমতার (অপ) ব্যবহার সম্পর্কে গণমাধ্যমে আরও আগেও তো আসতে পারত! আমরা কি ধরে নেব, গণমাধ্যমের মালিকপক্ষ বা কর্তাব্যক্তিরা ক্ষমতার কাছে নতজানু হয়ে গেছেন? নাকি এই বিলম্ব গণমাধ্যমকে ক্রমাগত নিষ্পেষণের বিষম ফলমাত্র?
স্থান বা প্রতিষ্ঠানবিশেষে গণমাধ্যমকর্মীদের অভিগম্যতা রোধ করায় বাহাদুরি নেই। আর তাঁদের কাজে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য নির্যাতন-নিপীড়ন নয়, বরং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। গণমাধ্যমের অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সভ্য দুনিয়ার সবার বিশ্বাস, স্বাধীনভাবে একে কাজ করতে দিলে দিনের শেষে লাভ জনগণের।
শেষ কথা, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ নিগৃহীত হলে কোথাও গিয়ে যেন তাদের দুর্দশার কথা জানাতে পারে, সে জন্য স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোকে সচল রাখা জরুরি। রাজনীতিকে বাহিনীনির্ভর নয়, জননির্ভর রাখা দরকার। আর গণমাধ্যমকে বন্দী করে নয়, যতটা সম্ভব স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া দরকার। তাহলে ক্ষমতার ‘বেনজির’ অপব্যবহার নিশ্চিতভাবে হ্রাস পাবে।
অনেকেই ভাবতে পারেন, বাহিনীপ্রধানেরা আপাত-অসীম ক্ষমতার অবাধ অপব্যবহার করতে পেরেছিলেন, কারণ তাঁরা ছিলেন ‘প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’। দেশের সব নাগরিকই কি প্রধানমন্ত্রীর লোক নয়? তিনি কি সংখ্যালঘুদের প্রধানমন্ত্রী নন?
আশার কথা, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে গণমাধ্যমকে আশ্বস্ত করেছে, সব অভিযোগের আইনানুগ নিষ্পত্তি হবে। সুতরাং প্রমাণ হতে যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর লোক হলেও কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।
মামুন আল মোস্তফা সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।