স্থানীয় নির্বাচন বড় নির্বাচনের প্রস্তুতি?

সপ্তাহখানেকের জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতের সিকিম রাজ্যে ভ্রমণে গিয়েছিলাম। অন্তত সপ্তাহখানেক সমতল ভূমির অসহ্য গরম থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিলাম। সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকসহ কয়েকটি জায়গায় গিয়েছিলাম। এর মধ্যে ছিল গ্যাংটকের অদূরে ভারত-চীন পূর্ব সীমান্তের অন্যতম কৌশলগত গিরিপথ ‘নাথুলা’র কাছাকাছি ১২ হাজার ৩১৩ ফুট উঁচুতে সামগো লেক বলে পরিচিত পাহাড়ি হ্রদও।

বরফে ঢাকা ছোট হ্রদটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণের জায়গা। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে এই ১৪ হাজার ১৪০ ফুট গিরিপথ চীনের দখলে চলে গিয়েছিল। তখন সিকিম পূর্ব হিমালয়ের ‘ভারতশাসিত’ একটি ক্ষুদ্র স্বাধীন রাষ্ট্র। কৌশলগত দিক বিবেচনা করে ১৯৭৫ সালে ‘সম্মতিক্রমে’ সিকিমকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এখন সিকিম ভারতের একটি রাজ্যের মর্যাদায় রয়েছে। বর্তমানে সিকিম-চীন সীমান্ত এবং নাথুলা গিরিপথজুড়ে রয়েছে একাধিক ভারতীয় সামরিক ঘাঁটি। শিলিগুড়ি করিডর বা চিকেন নেক বরাবর হওয়ায় সিকিম সামরিক কৌশলগত দিক থেকে বেশি গুরুত্ব বহন করে। আমার মনে হয়, এর গুরুত্ব আকসাই চীন থেকে বেশি।

আমার আজকের এ প্রবন্ধ ভ্রমণকাহিনি নিয়ে নয়। ঢাকা ছাড়ার আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল ও কয়েকজন কমিশনারের সঙ্গে আমার সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছিল। এ সাক্ষাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অনুরোধেই হয়েছিল। কারণ, এর আগে বর্তমান কমিশনের সঙ্গে আমার তেমন বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। তাদের আয়োজনে মাত্র একটি সংলাপে উপস্থিত থাকলেও সে সময় তেমন কার্যকর আলোচনা হয়নি।

এবারের সাক্ষাৎকালে অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনা বিশেষভাবে আবর্তিত হয়েছে আমার অভিজ্ঞতার আলোকে রচিত নির্বাচন কমিশনে পাঁচ বছর পুস্তকটিকে কেন্দ্র করে। বর্তমান কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় আমার উপলব্ধি হলো, কমিশন হয়তো ভালো নির্বাচন করতে চায় কিন্তু আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেভাবে সংবিধান অনুযায়ী করতে হবে, তা খুব সহজ হবে না। এ ক্ষেত্রে যদি সব দল নির্বাচনে না আসে, তবে এ নির্বাচন নিয়ে যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

আমার অভিজ্ঞতা ও ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু বলার, বলেছি। আসন্ন পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদের পূর্বসূরি কমিশনের প্রয়াত কমিশনার মাহবুব তালুকদার রচিত নির্বাচননামা-এর ১৪৫ থেকে ১৭৪ পৃষ্ঠায় বর্ণিত সিটি নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতার বিষয়গুলোকে অনুধাবন করতে বলেছি। বিশেষ করে ১৭৫ পৃষ্ঠায় বরিশাল সিটি নির্বাচন নিয়ে মাহবুব তালুকদারের বর্ণনা ও মূল্যায়নকে বিবেচনায় নিতে অনুরোধ করেছি। বরিশাল যেহেতু আমার বাড়ির শহর, তাই গত সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি যত দূর সম্ভব যথেষ্ট মনোযোগসহকারে প্রত্যক্ষ করেছি। মাহবুব তালুকদারের মূল্যায়নের সঙ্গে আমি একমত। ওই সময়েই আমার মনে হয়েছিল, নির্বাচনটি বাতিল করলে পূর্বতন কমিশন হয়তো কিছুটা আস্থা অর্জন করতে পারত।

বর্তমান ও আধুনিক নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় গণমাধ্যম নির্বাচন কমিশনের ও নির্বাচনপ্রক্রিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শরিক। এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত হবে না, যাতে মনে হতে পারে নির্বাচন কমিশন গণমাধ্যমকে প্রতিবন্ধক মনে করে। সম্প্রতি জারি করা কমিশনের গণমাধ্যমবিষয়ক পরিপত্র ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেছে, যা পুনর্বিবেচনা করার কথা কমিশন জানিয়েছে। আশা করি, কমিশন কথা ও কাজে অধিকতর সমন্বয় সাধন করবে। নির্বাচন কমিশনের শিথিলতার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য হলে দায়দায়িত্বের সিংহভাগ কমিশনের ওপর বর্তাবে।

এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচন আরও কঠিন হতে পারে। বিশেষ করে গাজীপুর, সিলেট ও খুলনার নির্বাচন কঠিন হতে পারে। অবশ্য নির্বাচন কমিশনের জন্য পরীক্ষার ক্ষেত্র হলেও এসব সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কোনোভাবেই জাতীয় সংসদের নির্বাচনের সঙ্গে তুলনাযোগ্য নয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একদিকে যেমন বিশাল কর্মযজ্ঞ হয়, অন্যদিকে সবচেয়ে বড় লোকসমাবেশও ঘটে। জাতীয় নির্বাচন সমন্বয় করার কাজটি অনেক বড় বিষয়। এর ওপর ব্যালট পেপারে হতে যাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচন। অবশ্য এখানেই শেষ নয়, জাতীয় নির্বাচন অনেকটা বিস্তৃত যুদ্ধক্ষেত্রের মতো।

বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা করাটা বড় চ্যালেঞ্জ। এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলের উপস্থিতি না থাকলেও কয়েকটি সিটি করপোরেশনে সরকার-সমর্থিত প্রার্থীদের কারণে যে নির্বাচন কমিশনকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে, তা কমিশন ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাম্প্রতিক বক্তব্যে এমনটাই প্রকাশ পেয়েছে।

স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং এমনকি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও কমিশনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মাঠপর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ। গাইবান্ধা উপনির্বাচনে হাবিবুল আউয়াল কমিশন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। আসন্ন কয়েকটি নির্বাচনে অধিকতর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কিছু পদক্ষেপ এবং কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অবশ্যই কিছু ফল দেবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং নির্বাচনে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের ওপর কমিশনের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ উদ্ভাবন করা প্রয়োজন।

এই লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে যা করতে হবে তার মধ্যে রয়েছে প্রথমত, কেন্দ্র পর্যায়ে সরাসরি যোগাযোগের জন্য কমিশন ও কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সঙ্গে ডিজিটাল যোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন। দ্বিতীয়ত, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাধিক রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ। এবং তৃতীয়ত, সামর্থ্যের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব পর্যবেক্ষক নিয়োগ। এসব পর্যবেক্ষকের কাজ হবে নির্বাচন চলাকালে যেকোনো ব্যত্যয় সরাসরি কমিশনকে জানানো এবং প্রয়োজনে অভিযোগের তাৎক্ষণিক তদন্ত করে কমিশনকে জানানো।

আরও পড়ুন

মাঠপর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আরও কিছু ক্ষেত্রে আমার সুপারিশ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো নির্বাচনী ব্যয় পর্যবেক্ষণে পর্যবেক্ষক দল নিয়োগ দেওয়া এবং প্রচারণার সময় সাপ্তাহিক অথবা প্রতি তিন দিনে সেটা পর্যবেক্ষণ করা। যদিও আমাদের দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সেটা এখনই সম্ভব নয়। তবে ভবিষ্যতে একাধিক ধাপে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে পারলে মাঠপর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে আমি দুটি ম্যানুয়াল তৈরির ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। প্রথমটি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জবাবদিহি ও অধিকতর দায়িত্বের আওতায় আনতে ‘সিকিউরিটি ম্যানুয়াল’ বা নিরাপত্তা ম্যানুয়াল তৈরি করা। এতে প্রত্যেক সদস্যের নিয়োগ এবং দায়িত্ব লিপিবদ্ধ থাকবে। দ্বিতীয় ম্যানুয়ালটি ‘কমপ্লেইন ম্যানুয়াল’ বা ‘অভিযোগ ম্যানুয়াল’, যার মধ্যে বিস্তারিতভাবে অভিযোগ উত্থাপনের নিয়ম এবং তাৎক্ষণিক তদন্ত দল গঠন ইত্যাদি বর্ণনা সন্নিবেশিত থাকবে। অতীতে সিংহভাগ অভিযোগে কমিশন কর্ণপাতও করেনি। বিগত কমিশন বিদায়ের পর রাতের ভোটের অভিযোগের বিষয়ে স্বীকার করলেও ওই সময়ে এ অভিযোগকে আমলেই নেয়নি। এসব অভিযোগ কোথাও লিপিবদ্ধ করার কোনো উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়নি।

ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) কিছু ধারায় কিছু সংশোধনী আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ফলাফল গেজেট হওয়ার আগে কমিশন কর্তৃক অভিযোগের দৃশ্যমান প্রমাণ সাপেক্ষে পুনর্গণনা করার বিধান সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত করা। আমি মনে করি, যদি কমিশনের হাত শক্ত করার মতো ইচ্ছা সরকারের থাকে, তাহলে এই বিধান অবশ্যই থাকা উচিত। একই সঙ্গে আইন শুধু সাদাকালোতেই নয়, এর যথাযথ প্রয়োগ নির্বাচন কমিশনকেই করতে হবে।

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমার অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় কমিশনের সদিচ্ছার প্রকাশ ছিল বটে, তবে সদিচ্ছার প্রতিফলন যদি কার্যকর করা না যায় এবং আইন যদি সঠিক ও নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করা না হয়, তবে শত আলোচনা ও আইনের সংস্কারেও কোনো কাজে আসবে না। নির্বাচন কমিশনের সামনে যে কয়টা স্থানীয় সরকার নির্বাচন রয়েছে, সেগুলো পরিচালনায় কমিশন তার সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে পারে।

আরও পড়ুন

পরিশেষে, নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং জনগণের কাছাকাছি যাওয়ার ও আস্থা অর্জনের জন্য গণমাধ্যম অত্যন্ত সহায়ক ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। বর্তমান ও আধুনিক নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় গণমাধ্যম নির্বাচন কমিশনের ও নির্বাচনপ্রক্রিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শরিক। এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত হবে না, যাতে মনে হতে পারে নির্বাচন কমিশন গণমাধ্যমকে প্রতিবন্ধক মনে করে। সম্প্রতি জারি করা কমিশনের গণমাধ্যমবিষয়ক পরিপত্র ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি করেছে, যা পুনর্বিবেচনা করার কথা কমিশন জানিয়েছে। আশা করি, কমিশন কথা ও কাজে অধিকতর সমন্বয় সাধন করবে। নির্বাচন কমিশনের শিথিলতার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য হলে দায়দায়িত্বের সিংহভাগ কমিশনের ওপর বর্তাবে।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

[email protected]