তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প বিপর্যয় মোকাবিলায় ইউরোপ কেন উদাসীন

তুরস্কে শত শত বহুতল ভবন আক্ষরিক অর্থে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছেছবি: এএফপি

বেলজিয়ামের চেয়ে আকারে ১২ গুণ বড়—এমন একটি এলাকায় দুই দিন ধরে লাগাতারভাবে ২০টি বড় ভূমিকম্প হয়ে গেল। রিখটার স্কেলে তুরস্ক-সিরিয়ার প্রথম দফার ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭.৮। উচ্চমাত্রার সাড়ে সাত মেট্রিক টন টিএনটি দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটালে যে কম্পনের সৃষ্টি হবে, এই ভূমিকম্পের কম্পনশক্তি তার সমান। এরপর মধ্য ও পূর্ব তুরস্কে ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলো। তার খানিক বাদে তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে আঘাত করল ৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্প। এই ভূমিকম্পের পর প্রায় ৮০০ বার ভূমিকম্প-পরবর্তী কম্পন বা আফটার শক হয়েছে।

এই বিপর্যয়ে ২ কোটি ৩০ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই লেখা যখন লিখছি, তখন তুরস্কে কমপক্ষে ১৭ হাজার ৬৭৪ জন এবং সিরিয়ায় ৩ হাজার ৩৭৭ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন সব মিলিয়ে ৭২ হাজার ৮৭৯ জন। তুরস্কে এক লাখ এবং সিরিয়ায় তিন লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন। শত শত বহুতল ভবন আক্ষরিক অর্থে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। অনেকগুলো শহর ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। সড়কপথ ও রেলপথ এতটাই অচল হয়ে গেছে যে সেখানে সহায়তা নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ইতিমধ্যে অনেক দেশ ত্রাণসহায়তা এবং উদ্ধারকর্মী পাঠিয়েছে। তবে এই কয়েক দিনে নিখোঁজ মানুষকে উদ্ধারের তৎপরতা ঢিমে হয়ে এসেছে। সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো, তুরস্কের লাগোয়া ইউরোপেই এই দুর্যোগের খবর সংবাদমাধ্যম থেকে অপসৃত হতে শুরু করেছে। মানুষের দৃষ্টি থেকে এই দৃশ্যপট হারিয়ে গেলে সেখানকার কী পরিণতি হবে, তা আমরা জানি।

এই সপ্তাহে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির ব্রিটেন ও ব্রাসেলস সফরের কারণে ভূমিকম্প ইউরোপের গণমাধ্যম থেকে ছিটকে গেছে। খাকি রঙের টি–শার্ট পরা জেলেনস্কি ইতিমধ্যেই এমন এক রাজনৈতিক টিকিট হয়ে দাঁড়িয়েছেন যে ইউরোপের প্রতিটি পার্লামেন্ট তাঁর উপস্থিতি কেনার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করেছে।

শার্লি এবদোর মতো ইউরোপের নেতাদের মধ্যেও এই ভূমিকম্প নিয়ে নিষ্ঠুর উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। অথচ তাঁদের সামনে কোটি কোটি মানুষের প্রতি মানবিকতা প্রদর্শনের এটি এক মোক্ষম সুযোগ। এই বিপদের সময় তাঁদের সরকার কিংবা প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে কথা বলা জরুরি নয়। ইউরোপের নেতারা সরাসরি ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে মানবিকতা প্রদর্শন করতে পারেন।

ফ্রান্স ও ব্রাসেলসে যাওয়ার আগে ব্রিটেনকে জেলেনস্কির প্রথম গন্তব্য হিসেবে বেছে নেওয়ার পেছনে ব্রিটেনের সহায়তা বিষয়টি কাজ করেছে। ব্রিটেন গত বছর ইউক্রেনকে ২৭০ কোটি ডলার সামরিক সহায়তা দিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক আশ্বাস দিয়েছেন, এ বছরও সমপরিমাণ সহায়তা মিলবে। এর মাধ্যমে ব্রিটেন ইউক্রেনের দ্বিতীয় প্রধান দাতা দেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু তুরস্ক-সিরিয়ার এই ভয়াবহ বিপর্যয়ে সেই ব্রিটেন উদ্ধারকাজ, চিকিৎসাসহায়তা, আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং খাদ্য সরবরাহ বাবদ ৬০ লাখ ডলার দিতে রাজি হয়েছে।

একবার ভাবুন, ইউক্রেনকে অস্ত্র কিনতে দেবে ২৭০ কোটি ডলার আর ২ কোটি ৩০ লাখ দুর্গত মানুষের ত্রাণ হিসেবে দেবে ৬০ লাখ ডলার। মানবিকতার স্তরে বিবেচনা করলে, বৈশ্বিক পর্যায়ের বিপর্যয়কে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে এবং তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান দাভোসের মহান নেতাদের মধ্যে কতটা বেমানান, তা মাথায় না রেখেই বৈশ্বিকভাবেই মোকাবিলা করতে হয়।

এই মহাবিপর্যয় ঘটার দিন দু-একের মধ্যেই ফ্রান্সের ব্যঙ্গাত্মক ম্যাগাজিন শার্লি এবদো একটি কার্টুন ছেপেছে। সেই কার্টুনে দেখা যাচ্ছে: একটি ধসে পড়া ভবন, একটি দুমড়েমুচড়ে যাওয়া গাড়ি এবং ভবন ভাঙা ইট–সুরকির একটি গাদি; আর ক্যাপশনে লেখা—‘যাক, ট্যাংক পাঠানোর আর দরকার হলো না’। ২০১৫ সালে প্যারিসে শার্লি হেবদোর কার্যালয়ে আল কায়েদার হামলায় ১২ জন নিহত হওয়ার পর ম্যাগাজিনটিকে গণতন্ত্র ও বাক্‌স্বাধীনতার কেন্দ্রস্থল হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছিল। এখন ইউক্রেন ইস্যুতেও তাদের একইভাবে গণতন্ত্রের মুখপত্র বলা হচ্ছে। ওই সময় হামলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছিল এবং তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে উচ্চারণ করা ‘আমরা সবাই শার্লি’ স্লোগানটি ভাইরাল হয়েছিল। ওই সময় শার্লির স্থূল বর্ণবাদী মনোভাব কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে। শার্লি হেবদোর সর্বশেষ এই বর্ণবাদী নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ নিয়ে খুব কম সংগঠনই কথা বলেছে। যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এ নিয়ে যথেষ্ট সরব রয়েছে।

আরও পড়ুন

শার্লি এবদোর মতো ইউরোপের নেতাদের মধ্যেও এই ভূমিকম্প নিয়ে নিষ্ঠুর উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। অথচ তাঁদের সামনে কোটি কোটি মানুষের প্রতি মানবিকতা প্রদর্শনের এটি এক মোক্ষম সুযোগ। এই বিপদের সময় তাঁদের সরকার কিংবা প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে কথা বলা জরুরি নয়। ইউরোপের নেতারা সরাসরি ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে মানবিকতা প্রদর্শন করতে পারেন।

পশ্চিম যেমন ভাঙতে জানে, তেমনি গড়তেও জানে— তাঁদের সামনে এটি বিশ্বকে দেখানোর শ্রেষ্ঠ সময়। কিন্তু ইউরোপের মানসিকতা আজ যেন চার দেয়ালে ঘেরা—বিদ্যুতায়িত কাঁটাতারের বেড়া আর ড্রোনের টহলদারি ভেদ করে সেখানে মানবিকতা ঢুকতে পারছে না।

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

ডেভিড হার্স্ট মিডল ইস্ট আইয়ের প্রধান সম্পাদক ও সহপ্রতিষ্ঠাতা