শিক্ষায় যেখানে আমরা অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে

দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই স্তরেই ছেলেমেয়ের সমতা অর্জিত হয়েছে।
ছবি: হাসান রাজা

আমি জানি, শিরোনাম পড়ে অনেকেই হাসছেন। পত্রিকায় মাধ্যমিক শিক্ষায় দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের সেরা বলে রিপোর্ট করার পর আমিও কিছুটা অবাক হয়েছিলাম। পরে পুরো রিপোর্টটা পড়ে আরও অবাক হয়েছি। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, আমি নিজে মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গে এত ওতপ্রোত জড়িত থাকার পরও কেন এত অবাক হলাম? হয়েছি তার কারণ, দীর্ঘদিন ধরে সংবাদমাধ্যম ও লোকমুখে মন খারাপ করা কথা শুনতে শুনতে আমার নিজের চোখে দেখা অনেক ভালো জিনিসের ওপরও আস্থা রাখতে পারিনি।

এখন বুঝি, আমরা যদি এই সাফল্যকে আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম, আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা আরও এগিয়ে যেত। তবে একই সঙ্গে আলেকজান্ডার দুমার সেই বিখ্যাত কথা, ‘নাথিং সাকসিডস লাইক সাকসেস’-এ যে একটা ফাঁক আছে তা–ও বুঝলাম। শুধু সফল হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, তাকে অনুভবও করতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ কেন তার নিজের সাফল্যকে অনুভব করতে পারে না?

একজন শিক্ষার্থীর যতটুকু শেখার কথা তার কতটা সে শিখেছে, সেটা কোনো ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে বোঝা যায় না। কারণ, ভর্তি পরীক্ষা ফেল করানোর জন্যই নেওয়া হয়, যাতে যোগ্য প্রার্থীদের সহজে বাছাই করা যায়। এটা যে আমরা সাধারণ মানুষেরা একেবারে জানি না তা নয়, কিন্তু আমরা মন্দ খবরে বেশি আকৃষ্ট হই বলে আমাদের মন্দ বোধটাই তীব্র হতে থাকে।

কেউ যদি দুঃখবাদী হন, তাহলে তিনি তাঁর সাফল্যকে অনুভব করতে পারেন না। নিজের সন্তান লেখাপড়া করলে মনে হয় পাস করবে না, পাস করলে মনে হয় চাকরি পাবে না, আর চাকরি হয়ে গেলে বেতন পাবে বলে বিশ্বাস হয় না। তাঁরাই মনে করেন শিক্ষা ক্ষেত্রে যত অর্জন ছিল, তা খোয়াতে খোয়াতে আমরা এখন প্রায় নিঃস্ব। বিখ্যাত কগনিটিভ বিজ্ঞানী স্টিভেন পিঙ্কার বলেছেন, আরও অন্তত দুটো কারণে আমরা আমাদের নিজেদের অর্জনকে অনুভব করতে পারি না। এর একটা কারণ হচ্ছে, আমাদের ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’ ভাবার সহজাত প্রবণতা। আর একটা কারণ হচ্ছে, কিছু সংবাদমাধ্যম, যারা ‘ইফ ইট ব্লিডস, ইট লিডস’ নীতিতে বিশ্বাস করে, তাদের প্রভাব।

আরও পড়ুন

পিঙ্কার আরও বলেছেন, সংবাদমাধ্যম একধরনের ‘অ্যাভেইলিবিলিটি এরর’ তৈরি করে। যেমন সংবাদমাধ্যমে বিমান দুর্ঘটনার খবর বেশি আসে বলে আমরা গাড়িতে চড়ার চেয়ে বিমানে উঠতে বেশি ভয় পাই। যদিও বিমানের চেয়ে গাড়িতে দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি। শুধু শিক্ষা নয়, যেকোনো ক্ষেত্রের নেতিবাচক বিষয়গুলোই খবরের বিষয়বস্তু হয় বলে আমাদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণাটাই তৈরি হয়। যেমন কয় দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ভর্তি-ইচ্ছুকদের অনুত্তীর্ণ হওয়ার খবরটি ফলাও করে প্রচার হওয়াতে এখন অনেকেই মনে করছেন যে মাধ্যমিক শিক্ষাটা একেবারে গোল্লায় গেছে।

অথচ মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞরা বলেন, একজন শিক্ষার্থীর যতটুকু শেখার কথা তার কতটা সে শিখেছে, সেটা কোনো ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে বোঝা যায় না। কারণ, ভর্তি পরীক্ষা ফেল করানোর জন্যই নেওয়া হয়, যাতে যোগ্য প্রার্থীদের সহজে বাছাই করা যায়। এটা যে আমরা সাধারণ মানুষেরা একেবারে জানি না তা নয়, কিন্তু আমরা মন্দ খবরে বেশি আকৃষ্ট হই বলে আমাদের মন্দ বোধটাই তীব্র হতে থাকে। যেমন পিঙ্কার বলেন, বেশির ভাগ মানুষই মনে করে পৃথিবীতে দিন দিন অশান্তি বাড়ছে। অথচ তথ্য-উপাত্ত বলে, বর্তমান পৃথিবীর মতো শান্তিময় পৃথিবী মানুষ এর আগে কখনো দেখেনি।

যা–ই হোক, মাধ্যমিক শিক্ষা যে রসাতলে যায়নি, সেটা সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একটি গবেষণা একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সেই গবেষণার বরাত দিয়ে আমাদের পত্রিকাগুলো লিখেছে ‘পড়া’ ও ‘গণিত’-এ আমাদের শিক্ষার্থীরাই দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা। কিন্তু শিক্ষার নিম্নগামী মান নিয়ে কেউ কেউ এতটাই নিশ্চিত, তাঁরা এই প্রতিবেদনকে গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন।

এ ক্ষেত্রে অবশ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও দায় আছে। তারা এটা স্পষ্ট করে জানায়নি, যেখান থেকে তথ্য-উপাত্তগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে, সেটা (ইউনেসকো ইনস্টিটিউট অব স্ট্যাটিস্টিকস) অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। যে প্রতিষ্ঠান গবেষণাটি করেছে, সেটি একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান (অস্ট্রেলিয়ান কাউন্সিল ফর এডুকেশনাল রিসার্চ) এবং যে দুটি প্রতিষ্ঠান (ইউনিসেফ ও এডুকেশন কমিশন) এই কাজের তত্ত্বাবধান করেছে, তাদের সম্পর্কে এযাবৎ কেউ পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার কোনো অভিযোগ করেনি।

আরও পড়ুন

শুধু তা–ই নয়, বাংলাদেশকে প্রতিবেদনে কেবল দক্ষিণ এশিয়ার সেরা বলা হয়নি, সেখানে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশ (‘পড়া’ ও ‘গণিত’-এ অদক্ষ শিক্ষার্থীর হার ৫৭ দশমিক ৮)। আসলে পুরো এশিয়া, আফ্রিকা এবং আমেরিকার বহু দেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। গবেষণাধীন ১০৬টি দেশের মধ্যে কমপক্ষে এশিয়ার ২২টি দেশ (অদক্ষ শিক্ষার্থীর রেঞ্জ ৬০%-৮৪%), আফ্রিকার ৩৪টি (৭৩.৮ %-৯৮.৭ %), উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার ১৬টি (৫৯.১ %-৮৫. ৪ %), ওশেনিয়ার ২টি (৫৮.৯ %-৬৯.৪%) এবং অস্ট্রেলিয়ার পাপুয়া নিউগিনি (৭৩.৬%)। মোট ৭৫টি দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। এমনকি শিক্ষা ক্ষেত্রে যেসব দেশকে আমাদের চেয়ে অনেক অগ্রগামী বলে মনে করি, যেমন মালয়েশিয়া (৬০%), ব্রাজিল (৬০.৩%) বা দক্ষিণ আফ্রিকা (৮৭.০৭%), আমাদের চেয়ে এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ড (৫০.৬ %), ফ্রান্স (৫০.৩%), টার্কি (৪৭.৯%), ইতালি (৪৪.১%), পর্তুগাল (৪৩.৪%), সুইডেন (৪১.৫%), নরওয়ে (৪০.৫%) বা যুক্তরাষ্ট্রের (৪০.৫%) মতো দেশও যে আমাদের চেয়ে খুব এগিয়ে আছে, তা নয়।

আমাদের চেয়ে যারা অনেক এগিয়ে আছে, তাদের কথাও একটু বলা দরকার। যেমন এস্তোনিয়া (১৬.৬%), জাপান (১৭.৬%), রাশিয়া (২০.৭%), পোল্যান্ড (২২.১%), কানাডা (২২.৩%), ডেনমার্ক (২২.৫%), চীন (২৩.৩%) এবং কিউবা (২৫.৬%) আমাদের চেয়ে অনেক ভালো করেছে। তবে এ ধরনের দেশগুলোতে শিক্ষায় যত দিন ধরে কাজ হচ্ছে এবং যত বিনিয়োগ হচ্ছে, সেটা বিবেচনায় নিলে আমাদের অর্জনকে খুব একটা কম বলে মনে হবে না।

এটুকু পড়ে হয়তো অনেকে মুচকি হাসছেন। ভাবছেন, ওই সময়টাতে আমি মাউশির মহাপরিচালক ছিলাম বলে নিজের ঢাক নিজে পেটাচ্ছি। ঢাকটা আসলে আমার নয়। এর কিছুটা সরকারের, কিছুটা শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ অন্যান্য অংশীজনের, কিন্তু এটা মূলত শিক্ষকদের। আমরা যদি দুমার সেই কথার মর্মার্থ মানি, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করে খুব ভালো দেশগুলোর কাতারে পৌঁছাতে চাই, তাহলে এই অর্জনটুকু সঠিকভাবে উপলব্ধি করে গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের এই ঢাক যতটা সম্ভব আরও জোরেশোরে বাজাতে হবে।

  • সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক