৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে প্রচার, অপপ্রচার, অতিপ্রচার চলছে। প্রচার হলো প্রার্থীর কৃতিত্ব-সাফল্যের বয়ান করে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা। অপপ্রচার হলো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে তাঁর প্রতি ভোটারদের বৈরী মনোভাব তৈরি করা। আর অতিপ্রচার হলো সেটা, যা প্রার্থীকে অতিমানব হিসেবে উপস্থাপিত করে।
যেকোনো নির্বাচনে প্রচার, অপপ্রচার ও অতিপ্রচার হওয়া অস্বাভাবিক নয়। নিজের পক্ষে একটি ভোট টানা মানে প্রতিদ্বন্দ্বীর দুটি ভোট কমে যাওয়া। আবার নিজের পক্ষের ভোট টানতে না পারা মানে প্রতিদ্বন্দ্বীর বাক্সে দুটি ভোট পড়া।
এ কারণে নির্বাচনী লড়াইটা হলো ‘কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’। অতীতে আমরা এই সমানে সমানে লড়াইটা দেখেছি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে। আগে দল থেকে কড়া নির্দেশ থাকত, যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, তাঁর পক্ষে কাজ করতে হবে। মনোনীত প্রার্থীর বিরোধিতা করলে বহিষ্কার হতে হবে। কিন্তু এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
২০১৪ সালে এক আসনে এক প্রার্থী রেখে তারা যে ভুল করেছিল, সেটি আর ২০২৪ সালে করেনি। ফলে এবারের নির্বাচনী যুদ্ধটা হয়েছে— ‘আমরা আমরাই’ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কিংবা তাঁদের নেপথ্যের ‘নেতারা’ প্রতিদ্বন্দ্বী মামুদের বিরুদ্ধে যেসব কথা বলছেন, তাতে অনেক সত্যও বেরিয়ে এসেছে। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম আওয়ামী লীগের স্থগিত হয়ে যাওয়া নেতৃত্ব ফিরে পেয়ে একের পর এক রণহুংকার ছাড়ছেন।
সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, গাজীপুরের তিনটি আসনে নৌকা প্রার্থীর বিপরীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন করেছেন। তবে তাঁর মূল ‘লক্ষ্যবস্তু’ মন্ত্রিসভার প্রবীণতম সদস্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার বান্নারা এলাকায় গত শনিবার গাজীপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী রেজাউল করিম রাসেলের সমর্থনে নির্বাচনী পথসভায় তিনি ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘এইবার বুইঝা-শুইনাই নামছি। বুইঝা-শুইনাই নামছি চোর ক্যামনে আটকাইতে হয়। ২০১৪, ১৮-তে কামডা আমরাই কইরা দিছিলাম। এইবার ক্যামনে আটকাইতে হয় হেইডা আমরা জানি।’ তার মানে এবারের ভোট জাহাঙ্গীর আলমের চোখে ‘চোর’ আটকানোর ভোট!
একই দিন রাসেলের সমর্থনে কালিয়াকৈর উপজেলার চাপাই মেদি বাজারে আরেকটি পথসভায় দেওয়া বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর উদ্দেশে সাবেক মেয়র বলেন, ‘এখন সমান সমান। এহন আর পুলিশও থাকব না। এখন সমান সমান, এখন আসেন। ২০১৪, ২০১৮ আর পাইতেন না। এটা ২০২৩-২৪ সাল। একটা ভোট চুরির নিয়ত কইরা দেহেন। নিয়ত কইরা দেহেন, আমাদের বাড়িও গাজীপুর। আপনারা যেই কামডা করছিলেন, আমরাই এই কামডা কইরা দিছিলাম।’
জাহাঙ্গীর আলমের বক্তব্য থেকে অনেকগুলো সত্য বেরিয়ে এল। ‘এখন সমান সমান’ মানে পুলিশ কারও পক্ষে যাবে না। এর অর্থ আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে পুলিশ বা প্রশাসন কারও পক্ষ নেবে না। আর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে তারা পক্ষ নেবে, নিয়েছে।
তবে জাহাঙ্গীর আলম পুরো সত্য বলেননি। পুরো সত্য হলো তিনি যেবার মেয়র নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন, সেবার তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থীর এজেন্টদের ধরে পুলিশ নির্বাচনী সীমানার বাইরে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। এর অর্থ জাহাঙ্গীর আলমরা কেবল ‘কামডা’ অন্যদের জন্যই করে দেননি, নিজের জন্যও করেছিলেন।
হ্যাঁ, তবে তিনি একটি কথা ঠিকই বলেছেন, গত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও পুলিশ ও প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন। এ কারণে নৌকা প্রার্থীর ভরাডুবি ঘটেছিল। এতে আরও একটি সত্য বেরিয়ে আসে যে নির্বাচনে দুই আওয়ামী লীগারের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে সমান সমান হয়। বিএনপি বা অন্য কোনো বিরোধী দলের শক্ত প্রার্থী থাকলেই সমস্যা হয়।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি না থাকলেও সমস্যা একেবারে চলে গেছে, বলা যাবে না। এখন নৌকা প্রার্থীর সামনে স্বতন্ত্রই একমাত্র সমস্যা। দৈনিক সমকাল প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে—স্বতন্ত্র এখন নৌকার ‘চক্ষুশূল’।
৩ জানুয়ারি প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) আসনে আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারী গ্রাম। ২ জানুয়ারি বেলা আড়াইটা থেকে সোয়া তিনটা পর্যন্ত দুই দফায় পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় অন্তত ৪০ জন আহত ও ১২টি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়েছে। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ঘটনাস্থলে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
নেত্রকোনা-৫ (পূর্বধলা) আসনে নৌকার প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ হোসেনের লোকজনের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম ওরফে সুহেল ফকিরের নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও কর্মী-সমর্থকদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে। এ সময় ছয়জন আহত হয়েছেন।
নওগাঁ-৪ (মান্দা) আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের পৃথক হামলায় দুই পক্ষের একজন করে কর্মী আহত হয়েছেন। স্থানীয় লোকজন জানান, ২ জানুয়ারি জোকাহাটে স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্রহানী সুলতান মামুদ ওরফে গামার নির্বাচনী ক্যাম্পে নৌকার প্রার্থীর কর্মী ওসমান আলীর নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ কর্মী-সমর্থক হামলা চালান। এ সময় হামলাকারীদের মারধরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী আজিজুল ইসলাম আহত হন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা তালপাতিলা বাজারে নৌকার প্রার্থীর কর্মী রেজাউল ইসলামের ওপর হামলা চালান।
লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনে নৌকার প্রার্থী আনোয়ার হোসেন খান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. হাবিবুর রহমান ওরফে পবনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষে দরবেশপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বিল্লাল হোসেনসহ উভয় পক্ষের ১০ জন আহত হয়েছেন।
এ ছাড়া নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। লালপুর থানা ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, গৌরীপুর উচ্চবিদ্যালয়ের উত্তর পাশের মোড়ে কাছাকাছি নৌকার প্রার্থী শহিদুল ইসলামের একটি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল কালামের একটি নির্বাচনী ক্যাম্প ছিল। সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত কর্মী-সমর্থকেরা প্রচারণা শেষে বাড়িতে চলে যান। গতকাল ভোরে উভয় প্রার্থীর কর্মীরা ক্যাম্পে এসে দেখেন, কে বা কারা তাঁদের ক্যাম্প দুটি পুড়িয়ে দিয়েছে।
মাদারীপুর-৩ (সদরের একাংশ, কালকিনি ও ডাসার) আসনে নৌকার প্রার্থী আবদুস সোবহান গোলাপের কর্মীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের একটি নির্বাচনী ক্যাম্পে তালা ও ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জয়পুরহাট-২ (আক্কেলপুর, ক্ষেতলাল ও কালাই) আসনে নৌকার প্রার্থী হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের দুটি নির্বাচনী ক্যাম্প পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সোমবার রাত পৌনে ১০টার দিকে আক্কেলপুর উপজেলার রায়কালী ইউনিয়নের খাঁ পাড়া মোড় ও সেখান থেকে আধা কিলোমিটার দূরের শৃগালদীঘি গ্রামের নির্বাচনী ক্যাম্প পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
এসব এক দিনের হিসাব। প্রতিদিনই নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত শতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এখনো নির্বাচনের কয়েক দিন বাকি।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে নির্বাচনী পরিবেশ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ রাখার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। নির্বাচনবিরোধী দলগুলো হরতাল-অবরোধ পরিহার করে প্রচারপত্র বিলির মতো নিরীহ কর্মসূচি পালন করছে।
কিন্তু তারপরও সংঘাত থামছে না। কারণ জাহাঙ্গীর আলমের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাও মনে করেন, এবার কেউ তাঁদের জিতিয়ে দেবে না। জনগণের ভোট পেয়েই জিততে হবে। এ কারণেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। যিনি মাঠে বেশি জোর দেখাতে পারবেন, তিনিই জয়ী হবেন, এখানে ‘নৌকা’ কিংবা ‘স্বতন্ত্র’ কোনো বিষয় নয়।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি