ক্রীড়াঙ্গনের বাপ-চাচা বনাম সাংবাদিকদের বাপের জুতা

সংবাদ সম্মেলনে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ও সহ–সভাপতি কাজী নাবিল আহমেদ
ছবি: প্রথম আলো

খেলার অঙ্গনের খবর যখন প্রথম পাতায় আসে, তখন আনন্দের সীমা থাকে না। কারণ, মাঠে উজ্জ্বল আলো ছড়ানোর খবরগুলোই সাধারণত প্রথম পাতায় যায়। থাকে সেই আলো ছড়ানো, দ্যুতিময় তারকাদের ছবি, সাক্ষাৎকার। দেশের মুখ উজ্জ্বল করা খেলোয়াড়দের নিয়ে নানা কথামালা।

কিন্তু হালে ক্রীড়াঙ্গনের যে সব খবর খেলাধুলার কৃতিত্বকে ছাপিয়ে সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতায় শিরোনাম হচ্ছে, তা বিশ্বাস করাও বিস্ময়কর। এই খবরের স্রষ্টা ক্রীড়াঙ্গনের হালজামানার ‘বাপ-চাচা’রা। তাঁদের কেউ কেউ একসময়ের উজ্জ্বল ক্রীড়াবিদ, এ কথা সত্য। কিন্তু এখনকার ক্রীড়াঙ্গনের ‘বাবা-চাচা’ হয়েছেন ক্ষমতার রাজনীতির সোনার কাঠির স্পর্শে। সব ভালো ছাত্রই ভালো শিক্ষক হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। তেমনি মাঠের সবচেয়ে ভালো খেলোয়াড় ভালো ক্রীড়া সংগঠক বা ক্রীড়া প্রশাসক না–ও হতে পারেন। এই না হতে পারারাই নানা সংবাদ শিরোনাম সৃষ্টি করে চলেছেন অবিরাম।

এই রচনা সে বিষয়গুলোরই প্রতিক্রিয়া। প্রতিক্রিয়া জানাতে দেরি হলো। কারণ, এর মধ্যে একটু খোঁজ নিলাম, কোন সাংবাদিকের বাবা কত দিন ধরে জুতা পরছেন আর কোন ক্রীড়া সংগঠকের বাবা কত দিন ধরে! আর আন্ডারওয়্যারের কথা একটু পরে বলি।

এ কথা ঠিক, গোটা বাংলাদেশে এখন যেমন প্রায় সারাক্ষণ জুতা পায়ে রাখার চল আমরা দেখি, কয়েক দশক আগেও এমনটি ছিল না। এ দেশের সাধারণ মানুষ সকাল–সন্ধ্যায় জুতা বা স্যান্ডেল পরতেন, সারা দিন খালি পায়ে থাকতেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতির বদল হয়েছে, সাধারণেরা সাধারণ জুতাই পরেন। আর ক্রীড়াঙ্গনের ‘বাপ-চাচা’রা বাহারি ব্র্যান্ডের যে দামি জুতা পরেন, তা নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে গেলে থলের অনেক বিড়াল বেরিয়ে যাবে।

তো ক্রীড়াঙ্গনের কতিপয় ‘বাবা-চাচা’ সাংবাদিকদের বাবার জুতা দেখতে চেয়েছেন। না দেখতে চাইলেও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি সাংবাদিকের জুতা দেখেছেন, এমন ঘটনাও আছে। নিশ্চয়ই সেই খবরের কথা অনেকে মনে করতে পারেন। সাদ্দাম হোসেনকে সরিয়ে দিয়ে ‘ইরাক বিজয়ে’র উৎসব করতে যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়কার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ গিয়েছিলেন বাগদাদে। সেখানে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার পর বুশ দেখেছিলেন এক সাংবাদিকের জুতা। সংবাদ সম্মেলন কাভার করতে আসা এক সাংবাদিকের ছুড়ে মারা জুতা বুশের মাথায় লাগেনি বটে, কিন্তু ঘটনা যা ঘটার, তা ঘটে গেছে। সাংবাদিকের ওই জুতা ইরাকিদের প্রতিবাদ ও ঘৃণার প্রতীক হিসেবে বিশ্ব গণমাধ্যমের খবর হয়েছে। সেই সাংবাদিক পরে কয়েক মাস জেল খেটে ছাড়া পেয়েছেন।

বুশ তো জুতা দেখতে চাননি, কিন্তু আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের মশহুর ‘বাবা-চাচা’রা সাংবাদিকদের বাবাদের জুতা দেখতে চেয়েছেন। আহা কেমন হতো, ওই সংবাদ সম্মেলনে কোনো সাংবাদিক বন্ধু যদি ইরাকি সেই সাংবাদিকের মতো নিজের পায়ের জুতাটি ছুড়ে দিয়ে বলতেন, ‘আমার বাবার সারা জীবন খালি পায়ে থাকার ত্যাগ দিয়ে তিনি আমাকে শিক্ষিত করেছেন, আমি সাংবাদিক হয়েছি। আমার পায়ে যে জুতা, সেটা আমার বাবারই দান। কাজেই এই জুতা বাবার জুতাও বলা যায়।’ চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটি দেখছি এবং এমন ঘটনা কীভাবে সংবাদ মাধ্যমে আসত, কল্পনা করছি। কিন্তু সে রকমটি ঘটেনি।

ফুটবলের ‘বাপ-চাচা’রা বলছেন, তাঁরা নাকি ঠাট্টা করে এসব বলেছিলেন। বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! সাংবাদিক সম্মেলনের প্রস্তুতিলগ্নে প্রকাশ্যে যদি তাঁদের ঠাট্টা করার রুচি এই হয়, তাহলে রুদ্ধদ্বার, নৈশ আসরে তাঁদের ঠাট্টার রুচি কোথায় পৌঁছায়। সেটা কিছু কল্পনা করা যায়।

কয়েকজন সাংবাদিকের বংশলতিকা জেনে এই ভেবে স্বস্তি পেয়েছি যে তাঁদের বাবারা জুতার বিবিধ ব্যবহার করতেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে শায়েস্তা করার জন্য তাঁদের কেউ কেউ অসভ্যদের জুতাপেটা করতেন। জুতার এই ব্যবহারের জন্যই ‘জুতাপেটা’ শব্দটির উদ্ভব। যাঁরা সাংবাদিকদের বাবার জুতা দেখত চান, এই রকম একজন বাবা যদি সত্যি সত্যি জুতার বিবিধ ব্যবহার করার জন্য সংশ্লিষ্ট ফেডারেশন দপ্তরে হাজির হন, তাহলে পরিস্থিতিটি কী দাঁড়াবে, বলুন দেখি?

ক্রীড়াঙ্গনের এই ‘বাপ-চাচা’দের একজন নাকি আবার সাংবাদিকদের আন্ডারওয়্যারও দেখতে চান। তো এই আন্ডারওয়্যার নিয়ে একটি সত্যি গল্প বলি। এ দেশের শ্রদ্ধাভাজন সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরীকে নিয়ে ঘটনা এটি। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের বড় হর্তাকর্তারা সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে এলে সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন। তো সেবার এসেছেন ডাকসাইটে আমলা আজিজ আহমদ খান। সচিবালয়ে আমন্ত্রণ সম্পাদকদের। মানিক মিয়া, আব্দুস সালামের মতো সম্পাদকেরা হাজির।

আলোচনা শুরুর একেবারে চূড়ান্ত সময়ে হন্তদন্ত হয়ে জহুর হোসেন চৌধুরী রুমে ঢুকলেন। আজিজ খান জলদগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘জহুর, আপনার দেরি করে আসার অভ্যাসটা আর গেল না।’ জহুর হোসেন চৌধুরী অভ্যাসমতোই জবাব দিতে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মি. খান, আমার বাসা ইন্দিরা রোড। শাহবাগ পার হয়ে সচিবালয়ে আসতে হয়। রাস্তায় বের হয়ে শুনলাম, শাহবাগে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ চলছে। ক্ষুব্ধ জনতা অনেকের পায়জামা-প্যান্ট খুলে নিচ্ছে। আপনি হয়তো জানেন, আমি আবার আন্ডারওয়্যার পরি না...’ এইটুকু বলার পর আজিজ আহমদ খান জহুর হোসেন চৌধুরীকে থামিয়ে দেন। এরপর তাঁদের মধ্যকার বাৎচিত নিয়ে আরেক গল্প।

আরও পড়ুন

আমি ভাবছিলাম, আমাদের ফুটবলের ‘বাপ-চাচা’দের ওই সংবাদ সম্মেলনে যদি জহুর হোসেন চৌধুরীর অনুসারী কোনো সাংবাদিক সক্রিয় হতেন, তাহলে কেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো!

ফুটবলের ‘বাপ-চাচা’রা বলছেন, তাঁরা নাকি ঠাট্টা করে এসব বলেছিলেন। বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! সাংবাদিক সম্মেলনের প্রস্তুতিলগ্নে প্রকাশ্যে যদি তাঁদের ঠাট্টা করার রুচি এই হয়, তাহলে রুদ্ধদ্বার, নৈশ আসরে তাঁদের ঠাট্টার রুচি কোথায় পৌঁছায়। সেটা কিছু কল্পনা করা যায়। আসলে এই ‘বাপ-চাচা’রা যা–ই বলুন, সবটাই তাঁদের বিকৃত মানসিক চেতনারই প্রকাশ। মানুষ যা চিন্তা করে, তা–ই তাদের ভাষা ও আচরণে প্রকাশ পায়। এখানেই তা–ই হয়েছে। এটা তাঁদের পারিবারিক রুচি ও সংস্কৃতিরই প্রকাশ। তাঁরা যেকোনো কারণেই হোক সাংবাদিকদের যে পছন্দ করেন না, তারও একটি প্রামাণ্য।

১৯৭১ সালে রাও ফরমান আলী বাঙালিরা কেমন, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বাঙালিরা দেখতে কালো, খাটো এবং তারা সারা হাতে ভাত মাখিয়ে খায়।’ রাও ফরমান আলী বোঝাতে চেয়েছিলেন, বাঙালিরা খাওয়ার সময় কাটা চামচ ব্যবহার করতে জানে না, এরা এতটাই অসভ্য! তাঁর এই বিবৃতি বাঙালিদের প্রতি ঘৃণারই একটি প্রামাণ্য। এখানেও সাংবাদিকদের প্রতি ফুটবলের বাবা-চাচাদের দৃষ্টিভঙ্গি রাও ফরমান আলীর মতোই। এখন যতই দুঃখ প্রকাশ করুন, তাঁদের মগজের মধ্যেই আছে, সাংবাদিকেরা এতটাই অসভ্য যে তাঁদের বাবারা জুতা পরেন না, এমনকি তাঁরা আন্ডারওয়্যারও পরেন না।

এই পরিস্থিতিতে আমাদের সাংবাদিকেরা কী করবেন, তাঁরাই ঠিক করবেন। আমি ‘তাহাদের বর্জন বা বয়কট’ করার পক্ষে নই। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) দুর্নীতি নিয়ে বোমা ফাটানো সাংবাদিক অ্যান্ড্রু জেনিংস বলেছিলেন, আইওসির দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করা কঠিন ছিল, কারণ ফ্রি এয়ার টিকিট, ফ্রি হোটেলসহ নানা দুর্নীতির ভাগ যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে আইওসি বিটে কাজ করেছেন, এমন সাংবাদিকও রয়েছেন।

জেনিংসের অনুসন্ধানেই বের হয়ে আসে ২০০২ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ঘুষ ও মাদকের ভয়াবহ চিত্র। তাঁর প্রতিবেদনের কারণেই সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন অলিম্পিক কমিটির লৌহমানব চেয়ারম্যান হোয়ানআন্তনিও সামারাঞ্চ। চাকরি হারান কয়েক ডজন কর্মকর্তা।

জেনিংস বলেন, সাধারণত ক্রীড়া সাংবাদিকেরা ক্রীড়া তারকাদের এসব অন্ধকার নিয়ে রিপোর্ট করতে চান না, পাছে আবার এই তারকাদের সঙ্গে তাঁদের সখ্য নষ্ট হয়। পরিশ্রম ছাড়াই গ্ল্যামার বিক্রি করা খবর নিয়েই তাঁরা খুশি। বোধ করি সে কারণেই সাধারণ খেলা ও তারকা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চান তাঁরা। দৃশ্যত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির অনুসন্ধানে সাফল্যের পরই জেনিংস নজর দেন ফিফার দিকে। কীভাবে তিনি ফিফার অন্দরমহলে ঢুকলেন?

জেনিংসের জবাব, ‘যখন একটি সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ে দুর্নীতি হয়, তখন সেই প্রতিষ্ঠানের মাঝারি পর্যায়ের সৎ কর্মীরা সব বুঝেও চুপচাপ থাকেন। কিন্তু তাঁরা সব সময়ই এমন এক অস্বস্তিতে ভোগেন যে তাঁরা দেখছেন অন্যায় হচ্ছে, কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে কিছু বলতে পারছেন না। একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে এই অংশটিকেই হাত করা, তাঁদের আস্থাভাজন হওয়া এবং তাঁদের আস্থায় নেওয়া।’ এ পথেই হাঁটেন জেনিংস। [ সূত্র: ফিফার অন্ধকার ও অনুসন্ধানী জেনিংস, মনজুরুল আহসান বুলবুল, প্রথম আলো অনলাইন, আপডেট: ১১ জুন ২০১৫,০১: ১০ ]
আমার প্রত্যাশা আমাদের সাংবাদিকেরা জেনিংসের পথেই হাঁটবেন। একটু পরিশ্রম করে বের করে আনবেন ক্রীড়াঙ্গনের ‘বাপ-চাচা’দের অন্ধকারের সব চিত্র।

সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, ফুটবলের ‘বাবা-চাচা’দের এ ধরনের কাজে ক্রীড়ামন্ত্রী খুবই মর্মাহত। এই মন্ত্রীর একজন ঘনিষ্ঠ শুভাকাঙ্ক্ষী বলেই বলি, মন্ত্রীদের কাজ শুধু মর্মাহত হওয়া নয়। তাঁদের কাজ এই ‘বাপ-চাচা’দের চিহ্নিত করে তাঁদের বিদায় করা। মেঘনায় যখন নৌযানডুবি হয়, নৌমন্ত্রী তখন শুধু মর্মাহত হয়ে বসে থাকতে পারেন না। তাঁকে নিহত–আহত ব্যক্তিদের উদ্ধারে কাজ চালাতে হয়, ডুবে যাওয়া নৌযান উদ্ধার করতে হয়; কেন, কী কারণে, কার দোষে নৌযানটি ডুবল, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হয়। এটাই মন্ত্রীর কাজ।

ক্রীড়া সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে যা শুনি, হাতে গোনা কয়েকটি ফেডারেশনের কিছু সাফল্য ছাড়া বাকি ফেডারেশনগুলোর হাত ধরে ক্রীড়াঙ্গন ডুবছে। এসব ফেডারেশনের চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে অনেক ‘বাবা-চাচা’র পায়ে শিকড় গজিয়ে গেছে। কিন্তু তাঁরা চেয়ারও ছাড়ছেন না, কাজও করছেন না।

একটা প্রস্তাব করি, ক্রীড়াঙ্গনের ‘বাবা-চাচা’দের সবার আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হোক ক্রীড়া স্থাপনাগুলোতে। ক্রীড়ামোদী সাধারণ মানুষ এই ‘বাবা-চাচা’দের মধ্যে যাঁদের সফল মনে করবেন, তাঁদের মূর্তিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন। আর যাঁরা ব্যর্থ হয়েও চেয়ার ছাড়েন না, তাঁদের জন্য প্রকাশ করা হবে ঘৃণা, নিক্ষেপ করা হবে থুতু। তবুও যদি তাঁদের কিছু লজ্জা হয়। তার আগে বিভিন্ন ফেডারেশনের প্রায় স্থায়ী এই ‘বাবা-চাচা’দের একটি তালিকা এবং তাঁদের সাফল্য–ব্যর্থতার একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করা হোক। ক্রীড়ামন্ত্রীর কাজ কষ্ট পাওয়া নয়, তাঁর দায়িত্ব ক্রীড়াঙ্গন আবর্জনামুক্ত করা। মন্ত্রী যদি সফলভাবে কাজটি করতে পারেন, নিশ্চয়ই সবার বাহবা পাবেন।

  • মনজুরুল আহসান বুলবুল সাংবাদিক